এ রাজ্যে বিজেপির এখন কাছা খুলে যাওয়ার অবস্থা। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ দল বলে নিজেদের দাবি করে গেরুয়া বাহিনী। আরএসএস, ভিএইচপির ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে দল চালান নেতারা। দলীয় শৃঙ্খলার কথা উচ্চগ্রামে প্রচারও করেন। অথচ এরাজ্যে বিজেপির দশা দেখলে সবার করুণা হতেই পারে। এখন আর শুধু আদি বনাম নব্য, ‘ক’ বাবু বনাম ‘খ’ বাবুর ক্ষমতা দখলের লড়াই নয়, বিজেপির অভ্যন্তরে এখন দুই গোষ্ঠীর অনেকেই সমাজবিরোধীর ভূমিকায়। যেখানে গুন্ডামি, মারধরে জখম হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছে দলীয় নেতা কর্মীদের। এসব দেখে রাতদিন কুকথা আর তৃণমূল কংগ্রেসের সমালোচনায় ব্যস্ত দিলীপ ঘোষ, সায়ন্তন বসুদের মতো নেতারাও যেন মুখে রা কাড়তে ভুলে গিয়েছেন! কারণ নেতারাও হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। শাক দিয়ে যেমন মাছ ঢাকা যায় না, তেমনি তৃণমূলের উপর দায় চাপিয়ে আর বিজেপির দলীয় কোন্দলকে আড়াল করা যাচ্ছে না। গত বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলকে হারাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল বিজেপি। শুধু নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ, রাজনাথ সিং, স্মৃতি ইরানিরা নন, মমতার বিরুদ্ধে কুৎসা প্রচারে বিভিন্ন রাজ্য থেকে বিভিন্ন মাপের বিজেপি নেতারা বাংলায় ঘাঁটি গেড়েছিলেন। দেখা গিয়েছে, পালা বদলের আশা জাগিয়ে তৃণমূলে ভাঙন ধরাতে কিছুটা হলেও সক্ষম হয়েছিল গেরুয়া শিবির। দলবদলুদের নিয়ে সংসারও সাজিয়েছেন তাঁরা। আর মূলত তখন থেকেই গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব, খেয়োখেয়ির শুরু। তারপর দিন যত গড়িয়েছে স্রোতের ন্যায় কোন্দলের ঘটনাও আছড়ে পড়েছে। মার্চ, এপ্রিলে মূলত প্রার্থী নির্বাচন নিয়ে দলীয় কোন্দল বিষফোঁড়ার আকার নেয়। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে বহু জায়গায় বিক্ষোভের আগুন জ্বলতে থাকে। পার্টি অফিসে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ কিছুই বাদ যায় না। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দলবদলুদের মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দিতে শুরু করায় খেপে ওঠেন দীর্ঘদিনের আদি পার্টিকর্মীরা। আদি নব্যের লড়াইয়ে বর্ধমানের রিজিওনাল পার্টি অফিসে আউশগ্রাম থেকে আসা লোকজনদের গাড়িও জ্বালিয়ে দেয় নব্য বিজেপি সমর্থকরা। হয় ব্যাপক গণ্ডগোল। চাপে পড়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব উভয়পক্ষের কয়েকজনকে সাসপেন্ড পর্যন্ত করতে বাধ্য হন। এখানেই শেষ নয়। এমন উদাহরণ অজস্র আছে। বিষ্ণুপুরে নির্বাচনের আগে রথ বের করাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক গণ্ডগোলের জেরে দলবদলু এক নেতা জঙ্গলের মধ্যে নেমে যেতেই বাধ্য হন। তিনি অবশ্য এখন শ্রীঘরে। বিজেপিতে আদি-নব্যের যে কোন্দল নির্বাচনের আগে শুরু হয়েছিল সেই ধারা এখনও বজায় আছে। খসে গিয়েছে তাদের শৃঙ্খলাপরায়ণ দলের তকমাটিও। ভোটে গোহারা হয়ে পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যেতেই শুরু দোষারোপের পালা। সেইসঙ্গে চলতে থাকে প্রকাশ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি। যেন তারই সাক্ষী বহন করছে উত্তর হাওড়ার সালকিয়া নন্দীবাগানের ঘটনাটি। যে বিজেপি কথায় কথায় রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কথা বলে থাকে তাদের সাংগঠনিক সভাই হয়ে উঠছে যেন রণক্ষেত্র। এবার নেতাদের সমালোচনা করার অপরাধে নিচুতলা কর্মীদের ফ্যাসিস্ট কায়দায় বেধড়ক মারধর করার অভিযোগও উঠে পড়ল হাওড়ায়। বিজেপির ঘরের কোন্দল এখন রাস্তায় নেমে এসেছে। পরিস্থিতি যা দাঁড়াচ্ছে তাতে হয়তো বিজেপির দলীয় গণ্ডগোল থামাতেই এবার রাজ্য প্রশাসনকে বাড়তি ব্যবস্থা নিতে হবে। বাংলার ভোটাররাও প্রমাদ গুনছেন, ভাগ্যিস এদের হাতে রাজ্য শাসনের ভার পড়েনি!
বাস্তবিক অর্থেই রাজ্য বিজেপিতে এখন দক্ষ নেতৃত্বের অভাব বিশেষভাবে প্রকট। দলীয় কর্মীদের উপর নিয়ন্ত্রণই যেন অনুপস্থিত। ক্ষমতা দখলের নেশায় তৃণমূল থেকে দল ভাঙিয়ে সংগঠন শক্তিশালী করার চেষ্টার ফল কী ভয়ানক হতে পারে তা হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে তারা। এর জন্য অবশ্য সম্পূর্ণভাবেই নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহের মতো কেন্দ্রীয় নেতারাই দায়ী। তাঁরা রাজ্যে দীর্ঘদিন বিজেপি করা নেতাদের উপর ভরসা করতে পারেননি। কেন্দ্রীয় নেতাদের দূরদর্শিতার অভাবের ফল ভুগতে হচ্ছে সাধারণ বিজেপি কর্মীদের। তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যাওয়া অনেকে তাই ফের তৃণমূলে ফিরে বিজেপিকে তুলোধোনা করছেন। তা দেখে ওই ‘লোকদের’ দলে নেওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত ছিল তা নিয়েই শেষপর্যন্ত মুখ খুলতে হয়েছে বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষকে। এখন বিজেপিতে দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের ঘটনা উত্তরোত্তর যেভাবে বাড়ছে তা সামাল দিতে কখনও রাজ্য নেতৃত্বকে দিল্লিতে ডেকে পাঠিয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে বকাঝকা পর্যন্ত দিতে হবে! কখনও-বা গায়ে হাত ওঠার ভয়ে অনেক নেতাই এখন নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন। রাজ্য নেতৃত্বের সামনেই চুঁচুড়াতেও হয়েছে স্লোগান বিক্ষোভ। গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। সেই গোষ্ঠী কোন্দলেরই সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হাওড়া। পরিস্থিতি পরিবর্তনের কোনও লক্ষণই নেই।
আসলে বাংলায় বিজেপি এখন এক ছন্নছাড়া দলে পরিণত হয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ভুলের মাশুল দিতে হচ্ছে কর্মীদের। গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে বিজেপি নামক সর্বভারতীয় দলটি এরাজ্যে অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়লে অবাক হওয়ার নয়।