বিদ্যায় অধিক পরিশ্রম করতে হবে। ব্যবসায় যুক্ত ব্যক্তির পক্ষে দিনটি শুভ। প্রেম-প্রীতিতে আগ্রহ বাড়বে। নতুন ... বিশদ
নিজের টাকায় বই কিনে পাঠকের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিয়ে বই পড়ার একটি আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য পলান সরকার ২০১১ সালে একুশে পদক পান। ২০০৭ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁর বাড়ির আঙিনায় একটি পাঠাগার করে দিয়েছে। তাঁকে নিয়ে বাংলাদেশ একটি নাটক নির্মাণ হয়েছে। ২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম ডে’ উপলক্ষে বিশ্বের ভিন্ন ভাষার প্রধান প্রধান দৈনিকে একযোগে পলান সরকারের বই পড়ার এই আন্দোলনের গল্প ছাপা হয়। গোটা পৃথিবীর ৪০টি প্রধান দৈনিকে লেখাটি ছাপা হয়। এই দিবসে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকার ক্রোড়পত্র হাতে নিয়ে তোলা সেলফি আসে সারা বিশ্ব থেকে। তবে বাংলাদেশের দৈনিক প্রথম আলোর ক্রোড়পত্রটি হাতে নিয়ে তোলা সেলফির সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি। যেখানে পলান সরকারই ছিলেন ক্রোড়পত্রটির মুখ। যিনি রাজশাহির বাউসা ইউনিয়নের বেণুপুর, হরিপুর, দীঘা, হাটপাড়া, পূর্বপাড়া, সরকারপাড়া, মাঠপাড়া, ঠাকুরপাড়াসহ ১২টি গ্রামে পরিচিত ছিলেন ‘বইওয়ালা দাদু’ নামেই।
জন্ম ১৯২১ সালে। তাঁর আসল নাম হারেজউদ্দিন। তবে পলান সরকার নামেই তাঁকে চেনে দশ গ্রামের মানুষ। জন্মের মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় তাঁর বাবা মারা যান। টাকাপয়সার টানাটানির কারণে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময়ই পড়াশোনায় ইতি টানতে হয় তাঁকে। তবে নিজের চেষ্টাতেই চালিয়ে যান পড়ালেখা। একটা সময় যাত্রায় অভিনয় করেছেন। যাত্রার পাণ্ডুলিপি লেখার কাজটা অনেক সময় করতে হতো তাঁকেই। অভিনয়, পাণ্ডুলিপি রচনার পাশাপাশি একসময় পিছন থেকে সংলাপ বলে দেওয়ার কাজটাও নিতে হলো পলান সরকারকে পাকাপাকিভাবে। পাণ্ডুলিপি পড়ে সংলাপগুলো টানা বলে যাওয়া। এটাই ছিল তাঁর কাজ। এই ‘প্রম্পট’ করার কাজ করতে গিয়েই বই পড়ার নেশাটা আরও পেয়ে বসে তাঁকে। একসময় ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রসারের কারণে গ্রামাঞ্চলে যাত্রাপালা অনুষ্ঠান অনেকটাই কমে যায়। কিন্তু থেকে যায় পলান সরকারের বই পড়ার নেশা। স্থানীয় একটি উচ্চবিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি ছিলেন। তিনি ছিলেন বইপাগল মানুষ। প্রতিবছর স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যারা ১ থেকে ১০-এর মধ্যে মেধাতালিকায় স্থান পাবে, তাদের তিনি একটি করে বই উপহার দিতেন। এখান থেকেই শুরু হয় তাঁর বই বিলির অভিযান। এরপরে তিনি সবাইকে বই দিতেন। ডাক্তারি পরীক্ষায় ডায়াবেটিস ধরা পড়ার পর নিজেই হেঁটে হেঁটে বই বিলি করতেন। একটানা ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে করেছেন এই কাজ। রাজশাহি অঞ্চলের বেশ কয়েকটি গ্রামে তিনি গড়ে তুলেছেন বই পড়ার এক অভিনব আন্দোলন।
গুছিয়ে কথা বলতে পারতেন। কথা বলে মানুষকে হাসাতে পারতেন। কাঁদাতেও পারতেন। তাঁর বই পড়ার আন্দোলন সম্পর্কে ২০১৬ সালের নভেম্বরে এক সাক্ষাৎকারে পলান সরকার বলেছিলেন, ‘আমি হাঁটতে হাঁটতে এই সমাজটাকে বদলানোর আন্দোলনে নেমেছি। যত দিন আমি হাঁটতে পারি, তত দিন আমার আন্দোলন চলবেই। আমি হাঁটতে হাঁটতে মানুষের বাড়িতে বই পৌঁছে দেবই। যাঁরা পাঠাগারে আসবেন, তাঁরা ইচ্ছেমতো বই পড়বেন। তবে আমার বয়স হয়েছে। জানি না আর কত দিন হাঁটতে পারব। যেদিন আমার পথচলা থেমে যাবে, সেদিন এই পাঠাগার আমার পক্ষে আন্দোলন করে যাবে।’ শুক্রবার দুপুরে সত্যিই থেমে গেল সেই পথচলা। বই বিলি করতে পলান সরকার আর কারও বাড়ির দরজায় টোকা দেবেন না। ৯৮ বছর বয়সে নিজের বাড়িতে মারা যান এই ‘আলোর ফেরিওয়ালা’। গ্রামের মানুষের মধ্যে ‘আলো’ বিলিয়ে দিতেই তিনি হেঁটেছেন মাইলের পর মাইল।