কর্মে সাফল্য ও সুনাম বৃদ্ধি। উকিল, মৃৎশিল্পীদের শুভ। সংক্রমণ থেকে শারীরিক অসুস্থতা হতে পারে। আর্থিক ... বিশদ
সাংবাদিক ধবল প্যাটেল ‘ফেস অব নেশন’ নামে আমেদাবাদের একটি স্থানীয় পোর্টালের সম্পাদক ছিলেন। গত বছর (৭ মে, ২০২০) তিনি লেখেন, গুজরাতে শীঘ্রই মুখ্যমন্ত্রী বদল হতে চলেছে। দিল্লিতে সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছে। শুধু ঘোষণার অপেক্ষা। পিছনের কারণ দলের গোলমাল ও বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তাঁর উপর আস্থার অভাব। এবং অবশ্যই কোভিড সামলানোর ব্যর্থতা। মুখ্যমন্ত্রী রুপানিকে নিয়ে তাঁর ওই সাড়া জাগানো খবরে স্বভাবতই চাঞ্চল্য পড়ে যায় আমেদাবাদ থেকে দিল্লিঘুরে জাতীয় রাজনীতিতে। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর বশংবদ পুলিস সব ঝাঁপিয়ে পড়ে এক নিরীহ সাংবাদিকের উপর। যেহেতু দেশে করোনা চলছে তাই ধবলের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ ও বিপর্যয় মোকাবিলা আইনের কড়া ধারা দিয়ে মহামারীর মধ্যে সমাজে অশান্তি ও বিভ্রান্তি ছড়ানোর অভিযোগে এফআইআর করা হয়। সরকার এতটাই প্রোঅ্যাক্টিভ ছিল, যে এক সপ্তাহের মধ্যে তিনি গ্রেপ্তার হন। তাঁর বাড়ি অফিসে ব্যাপক তল্লাশি চলে। ধবলের অপরাধ তিনি মুখ্যমন্ত্রী বদল হতে পারে বলে একটা খবর করেছিলেন মাত্র। চুরি করেননি। কারও সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগও নেই। সাংবাদিকতায় কিছু স্পেকুলেটিভ খবর সব সময় হয়। যার কিছু মেলে, কিছু মেলে না। অনেকটা এক্সিট পোলের মতো। এ নিয়ে শাসকের সঙ্গে ঠান্ডা লড়াই, চিঠিচাপাটি মোটেই অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিছু ক্ষেত্রে তা মানহানির মামলাতেও গড়ায়। এটা একজন সাংবাদিকের পেশাগত ঝুঁকির অন্যতম দিক। কিন্তু তার জন্য বিপর্যয় মোকাবিলা আইনের সুযোগ নিয়ে সটান সাংবাদিককে জেলে পুরে দেওয়ার নজির মনে হয় জরুরি অবস্থা বাদ দিলে এদেশে বড় একটা নেই। অথচ অবাধ গণতন্ত্রের ধ্বজা ওড়ানো মোদি সরকারের আমলে তাই হয়েছে। ধবল প্যাটেল শুধু গ্রেপ্তারই হননি, যখন তিনি বুঝেছেন মহামারী আইনে যেভাবে তাঁকে বেঁধে ফেলা হয়েছে, তাতে সহজে রেহাই মিলবে না, তখন মুচলেকা দিয়ে প্রাণে বেঁচেছেন। এবং কিছুদিনের মধ্যেই দেশ ছেড়েছেন। এই মোদি সরকারই জরুরি অবস্থার সময়ে সাংবাদিকদের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া নিয়ে আজ সাড়ে চার দশক বাদেও সভায় সমাবেশে চোঙা ফুঁকে আসর গরম করেন। অথচ গত সাত বছরে সম্পাদক ধবল প্যাটেলের মতো এমন সাংবাদিক দমনের ঘটনা ভূরি ভূরি ঘটলেও কারও কোনও হেলদোল নেই! পরিসংখ্যানই বলছে, মোদি জমানায় ২০১৫ সাল থেকে চলতি ২০২১ সাল পর্যন্ত ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ভারত দ্রুত নেমেছে। ৬ বছর আগে আমরা ছিলাম ১৩৬তম স্থানে, আর আজ দুর্ভাগ্যজনকভাবে নেমে গিয়েছি ১৪২ নম্বরে।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও আইনের সুযোগ নিয়ে সাময়িক কোনও সাংবাদিক ও সংবাদপত্রগোষ্ঠীকে দমিয়ে রাখা গেলেও সত্যি তো আর দীর্ঘদিন চাপা থাকে না। ইন্দিরা গান্ধী কালা কানুন মিসা ব্যবহার করেও প্রবাদপ্রতিম বরুণ সেনগুপ্ত, গৌরকিশোর ঘোষকে দমাতে পারেননি। রুখতে পারেননি সাতাত্তরের ঐতিহাসিক পালাবদল। আশা করি, সময় এলে দোর্দণ্ডপ্রতাপ নরেন্দ্র মোদিও পারবেন না। সত্যি, আজ নয় কাল প্রতিষ্ঠিত হবেই। যেভাবেই হোক। সমাজের বিভিন্ন স্তরে কৃষক শ্রমিক খেটে খাওয়া মানুষের বিক্ষোভ ও অশান্তির টুকরো টুকরো ছবির মধ্যে দিয়ে তা ইতিমধ্যেই জানান দিতেও শুরু করেছে। গুজরাতের ক্ষেত্রেও যা অনিবার্য ছিল তাই ঘটে গিয়েছে। ভাগ্যের এমনই পরিহাস ওই পোর্টাল সম্পাদকের জেলবাসের ১৬ মাস পর রুপানি সাহেবকে মাথা নিচু করেই মুখ্যমন্ত্রী পদে ইস্তফা দিতে হয়েছে নেতৃত্বের নির্দেশে। মুখে সংগঠনের কাজ করবেন বলে সাফাই দিলেও কোভিড মোকাবিলায় গুজরাত সরকারের চূড়ান্ত ব্যর্থতায় মোদি-অমিত শাহ যে যারপরনাই ক্ষুব্ধ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তার ওপর বিধানসভা ভোটের এক বছর আগে গুরুত্বপূর্ণ প্যাটেল সম্প্রদায়ও সেখানে মুখ্যমন্ত্রীর কাজে খুশি নন। গোলমাল চরমে। তাই বিজেপির গদি বাঁচাতে রুপানির অপসারণ একপ্রকার অনিবার্যই ছিল। আর সেই কথা লিখেই সরকারের কোপে পড়েছিলেন এক সম্পাদক। আজ যখন তাঁর করা খবর বাস্তবের সঙ্গে মিলে গেল, তখন সেই সাংবাদিককে আর শুভেচ্ছা জানানোর কেউ নেই। নিশ্চয়ই বিদেশে একলা বসে সেদিনের নোট বইটা খুঁটিয়ে দেখে পাওয়া তথ্যগুলো আর একবার যাচাই করতে গিয়ে তৃপ্তির হাসি হেসেছেন নিপীড়িত সেই সাংবাদিক। আর ওই তৃপ্তিটাই দু’সপ্তাহের জেল যন্ত্রণার দীর্ঘশ্বাস ও বাধ্য হয়ে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার অসহায়তা থেকে তাঁকে অন্তত একটু স্বস্তি দিয়েছে। সান্ত্বনা এটুকুই।
কিন্তু ধবল প্যাটেল তো একা নন। গত কয়েক বছরে রাষ্ট্রের হাতে হেনস্তার শিকার সাংবাদিকের তালিকাটা কিন্তু দীর্ঘ। সঙ্ঘ পরিবারের স্নেহধন্য কেউ গ্রেপ্তার হলে নজিরবিহীনভাবে দ্রুত সুপ্রিম কোর্টে মামলা ওঠে। খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ট্যুইট করেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা রে রে করে নেমে পড়েন। জামিনের সঙ্গে মেলে বীরের সম্মানও। বশংবদ না হলে ঝুলে থাকে মামলা, কেউ খোঁজও নেয় না। দিল্লির ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক প্রশান্ত কানোজিয়া একটা নিরীহ ট্যুইট করেছিলেন রামমন্দির নিয়ে। তাতেই রেগে গিয়ে গেরুয়া শিবির তাঁকে দিল্লি থেকে লখনউতে তুলে নিয়ে গিয়ে জেল খাটিয়েছে। বাড়ি অফিসে তল্লাশির নামে তাণ্ডব চলেছে। টিভি চ্যানেলের জনপ্রিয় অ্যাঙ্কর পুণ্যপ্রসূন বাজপেয়ি এক সময়ের অত্যন্ত পরিচিত নাম। হঠাৎ একটি নামকরা চ্যানেলের শীর্ষ পদ থেকে তাঁর সরে যাওয়া ঘিরে নানা অপ্রিয় প্রশ্ন সামনে এসেছে। কার চাপে ও অঙ্গুলিহেলনে এমনটা হয়েছে, সে রহস্যের এখনও পর্দাফাঁস হয়নি। কার্যত তাঁর কেরিয়ারই খতম করে দেওয়ার আয়োজন সম্পূর্ণ। তালিকায় আছেন জনপ্রিয় মহিলা সাংবাদিক ও অ্যাঙ্কর বরখা দত্তও। ব্যক্তিগতভাবে প্রতিশোধ নিতে পাকিস্তানের চর বলে দেগে দেওয়া হয়েছে তাঁকে। দেশীয় সংবাদমাধ্যমের কোথাও টিকতে দেওয়া হয়নি অকুতোভয় বরখাকে। আজকাল মাঝে মাঝে কিছু বিদেশি গণমাধ্যমে তাঁর কলাম দেখতে পাই বটে, তবে ওইটুকুই। টাইম ম্যাগাজিনে বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালীর তালিকায় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে লেখাটাও তাঁর। কাশ্মীর নিয়ে নিয়মিত খবর করে সরকারের কোপে পড়েছেন সাংবাদিক মুস্তাক আহমেদ গনাই। তাঁকে শুধু গ্রেপ্তার করেই ক্ষান্ত হয়নি প্রশাসন, চলেছে অকথ্য অত্যাচারও। সবমিলিয়ে শুধু ২০২০ সালেই রাষ্ট্রের হাতে নিপীড়িত সাংবাদিকের সংখ্যাটা অনেক, এবং প্রতিনিয়তই তা বাড়ছে। তথ্যের আদানপ্রদান, স্বাধীন চিন্তা ও মতামতকে ইতিহাসে কোথাও একনায়করা ভালো চোখে দেখেননি। আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে শুধু একজন হিটলারের কথা বলি, কিন্তু সমাজে সংসারে, দৈনন্দিন চারপাশে এবং অবশ্যই রাজনীতিতে ‘হিটলার’ কখনও কম পড়েনা!
কেন বললাম এতগুলো কথা। এর কারণ একটাই এদেশে গত সাত বছরে সংখ্যালঘু মুসলিমদের সঙ্গে সাংবাদিকরাও যে অনিশ্চয়তার মুখোমুখি তা সবিস্তারে তুলে ধরা প্রয়োজন। টাইম ম্যাগাজিন বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালীর তালিকায় নরেন্দ্র মোদির নাম অর্ন্তভুক্ত করেও সংখ্যালঘু ও সাংবাদিকদের এই বিপন্নতার কথাই সবিস্তারে তুলে ধরেছে। সাংবাদিক ফরিদ জাকারিয়া লিখেছেন, ‘৭৪ বছরে স্বাধীন ভারত তিনজন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে পেয়েছে। জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী ও নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ থেকে টেনে নামিয়ে হিন্দু রাষ্ট্র করার দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর আমলে সংখ্যালঘুদের অধিকার খর্ব হয়েছে এবং সাংবাদিকদের ঠাঁই হয়েছে জেলে।’ একবারে হক কথা। তবে শুধু সংখ্যালঘু ও সাংবাদিকরাই নন, আজ বিপন্ন দেশের মহিলারাও। ডবল ইঞ্জিন রাজ্য উত্তরপ্রদেশ নিয়ে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই পরিস্থিতিটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। গত সপ্তাহেই সেই রাজ্যের আদ্যন্ত ‘যোগী’ মুখ্যমন্ত্রী অজয় বিস্ত মহিলাদের সঙ্গে গোরু, মোষকে একাসনে বসিয়ে গোটা দেশকে চমকে দিয়েছেন। কট্টর গেরুয়া সংসারে নারীর স্থান কোথায় তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে তাঁর ওই একটা কথাতেই। এরাই আবার মাঠে ময়দানে ‘ভারত মাতা কি জয়’ বলে ছদ্ম জাতীয়তাবাদের ধ্বজা তুলে ধরেন। আর বিরুদ্ধে বেফাঁস কেউ কিছু বললেই পাকিস্তানি সাজিয়ে আসর মাত করেন! আর তাতেও কাজ না হলে ইন্টারনেট পরিষেবাই বন্ধ করে দাও। তথ্যের আদানপ্রদান যেখানে স্তব্ধ, মানুষে মানুষে যোগাযোগ যেখানে ক্ষীণ সেখানে প্রতিবাদ ভাষা খুঁজে পায় না। পোড় খাওয়া শাসকের অস্ত্র তাই মানুষে মানুষে দূরত্ব তৈরি করা। একটা পরিসংখ্যান বলছে, রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে ভারতেই সবচেয়ে বেশি ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করা হয়েছে। কাশ্মীর তার জ্বলন্ত উদাহরণ। কারণটা উপলব্ধি করা সহজ, মোদিজি গোলযোগ বেশি সইতে পারেন না! তাই সংসদে নিজের ঘরে হাজির থাকলেও বহু গুরুত্বপূর্ণ বিতর্ক চলার সময়ও তিনি অধিবেশন কক্ষে প্রবেশ করেন না। যেমন জরুরি অবস্থার ফিকে বসন্তে ইন্দিরাজিও সহ্য করতে পারতেন না। কিন্তু ইতিহাস যে ওসব বোঝে না, ঠিক সময়ে নির্মমভাবে প্রতিশোধ নেয়। ৪৪-৪৫ বছর আগের ইতিহাস খুঁড়ে আজকের শাসক তাঁর এগিয়ে যাওয়ার অক্সিজেন খোঁজেন। একইভাবে মোদিজিরও গৌরবের তুলনায় অগৌরবের পাল্লা ভারী হলে ইতিহাস কিন্তু ক্ষমা করবে না। টাইম ম্যাগাজিন ১০০ প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের যে তালিকা তুলে ধরেছেন তাতে ভারতের প্রাপ্তি তিন। মমতা ও পুনাওয়ালার নাম স্থান পেয়েছে গৌরবের আতিশয্যে। আর মোদিজি অগৌরবেই বিশ্ব সেরাদের মঞ্চে। আজ থেকে দু’দশক বাদে তাঁর শাসনকালও সাংবাদিকদের কাছে জরুরি অবস্থার কলঙ্কের সঙ্গে এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। নোট বাতিল, কাশ্মীরকে সবক শেখানো, অযোধ্যার রামমন্দির নির্মাণ আর হিন্দু রাষ্ট্রের গৌরব সেই কালি মুছে দিতে পারবে তো!