মোদি সরকারের বিরুদ্ধে কৃষকদের তীব্র ক্ষোভের আঁচ পেয়ে ২০১৮ সালের একেবারে শেষদিকে চালু করা হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী কিষান সম্মান নিধি যোজনা। কেন্দ্রীয় কোষাগার থেকে এক বছরে তিন দফায় একজন কৃষককে মোট ৬ হাজার টাকা দেওয়ার কথা। একাধিক কেন্দ্রীয় প্রকল্পে রাজ্যের প্রাপ্য অর্থ কমিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গে প্রকল্পটি চালু করেননি। ‘দিল্লির দান নেব না’ জানিয়ে রাজ্যের নিজস্ব তহবিল থেকে তিনি এখানে চালু করেন ‘কৃষক বন্ধু’ নামে বিকল্প একটি প্রকল্প। মোদির প্রকল্পের তুলনায় মমতার প্রকল্পটি কৃষকদের জন্য অনেক বেশি উদার। রাজ্যের প্রকল্পে কড়াকড়ি বা সীমাবদ্ধতা অনেক কম। তার ফলে সরকারি আর্থিক সহায়তা অনেক বেশি কৃষকের কাছে পৌঁছবে বলেও রাজ্য সরকার দাবি করে। কৃষক বন্ধু মারফত একজন কৃষক বছরে ন্যূনতম ২ হাজার টাকা এবং সর্বাধিক ৫ হাজার টাকা পেয়ে থাকেন। যেসব কৃষকের এক একর বা তার কম জমি রয়েছে তিনি রবি ও খরিফ মরশুমে ১ হাজার টাকা হিসেবে দু’বারে মোট ২ হাজার টাকা পেয়ে থাকেন। অন্যদিকে, যাঁদের চাষের জমির পরিমাণ দুই একরের মধ্যে তাঁরা প্রতিবার আড়াই হাজার টাকা হিসেবে দু’টি মরশুমে মোট পেয়ে থাকেন সর্বাধিক ৫ হাজার টাকা। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে চাষযোগ্য জমির মালিকদের পাশাপাশি ভাগচাষিরাও কৃষক বন্ধু প্রকল্পের বেনিফিসিয়ারি। এটা এই প্রকল্পের একটা বড় বিশেষত্ব এবং অতিরিক্ত মানবিক দিক। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, তামিলনাড়ু, বিহার প্রভৃতি রাজ্যের থেকে বাংলার কৃষিজোতের চরিত্র আলাদা। এখানে জোতগুলি অনেক ছোট এবং লক্ষ লক্ষ বর্গাদার ও ভাগচাষি। এই বাস্তব দিকটা মাথায় রেখে, কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত সকল গরিব মানুষের কাছেই সরকারি আর্থিক সহায়তাটা পৌঁছে দিতে চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। গত দু’বছর যাবৎ মুখ্যমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে বিশেষ নজর রেখেছেন প্রকল্পটির রূপায়ণের উপর। রাজ্যের কৃষক বন্ধু প্রকল্পের এই হল সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। 
২০১৮-১৯ সালে প্রায় ৩৭ লক্ষ গরিব কৃষক ও ভাগচাষি কৃষক বন্ধু প্রকল্পের দ্বারা উপকৃত হয়েছেন। ওই সালে রাজ্য সরকার এই প্রকল্পে খরচ করেছিল প্রায় ৫৫৮ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ সালে কৃষক বন্ধু প্রকল্পে নাম নথিভুক্ত করে টাকা পেয়েছেন প্রায় ৪২ লক্ষ মানুষ। চলতি বছরে বেনিফিসিয়ারির সংখ্যা প্রায় ৭০ লক্ষ হবে বলে রাজ্য সরকার অনুমান করছে। নানা কারণে এই প্রকল্পে যাঁরা নাম নথিভুক্ত করাননি বা করাতে পারেননি, তাঁরা ‘দুয়ারে সরকার’ কর্মসূচির মাধ্যমে আবেদন জানিয়েছেন। গত ৪০ দিনের এই কর্মসূচি মারফত ২ কোটির বেশি মানুষ নানা ক্ষেত্রে আবেদন করেছেন। সরকার জানিয়েছে, এইভাবে কৃষক বন্ধুর সহায়তা পেয়েছেন প্রায় ৪ লক্ষ কৃষক। সব মিলিয়ে কৃষকদের পাশে রাজ্য সরকার যেভাবে দাঁড়িয়েছে তার তুলনা সারা দেশে নেই বলেই অভিমত সংশ্লিষ্ট মহলের। কৃষকদের উপর সরকারের উৎপীড়ন এবং তাঁদের সঙ্গে দীর্ঘ বঞ্চনার বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই করেই ২০১১ সালে রাইটার্স দখল করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কৃষক বন্ধু প্রকল্পের ঈর্ষণীয় সাফল্য বুঝিয়ে দেয় যে, পরপর দু’বার মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সি দখল করেও তিনি কৃষকদের প্রতি তাঁর অঙ্গীকারের কথা একবর্ণও বিস্মৃত হননি। 
অন্যদিকে, মোদি সরকারের কৃষক-বিরোধী ভূমিকা দেশকে আজ বস্তুত এক বারুদের স্তূপের উপর বসিয়ে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর পার্টি বিজেপি যখন বাংলা দখলে মরিয়া ঠিক তখনই দুই শাসকের এই চরিত্রগত তফাত বেশি করে প্রকট হয়ে পড়েছে। বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডা তাই কি এত নাখোশ? তিনি কি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে বসেছেন? যখন লড়াই হচ্ছে কেন্দ্র আর রাজ্য সরকারের মধ্যে, সেখানে তিনি প্রবেশ করে কেন্দ্রের তরফে ‘রায়’ ঘোষণা করে দিচ্ছেন কোন অধিকারে? প্রধানমন্ত্রী কিষান সম্মান নিধি যোজনার সুবিধা পেতে কেন্দ্রীয় পোর্টালের মাধ্যমে বাংলার পৌনে ২২ লক্ষ কৃষক আবেদন করেছেন। কেন্দ্রীয় সরকার নবান্নকে বলেছিল ওই আবেদনকারীদের তথ্য যাচাই করে দেওয়ার জন্য। সম্প্রতি রাজ্য তা করে দেবে বলে জানাতেই প্রমাদ গুনেছেন নাড্ডা সাহেব। তিনি কাটোয়ার এক জনসভা থেকে প্রকারান্তরে জানিয়ে গেলেন, মমতার সরকারের মাধ্যমে কৃষকদের এই সুবিধা মোদি সরকার দেবে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মানুষকে বাঁচাবার রাজনীতিকে এত ভয়? যে-কথা, ভালো হোক মন্দ হোক, শুধু সরকারই জানাবে, সেই-কথা রাজনীতির মঞ্চ থেকে ঘোষণা করছেন বিজেপি পার্টির সুপ্রিমো! এই ঘটনা দুর্ভাগ্যজনক। এতে একইসঙ্গে সরকার এবং বিজেপির ভাবমূর্তি নষ্ট হল। ক্ষতিগ্রস্ত হল দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি।