আবেগের বশে কোনও কাজ না করাই ভালো। দাম্পত্য জীবনে বনিবনার অভাবে সংসারে অশান্তি বাড়বে। কর্মে ... বিশদ
শিল্পীতীর্থের ‘বৈজু-বাওরা’ পালার গানের রিহার্সাল চলছে। সেই পালার সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন মান্না দে। তিনি গান তোলাচ্ছেন অভিনেত্রী জ্যোৎস্না দত্তকে। অসাধারণ গানের গলা ছিল জ্যোৎস্না দত্তের। তিনি সেই গানকে তুলে নিয়ে গেলেন অসাধারণ এক উচ্চতায়। হারমোনিয়াম ছেড়ে মান্না দে বসে বসে সেই গান শুনলেন। তারপরে বললেন, ‘জ্যোৎস্না তোমার গলা যে পর্দা ছুঁয়ে ফেলছে, আমার হারমোনিয়াম সেখানে রিড খুঁজে পাচ্ছে না। তুমি হারমোনিয়ামকেও হারিয়ে দিয়েছ।’
তিনি শুধু সঙ্গীতেই অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী ছিলেন না, ছিলেন অনেক বড় মাপের অভিনেত্রীও। একেবারে ফ্রক পরা বয়সে ঢুকেছিলেন যাত্রাদলে। স্বাধীনতার পরের বছরে বরিশালে জন্ম। তাঁকে যাত্রাদলে এনেছিলেন ঢোলবাদক যোগেশ নট্ট। অভিনয়ের আবহের মধ্যে মিশে তিনি বড় হয়েছেন। তাঁর শ্বাস প্রশ্বাসের মধ্যে মিশে গিয়েছিল অভিনয়, জীবনে জীবন যোগ করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন যাত্রাসম্রাজ্ঞী।
কিশোরী বয়সে নায়িকা চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেলেন। তাও এল এক আকস্মিক ঘটনার মধ্য দিয়ে। চণ্ডী অপেরা, জ্যোতিষ অপেরা, মুক্তকেশী অপেরা ঘুরে ততদিনে তিনি এসেছেন সত্যম্বর অপেরায়। প্রথম বড় দল। সেখানেও তিনি সখির দলে নাচ করতেন। সেদিন সিয়ারশোল রাজিবাড়িতে বসেছে গানের আসর। পালার অন্যতম নারী চরিত্রের অভিনেতা নন্দরানী (নন্দদুলাল অধিকারী) সেদিন সময়মতো আসরে এসে পৌঁছতে পারেননি। তিনি শেফালি চরিত্রে অভিনয় করতেন। দলমালিক বিপাকে পড়ে কিশোরী জ্যোৎস্নার হাতে চার আনা পয়সা দিয়ে বললেন, ‘শোন, আজকে তোকে শেফালি চরিত্রটি করতে হবে’। জ্যোৎস্না রোজ বসে বসে দেখতেন, কে কেমন অভিনয় করেন। সব সংলাপ তাঁর মুখস্থ। অবাক হয়ে দেখতেন, কী অসম্ভব দক্ষতায় ছেলেরা মঞ্চে গিয়ে মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করেন। মনে মনে ভাবতেন, সুযোগ পেলেও আমি হয়তো কখনও ওইরকম অভিনয় করতে পারব না। সেই সুযোগ এসে গেল। গুরুপদ ঘোষ ছিলেন তাঁর বিপরীতে। তিনি শুধু বললেন, ‘যা বলবি জোরে জোরে বলবি। সবাই যাতে শুনতে পায়।’ সবাই চেয়েছিলেন সেদিনের মতো যাতে কাজটুকু উৎরে যায়। কিন্তু মঞ্চে যখন জ্যোৎস্না অভিনয় করলেন, দলের সকলেই অবাক হয়ে গেলেন। তাঁর ভিতরের সুপ্ত প্রতিভাকে চিনতে পারলেন। নন্দরাণী ফিরে আসার পর এই খবর পেয়ে বললেন, ‘খুব ভালো। জ্যোৎস্না তুই অনেক বড় হবি।’ আর তিনি দলমালিককে বললেন, ‘আমাকে অন্য চরিত্র দিন। এই চরিত্রটা জ্যোৎস্নাই করুক।’ সকলের অজান্তেই শুরু হল এক নায়িকার পথচলা। পরের বছর নায়িকা চরিত্র পেলেন। নারীর ভূমিকায় নারী। যাত্রায় হয়তো এই প্রথম নয়। কিন্তু জ্যোৎস্নার পথের রেখা ধরে যাত্রাদলে খুলে গিয়েছিল, নারীর ভূমিকায় একজন নারীর অভিনয়ের পথ। সেও ছিল এক নিঃশব্দ বিপ্লব।
পরের বছর ‘ছিন্নশির’ পালায় নায়িকা কাঁকনবাঈয়ের ভূমিকায়। ক্রমে ক্রমে নদী এগিয়ে চলল সাগরের দিকে। যাত্রায় একদিন আলোড়ন ফেলে দিল ব্রজেন্দ্রনাথ দের সোনাই দীঘি পালা। সোনাইয়ের চরিত্রে জ্যোৎস্না দত্তের গান ও অভিনয় সাড়া ফেলে দিল। বছরের পর বছর মানুষ আত্মহারা হয়ে একই পালা দেখতে লাগলেন। আসরে স্থান দেওয়া যাচ্ছে না। মানুষের ঢল নেমেছে সোনাই দীঘি পালা দেখতে। একই আসরে পরপর তিন-চার রাত্রি একই পালার অভিনয় হচ্ছে। যাত্রার ইতিহাসে অমর হয়ে রইল সোনাই দীঘি। অমর হয়ে রইলেন জ্যোৎস্না দত্ত। একবার এইচএমভি সোনাই দীঘি পালার লং প্লেয়িং রেকর্ড বের করার পরিকল্পনা নেয়। তারা সোনাই চরিত্রে অন্য কোনও শিল্পীকে নেওয়ার ভাবনাচিন্তা করেন। সেকথা শুনে ব্রজেন দে বলেছিলেন, ‘সোনাই চরিত্রে জ্যোৎস্না ছাড়া অন্য কেউ করলে আমি অনুমতি দেব না।’
দীর্ঘ অভিনয় জীবনের মধ্যে পেয়েছেন বহু আঘাতও। সম্পর্কের ভাঙাগড়ায়, প্রেমের অবমাননায় মন বিক্ষুব্ধ হয়েছে। কিন্তু মঞ্চে যখন উঠেছেন তখন তিনি এক অনন্য সাম্রাজ্ঞী। দর্শকরা তাঁর সামনে নতশির। সত্যম্বর অপেরা, নবরঞ্জন অপেরা, নট্ট কোম্পানি, শিল্পীতীর্থে তাঁর বহু পালা মানুষের মন জয় করেছে। তাঁর সুপারহিট পালাগুলির মধ্যে আছে বন্দির ছেলে, পাষাণের মেয়ে, নটী লক্ষহীরা, বিবি আনন্দময়ী, নটী বিনোদিনী, কবি, মাদার ইন্ডিয়া, বিনয়-বাদল-দীনেশ প্রভৃতি।
স্বপনকুমারের সঙ্গে অভিনয় করেন মাইকেল মধুসূদন পালায়। স্বপনকুমার মাইকেল এবং তিনি দেবকীর চরিত্রে। যখন সেই পালায় মঞ্চে উঠে জ্যোৎস্না গাইতেন, ‘কেন হেরেছিলেম তারে..’ মানুষ অবাক হয়ে যেতেন। সহ অভিনেতাদের মধ্যে পেয়েছিলেন ফণিভূষণ বিদ্যাবিনোদ, মহেন্দ্র গুপ্ত, তপনকুমার, মোহিত বিশ্বাস, দিলীপ চট্টোপাধ্যায়, অসীমকুমার, গুরুদাস ধাড়া প্রমুখ অভিনেতাকে। গুরুদাস ধাড়ার সঙ্গে মঞ্চে এবং ব্যক্তিগত জীবনেও জুটি বেঁধেছিলেন।
জ্যোৎস্না দত্তের আর একটি ক্ষমতা ছিল। অনেকসময় তিনি পার্ট মুখস্থ না করেও শুধু প্রম্পট শুনে অভিনয় করতে পারতেন। পরের দিকে যখন যাত্রার আসর থেকে প্রম্পটার পদটিই ধীরে ধীরে বিদায় নিতে শুরু করল, তখনও তিনি ব্যক্তিগত প্রম্পটার নিয়ে অভিনয় করতেন। এমনও হয়েছে, প্রম্পটার হাতে টর্চ নিয়ে গ্রামবাংলায় স্টেজের নীচে বসে প্রম্পট করতেন। শোনা যায়, রিহার্সালের আগে তিনি নিজে পার্ট পড়তেন না। তাঁর পার্ট একজন পড়ে দিতেন এবং তিনি শুনে শুনে পার্ট মুখস্থ করতেন। ১৯৮৫ সালে নিজেই তৈরি করেছিলেন গীতাঞ্জলি অপেরা। প্রথম বছরের পালা আলতারাঙা পা বিশেষ বাণিজ্য সফল হয়নি। পরের বছর অর্থাৎ ’৮৬ সালে তিনি অভিনয় করেন সুনীল চৌধুরির মুচি মায়ের শুচি ছেলে। ভক্ত রুইদাসের জীবনী নিয়ে নাটক। সেই পালায় জ্যোৎস্না করেছিলেন রুইদাসের মায়ের চরিত্র। সেই পালার রিহার্সালের একটি অভিজ্ঞতার কথা শুনেছি নাট্যকার ও নির্দেশক সুনীল চৌধুরীর মুখে। সেদিন সুনীলবাবু সকলকে পালার পার্ট বিতরণ করছিলেন। একে একে সকলকে দিয়ে যখন তিনি জ্যোৎস্না দত্তকে পার্টের খাতা দেন, তখন তিনি সুনীলবাবুকে প্রণাম করতে যান। আপত্তি জানিয়ে সুনীলবাবু বলেন, ‘আমি আপনার থেকে অনেক ছোট। আমাকে প্রণাম করবেন না।’ তখন জ্যোৎস্না দত্ত বলেন, ‘আপনি এই পালার নির্দেশক। মানে নাট্যশিক্ষক। এখানে বড়ছোটর কোনও প্রশ্ন নেই। শিক্ষক সবসময় প্রণম্য। তুলসীপাতা কিংবা শালগ্রাম শিলার আবার ছোটবড় হয় নাকি!’ কিন্তু সব সুনাম, সব খ্যাতি, অর্থ একদিন খসে পড়ল পদ্মপাতার জলের মতো। শেষের দিকে গ্ল্যামার গেল, সংলাপ মনে রাখতে পারতেন না। কোনও দলই তাঁকে নিতে চাইত না। তিনি সবাইকে শুধু বলতেন, ‘আমাকে একটা কাজ দেবে।’ গুরুদাস ধাড়া মারা গিয়েছেন। অসহায় অবস্থা তাঁর। সেই সময় যাত্রাভিনেতা অসীমকুমার কয়েক মাস তাঁর কাছে রেখেছিলেন। সেইরকম এক সময়ে এই প্রতিবেদক হেদুয়ার কাছে তাঁর বাড়িতে সাক্ষাতের জন্য গিয়েছিল। নিজের ভাগ্য আর দুরবস্থার কথা বলে তিনি সেদিন হাউহাউ করে কেঁদে বলেছিলেন, ‘আমার আজ কিচ্ছু নেই। আমি শূন্য, আমি শূন্য।’ এ কোনও যাত্রাপালার সংলাপ বা অভিনয়ের কান্না ছিল না। খ্যাতি এবং বিত্তের চূড়া থেকে অতল খাদে পড়ে যাওয়া এক তাপিত হৃদয়ের প্রকৃত কান্না। নিঃশব্দে উঠে চলে এসেছিলাম।