আবেগের বশে কোনও কাজ না করাই ভালো। দাম্পত্য জীবনে বনিবনার অভাবে সংসারে অশান্তি বাড়বে। কর্মে ... বিশদ
উৎপল দত্ত সেকথা শুনে হো হো করে হেসে উঠে বলেছিলেন, ‘তুই পারবি। দেখে নিস। আমি যেভাবে শেখাব, সেইভাবে শিখবি। যেভাবে উচ্চারণ করব, সেইভাবে করবি। তুই ইংরেজি জানিস না বলেই তার ভুল উচ্চারণটা শিখিস নি। যারা ইংরেজি জানে, তাদের বেশিরভাগই ভুল উচ্চারণ করে।’ এর পর শুরু হল রিহার্সাল। উৎপল দত্ত যেভাবে উচ্চারণ করতেন, সেগুলি গোপনে টেপরেকর্ডারে তুলে নিয়ে গিয়ে বাড়িতে শুনে শুনে উচ্চারণ করতেন আর মুখস্ত করতেন। এভাবেই তিনি অভিনয় করে মঞ্চ কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর অভিনয় দেখে নাকি অনেকে বলেছিলেন, আপনি এত ভালো ইংরেজি জানেন!
বর্ণালী অভিনয় শুরু করেছিলেন সেই ছোট্ট বয়সে। না, শখ করে নয়। সংসারের অভাব মেটাতে। বাবা ছিলেন পুরোহিত। মাঝে মাঝে অ্যামেচার দলে অভিনয় করতেন বর্ণালী। কখনও জুটত পাঁচ টাকা, কখনও বা সাত টাকা। তাই দিয়ে সংসারের ছেঁড়াফাটা দিকগুলোয় তাপ্পি মারার আপ্রাণ চেষ্টা চলত। তখন তাঁর ডাকনাম ছিল বেণু। পারিবারিক পদবী তাঁদের চক্রবর্তী। যাত্রাদলের কর্নেটবাদক খোকা মল্লিক ছিলেন তাঁর বাবার পরিচিত। তিনি তরুণ অপেরায় তখন ক্ল্যারিওনেট বাজাতেন। সেই সূত্রে একদিন তিনি এসে তাঁর বাবাকে বললেন, ‘তরুণ অপেরায় ‘সোনাই দীঘি’ হবে। ওরা সোনাই চরিত্রের জন্য একটা নতুন মেয়ে খুঁজছে। আমি ভাবছিলাম বেণুকে একবার ওদের ওখানে নিয়ে যাব।’ সংসারের অভাব মেটাতে বেণু নদীয়ার দাদুপুর থেকে চলে এলেন কলকাতায়। নির্বাচিত হলেন। তখন তাঁর বয়স কতই বা হবে, ১৬ কী ১৭। নাম হল তাঁর বর্ণালী বন্দ্যোপাধ্যায়। অপেরা মালিক চক্রবর্তী পদবী বদলে করে দিলেন বন্দ্যোপাধ্যায়। সে বছর তরুণ অপেরায় ছিলেন ফণীভূষণ বিদ্যাবিনোদ, দিলীপ চট্টোপাধ্যায়, শান্তিগোপাল প্রমুখ। সবাই তাঁকে আপন করে নিলেন। স্বভাবের জন্য আর তাঁর শেখার অদম্য বাসনা দেখে। বড় ফণী বলতেন, ‘মাথা তুলে দর্শকদের দিকে তাকিয়ে কথা বল। অভিনয়ের সময় কোনও জড়তা রাখবি না।’ পরে উৎপল দত্ত যখন নাট্যশিক্ষক হলেন তখন বলতেন, ‘জোরে বল, সবাই যাতে শুনতে পায়, হাতের ব্যবহার ঠিকমতো কর। চলাটাও চরিত্রের মতো করে তুলতে হবে।’
বর্ণালী বললেন, ‘এইসব মানুষের কাছে কত কী শিখেছি। বুঝেছি কষ্ট করে শিখলে কিছুই বৃথা যায় না।’
পেট ভরে ভাত খেতে পাবে বলে যে মেয়েটিকে একদিন তাঁর বাবা বলেছিলেন, ‘যা বেণু কলকাতায় গিয়ে অভিনয় কর, ওখানে অন্তত পেট ভরে খেতে পাবি’, সেই মেয়েটিই আরও অনেক কিছু করে ফেললেন। অভিনয়ে তিনি একটু একটু করে বিখ্যাত হয়ে উঠতে লাগলেন।
তরুণ অপেরা থেকে লোকনাট্য। নাট্যশিক্ষক হিসাবে পেলেন উৎপল দত্তকে। তিনি মনের মতো করে গড়ে নিলেন বর্ণালীকে। বর্ণালী বললেন, ‘উনি অভিনেতা–অভিনেত্রীদের মানসিকতা খুব ভালো বুঝতেন। হয়তো অনেকক্ষণ রিহার্সাল হয়েছে। সবাই ঠিক মন দিতে পারছেন না। উনি রিহার্সাল কিছুক্ষণ বন্ধ রেখে হাসি-তামাশা করতেন। নিজের জীবনের মজার সব ঘটনা বলতেন। যেমন সিরিয়াস ছিলেন, তেমনই ছিলেন মজার মানুষ।’
একসময় যেমন শান্তিগোপাল-বর্ণালী জুটি হয়েছিলেন, হিটলার, লেনিন, নেপোলিয়ন, আমি সুভাষ, রাজা রামমোহন। ইতিহাস সৃষ্টিকারী সব পালা। এরপর তৈরি হল নতুন জুটি। শেখর গঙ্গোপাধ্যায় এবং বর্ণালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের জুটি। তাঁদের অভিনীত ‘সন্ন্যাসীর তরবারি’, ‘জানোয়ার’, ‘ভীষ্মজননী গঙ্গা’, ‘পাণ্ডবজননী কুন্তী’ প্রভৃতি পালা আজও ইতিহাস হয়ে আছে।
অভিনয়ের পাশাপাশি চলছিল মন দেওয়া নেওয়ার পালা। তরুণ অপেরায় থাকতেই যাত্রার নামকরা অভিনেতা অনুপকুমারের সঙ্গে গড়ে উঠল প্রণয়ের সম্পর্ক। প্রেম গড়াল আসর থেকে বাসরে। কিন্তু কিছুদিন পরই কী যে হল, অন্য প্রেম এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেল আগের প্রেমকে। সে ছিল এক অশান্তির সময়। একদিকে পালায় অভিনয়, অন্যদিকে ব্যক্তিগত জীবনের অশান্তি। মন একেবারে ভেসে গেল। নতুন জীবনসঙ্গী হিসাবে বেছে নিলেন আর এক যাত্রা অভিনেতা খোকন বন্দ্যোপাধ্যায়কে। মা হলেন। তারপরে এক ভয়ঙ্কর ক্লাইম্যাক্স! খোকন পৃথিবীর মঞ্চ ছেড়ে বিদায় নিলেন। সে এক লড়াইয়ের সময়। অভিনয়, নাকি মেয়েকে মানুষ করা? বর্ণালী বেছে নিলেন পারিবারিক জীবন। অভিনয় ছেড়ে মেয়েকে মানুষ করার কাজে লেগে পড়লেন।
বর্ণালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বহু পালায় অভিনয় করেছিলেন রুনু অধিকারী। তাঁর কথায়, ’বর্ণালীদি যত বড় অভিনেত্রী, তত বড় মনের মানুষ। কোনও অহঙ্কার ছিল না। আমি ছিলাম তখন শিশু অভিনেতা। তখন আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছেন।’
সে ছিল এক মজার কাহিনী। জানোয়ার পালার ঈশিতা চরিত্রে ছিলেন বর্ণালী। সে পালায় তাঁর একটি সিগারেট খাওয়ার দৃশ্য ছিল। জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে তিনি মঞ্চে উঠতেন। দু’এক টান দিতেন। তারপর নেমে আসতেন। একবার প্রস্থানের সময়, দর্শকদের মধ্য থেকে দুটো ছেলে চিৎকার করে বলল, ‘দিদি সিগারেটটা দিয়ে যান।’ প্রস্থান পথেই পাশেই তারা বসেছিল। তাদের হাতে জ্বলন্ত সিগারেটটা দিয়ে গ্রিনরুমে চলে গেলেন। তাদের সে কী আনন্দ! যেন লটারির টিকিট পেয়েছে। বললেন, ‘বেশ ভালো লেগেছিল ব্যাপারটা। আর একবার সীমান্ত পালায় আমার মদ্যপানের দৃশ্য ছিল। আমি বলতাম, দাও দাও আমাকে আরও মদ দাও। সামনের দিকে এক দর্শক নেশা করে আসরে এসেছিলেন। তিনি বারবার চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন, আমিও খাব, আমাকে দাও। সবাই তাকে ধমক দিলেও সে শুনছিল না। একটু ডিসটার্ব হচ্ছিল। আমার সহ অভিনেতা ছিলেন অনাদি চক্রবর্তী। তিনি অভিনয় থামিয়ে তাঁকে বললেন, এখন চুপ করে বসুন। পালা শেষ হলে আপনাকে দেব। এরকম অসংখ্য ঘটনা জড়িয়ে আছে প্রতিটি রাতের অভিনয়ে।’
আজ অবসর জীবনের মাঝে হঠাৎ করে মনের মধ্যে ভেসে ওঠে এক টুকরো সংলাপ। স্বপ্নে ফিরে আসে হারানো কোনও চরিত্র। কোনও ঘটনা। সেই লরির ওপর চেপে এক আসর থেকে অন্য আসরে যাওয়া। তখন বাস আর কোথায়! কত কষ্ট ছিল। তবু ছিল কত আনন্দ! মনে হয়, শরীরটা উপযোগী থাকলে অভিনয় করা যেত। বরানগরের বাড়িতে বসে পুরনো দিনের কথা বলছিলেন বর্ণালী দেবী। দেহ-পট সনে নট সকলি হারায়। একদিন সমস্ত মঞ্চজুড়ে যে মেয়েটি তীব্র আবেগে অভিনয় করতেন। দর্শকদের কত হাততালি আর মুগ্ধতার মধ্য দিয়ে মঞ্চে ঢুকতেন, বেরতেন। ‘মুক্তিদীক্ষা’ পালায় প্যারিসের গেরিলা নেত্রী ক্লোদেৎ, ‘সন্ন্যাসীর তরবারি’ পালায় দেবী চৌধুরানি, ‘ঝড়’এ এমিলিয়া, ‘তুরুপের তাস’এ মিত্রা সালগাঁওকর। অসংখ্য চরিত্র বহু মানুষের স্মৃতিতে আজও অম্লান। তাঁরও স্মৃতিজুড়ে ভেসে থাকে হারানো অ্যালবাম। বয়স এখন তাঁর শরীরকে স্লথ করেছে। ঘর ভরতি ফ্রেমজুড়ে অভিনয়ের ছবি আর পোস্টার। হারানো স্মৃতির ভিতর একা একা ডুবে যান। যেন বলতে চান, ‘যেতে নাহি দিব।’ তবু যেতে দিতে হয়।