জীববৈচিত্রের জন্য ভারত একটি উল্লেখযোগ্য দেশ। গোরু, মহিষ, ছাগল, কুকুর, বিড়াল, হাঁস, মুরগির মতো অল্প কিছু প্রাণী গৃহপালিত। কিন্তু এর বাইরে জলে, জঙ্গলে আছে আরও কয়েকশো প্রাণী। কিছু নিরীহ, কিছু হিংস্র। মানুষের সংস্রবের বাইরে, প্রাকৃতিক পরিবেশে যেসব প্রাণী রয়েছে ভারতে তাদের সংরক্ষণ করা হয় মূলত তিনভাবে। জাতীয় উদ্যানগুলিতে স্থান পায় ১২০টির বেশি প্রজাতির বন্যপ্রাণী। অভয়ারণ্যগুলিতে ঘুরে ফিরে বেড়াতে পারে পাঁচ শতাধিক প্রজাতির বন্যপ্রাণী। আর বায়োস্ফিয়ার বা জীবমণ্ডলে সংরক্ষিত রয়েছে তাদের ১৮টি প্রজাতি। সবচেয়ে জীববৈচিত্রপূর্ণ এলাকা হিসেবে যতগুলি দেশ চিহ্নিত রয়েছে, তার একটি ভারত। পৃথিবীর সেরা ৩৬টি বায়োডার্ভাসিটি হটস্পটের মধ্যে চারটি ভারতে: পশ্চিমঘাট পর্বতমালা, পূর্ব হিমালয়, ইন্দো-বার্মা এবং সুন্ডাল্যান্ড। পৃথিবীর বৈচিত্রপূর্ণ জীবজগতের প্রায় ৭০ শতাংশ রয়েছে ভারতসহ ১৭টি দেশে। ভারতকে ইন্দোমালয় এলাকার মধ্যে ধরা হয়। সারা পৃথিবীর স্তন্যপায়ী বন্যপ্রাণীদের ৭.৬ শতাংশ, পক্ষীকুলের ১২.৬ শতাংশ এবং সরীসৃপ প্রাণীদের ৬.২ শতাংশ এই অঞ্চলে রয়েছে। হাজার হাজার বছর ধরে পৃথিবীর নানা স্থানের ভূমিভাগ এবং জলবায়ুর বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে। তার ফলে অন্যকিছু অঞ্চলের অনেক প্রাণী ভারতের ভিতরে চলে এসেছে। এটি এই অঞ্চলের জন্য এক আশীর্বাদ। আর বাকি বন্যপ্রাণীরা সুপ্রাচীনকাল থেকেই ভারতভূমির সন্তান বা স্থানীয়। ভারতের আর একটি বড় সম্পদ হল পাঁচ শতাধিক প্রজাতির পরিযায়ী পাখি। এদের সকলকেই রক্ষা করা সভ্যসমাজের দায়িত্ব। বড় দায়িত্ব ভারত রাষ্ট্রের। 
সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই। ছয় শতক আগে বলেছিলেন বাংলার কবি চণ্ডীদাস। চণ্ডীদাস ভুল বলেননি। কিন্তু বক্তব্যের নিহিতার্থ অনুধাবন করিনি আমরা। বাক্যটির আক্ষরিক অর্থ হাতিয়ার করতে চেয়েছি। ‘শ্রেষ্ঠ প্রাণী’র অহমিকায় খুঁজেছি শুধু মানবসমাজের বিকাশের রাস্তা। সংরক্ষণবাদের সুযোগে সংখ্যায় মানুষই সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। ওইসঙ্গে মানুষকে সহায়তা করেছে আধুনিক বিজ্ঞান এবং চিকিৎসাশাস্ত্র। পরিণামে এই পৃথিবী জনবিস্ফোরণের শিকার হয়েছে। খাদ্য এবং বাসস্থানের প্রয়োজনে মানুষ কৃষিজমি এবং বসতজমির পরিধি ক্রমশ বাড়িয়ে নিয়েছে। এই প্রবণতা চলমান। আর এর কোপটা গিয়ে পড়েছে অরণ্য এবং জলাশয় ও জলাজমির উপর। ওইসব অঞ্চল প্রকৃতি যাদের জন্য বরাদ্দ করেছিল, তাদের জীবন বিপন্ন করে তুলেছে সুখের সন্ধানে ফেরা মানুষ। সোজা কথায় স্তন্যপায়ী, সরীসৃপ, পাখি প্রভৃতি বন্যপ্রাণীর জীবন আমরা বিপন্ন করেছি তিলে তিলে। আমাদের অনেকেই বুঝতে চাই না যে পৃথিবীটা শুধু মানুষের বসবাসের জন্য নয়। পৃথিবীটা সব প্রাণী এবং উদ্ভিদের। সবার মাঝেই আমাদের সুখ খুঁজে নিতে হবে। প্রাণী এবং উদ্ভিদের কিছু শ্রেণীকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে আমরা আদৌ সুখে থাকতে পারব না। সবাইকে তাদের মতো করে বাঁচতে দিতে হবে। সব ধরনের প্রাণীর বাঁচার পরিসর রেখে দিতে হবে। অরণ্যকেও রক্ষা করতে হবে ব্যাপকভাবে। তা না-হলে বায়ুদূষণের শিকার হবে গোটা প্রকৃতি। জীববৈচিত্র হারিয়ে গেলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে। 
পৃথিবীকে এই ভয়ানক বিপদ থেকে রক্ষা করতে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ কনজারভেশন অফ নেচার (আইইউসিএন) বিপন্নপ্রায় প্রজাতির প্রাণী এবং উদ্ভিদের তালিকা তৈরি করে লাল রঙে চিহ্নিত করেছে। এইভাবে পৃথিবীর সব রাষ্ট্র এবং মানুষকে সতর্ক করে দিয়েছে তারা, যাতে সেগুলি সংরক্ষণের বিষয়ে আমরা সকলে যত্নবান হতে পারি। রাষ্ট্র হিসেবে ভারতও নিজস্ব বন্যপ্রাণী আইন, বন সংরক্ষণ আইন, জলাজমি সংরক্ষণ আইন প্রভৃতি প্রণয়ন করেছে। আইনগুলি প্রয়োগেরও পরিকাঠামো গড়া হয়েছে। দুর্ভাগ্য যে, তার পরেও কিছু মানুষ এসবের পরোয়া করছে না। বহু বন্যপ্রাণীর দিকে হাত বাড়াচ্ছে। কখনও খা঩঩দ্যের প্রয়োজনে, কখনও-বা নিছক আনন্দ-উৎসবে মেতে ওঠার জন্য। আর মারাত্মক প্রবণতা রয়েছে বিপুল অর্থ উপার্জনের লক্ষ্যে চোরা শিকার। সম্প্রতি প্রকাশিত একটি বেসরকারি সংস্থার সমীক্ষা রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, লকডাউন পিরিয়ডে ভারত-সহ অনেক দেশে বন্যপ্রাণী শিকার বেড়ে গিয়েছে। এই তথ্য বলে দিচ্ছে, প্রশাসনের নজরদারি কমে গিয়েছে। লকডাউনের অজুহাতেও এই গাফিলতি মানা যায় না। আইনরক্ষকদের এই শিথিল মনোভাবকে দুর্বৃত্তরা দুর্বলতা হিসেবে গণ্য করবে। দীর্ঘমেয়াদে এর পরিণাম খারাপ হতে পারে। সারা দেশের প্রশাসনকে এই ব্যাপারে ফের কঠোর ভূমিকা নিতে হবে। আমরা যদি নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠজীব বলে মনে করি, তবে আমাদের আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাস্তবটিকে স্বীকার করেও বলতে হয় যে বন্যপ্রাণীদের যথেচ্ছ নিধন শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় বহন করে না। জীববৈচিত্র রক্ষার দায়িত্বপালনের মধ্য দিয়েই মানুষকে শ্রেষ্ঠত্বের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে।