সবে ঘোষণা হয়েছে। কবে থেকে তার প্রয়োগ শুরু হবে, তা এখনও অজানা। কিন্তু এর মধ্যেই ভারতীয় সংস্থার তৈরি কোভ্যাকসিন টিকার নিরাপত্তা ও প্রতিষেধক নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ‘আত্মনির্ভর ভারত’-এর দাবিকে কেন্দ্র করে ধোঁয়াশা আর চাপানউতোর শুরু হয়ে গিয়েছে। অভিযোগ, সস্তা প্রচার পেতে আর ‘সাফল্য’ দাবি করতে তড়িঘড়ি কোভ্যাকসিনকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার আগে জনমত তৈরির জন্য তা কোনও আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ করাই প্রথা। কোভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে এই নিয়ম মানা হয়নি। তার চেয়েও বড় কথা, তৃতীয় তথা শেষ ধাপের ট্রায়াল শেষ হওয়ার আগেই একে ছাড়পত্র দেওয়া হল। এই দুই অস্বাভাবিকতা থেকেই মোদি সরকারের ‘অতি তৎপর’ হওয়ার প্রশ্নটি সামনে এসেছে। প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে একই অভিযোগ উঠেছিল লকডাউন ঘোষণাকালেও। কোনও প্রাকপ্রস্তুতি ছাড়াই ২৪ ঘণ্টার নোটিসে দেশে লকডাউন ঘোষণা করে সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। পরিযায়ী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে তাঁর সরকারের অবস্থান নিয়ে গোটা দেশে সমালোচনার ঝড় বয়ে গিয়েছে। এখন আত্মনির্ভর ভারতের জয়গাথা গাইতে গিয়ে সময়ের আগেই ভারতীয় টিকাকে ছাড়পত্র দেওয়া হল কি না সেই প্রশ্নটি জোরালোভাবেই উঠছে। বিজ্ঞানী গবেষকদের আবিষ্কারকে কেন নিজের সরকারের সাফল্য বলে ঢাক পেটানোর চেষ্টা হচ্ছে—সে প্রশ্নও তুলছে অনেকে। প্রশ্ন উঠছে, রাজনৈতিক লাভের জন্যই কি তড়িঘড়ি ছাড়পত্র দেওয়া হল? বিষয়টি যেহেতু জনস্বাস্থ্য বিষয়ক তাই তৃতীয় ট্রায়ালের রিপোর্ট আসার পরই দেশীয় টিকায় ছাড়পত্র দেওয়া হলে এসব প্রশ্ন উঠত না। সেটাই বাঞ্ছনীয় ছিল। তথ্যে ফাঁক থাকলে বিতর্ক হবেই। তাই ফের মোদি সরকার বিতর্কের মুখে পড়ল।
একথা ঠিক কোভিড মোকাবিলার জন্য কবে ভ্যাকসিন আসবে তা জানতে হাপিত্যেশ করে বসেছিল ভারতবাসী। অধীর প্রতীক্ষার অবসান ঘটল। নতুন বছরের শুরুতেই সুখবর মিলল। দেশীয় ভ্যাকসিনে ছাড়পত্র মেলায় দেশের বিজ্ঞানী গবেষকদের এই সাফল্যে গর্বিত আপামর দেশবাসী। কিন্তু স্বস্তিদায়ক এই খবরের পর যাতে ভ্যাকসিনকে ঘিরে জনমানসে কোনওরকম সংশয় দেখা না দেয় বা বিভ্রান্তি না হয় তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। মানুষের জীবনের প্রশ্ন এর সঙ্গে জড়িত বলেই ভ্যাকসিন নিয়ে কোনওরকম রাজনীতি করাও অনুচিত। তা সরকার পক্ষই হোক বা বিরোধী। দুর্ভাগ্য যে, দেশীয় কোভিড টিকার সঙ্গে আত্মনির্ভর ভারতের বিষয়টিকে জুড়ে দেওয়ার কারণেই একটি বিতর্ক হচ্ছে। প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা থেকেই কি দেশীয় ভ্যাকসিনের গায়ে মেড ইন ইন্ডিয়ার তকমা সেঁটে দেওয়ার এই প্রচেষ্টা? খুশির খবর, হাতে এখন দেশে তৈরি জোড়া করোনা ভ্যাকসিন। তবে অক্সফোর্ডের কোভিশিল্ড আর দেশের কোভ্যাকসিনের অনুমোদনের ক্ষেত্রে কেন আলাদা শর্ত রাখা হয়েছিল তার কোনও ব্যাখ্যা সরকারি তরফে দেওয়া হয়নি। কেন? দেওয়া হয়নি কোভ্যাকসিনের কার্যকারিতার হার অর্থাৎ এফিকেসি রেট, যা জানতে আগ্রহী দেশবাসী। এই বিষয়গুলিতে ধোঁয়াশা রয়েছে। মানুষের সংশয় নিরসনের জন্য যে ঘোষণাগুলি দরকার ছিল তা হল—ঠিক কবে কোথা থেকে গণটিকাকরণের কাজ শুরু হবে, কোন রাজ্যকে কত ভ্যাকসিন দেওয়া হবে, ভ্যাকসিনের দাম কত, তা প্রত্যেক ভারতবাসীকে বিনামূল্যে দেওয়া হবে কি না ইত্যাদি। মানুষ এও জানতে চায় স্বদেশি টিকা না অক্সফোর্ড টিকা—কার কার্যকারিতা বেশি। এই বিষয়গুলি অস্পষ্ট রেখে ভ্যাকসিন তৈরির দৌড়ে বিশ্বের প্রথম তিনের মধ্যে ভারতের নাম রাখার প্রচেষ্টা হলে আদৌ কি তা বাঞ্ছনীয়? ভ্যাকসিনকে ঘিরে প্রধানমন্ত্রীর কৃতিত্বকে বড় করে দেখানোর যে চেষ্টা শাসক দলের কোনও কোনও নেতা চালাচ্ছেন তাতে মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে এদেশে ভ্যাকসিন নিয়েও চলবে রাজনৈতিক তরজা। অর্থাৎ ভ্যাকসিনও রাজনীতি মুক্ত হতে পারছে না। আম জনতার মনে হাজারও প্রশ্ন দানা বাঁধছে। বিতর্ক হচ্ছে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্যকে ঘিরে। বলা হচ্ছে, নয়া ব্রিটিশ স্ট্রেইনের বিরুদ্ধে কোভ্যাকসিন প্রয়োজনীয় হতে পারে। প্রশ্ন হল, এক্ষেত্রে ট্রায়াল বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা আদৌ হয়েছে? হলে কাদের উপর প্রয়োগ হল? জবাব মেলেনি। সরকার নীরব।
তাই মহামারী মোকাবিলার জন্য তৈরি ভ্যাকসিন নিয়ে মানুষের মনের সমস্ত সংশয় দূর করতেই হবে সরকারকে। তাড়াহুড়ো করলেই বিপদ। তথ্যে ফাঁক রাখলে সংশয় বাড়বে বই কমবে না। উদ্দেশ্য যখন মহৎ অর্থাৎ করোনার বিপদ থেকে মানুষকে রক্ষা করা, তখন রাখঢাক না করে সবকিছুই প্রকাশ্যে আনা উচিত। সংশয় নিরসনে মানুষের মনে জেগে ওঠা যাবতীয় প্রশ্নের ব্যাখ্যাসহ উত্তর সরকারি তরফে দেওয়াটা ভীষণই জরুরি। কেন্দ্র নিরুত্তর থাকলে সমালোচনা বাড়বে। টিকার ব্যাপারে আম জনতাকে ভরসা জোগানো এই মুহূর্তে সরকারের সবচেয়ে জরুরি কাজ। তাদের মধ্যে বাড়াতে হবে আত্মবিশ্বাস। লুকোছাপা সেই আত্মবিশ্বাসে আঘাত হানবে। তার ফল কখনও ভালো হতে পারে না।