আবেগের বশে কোনও কাজ না করাই ভালো। দাম্পত্য জীবনে বনিবনার অভাবে সংসারে অশান্তি বাড়বে। কর্মে ... বিশদ
জঙ্গল ভ্রমণে বেরনোর সময় সবাই বেশ কাহিল ছিলাম, কারণ প্রায় ৪৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা আর রোদের তাপ সাংঘাতিক। সানস্ক্রিন মেখে, চোখ ছাড়া বাকি মাথা, মুখ ঢেকে চড়ে বসেছি জিপসিতে। আমাদের অনলাইন পারমিট অনুযায়ী, মোহারলি গেট ধরে আমাদের এগতে হবে। গেটের বাইরে বন বিভাগের অফিস থেকে রুট নম্বর নিয়ে আমাদের গাড়িতে গাইড উঠলেন। চট জলদি ড্রাইভারের সঙ্গে রুট ছকে নিলেন তিনি। তবে বললেন যে পরিস্থিতি অনুযায়ী অদলবদল হতেও পারে। যদিও শীতকাল জঙ্গল দেখার ভালো সময়, অভিজ্ঞ প্রকৃতি-প্রেমিকরা বলেন গরমকালে গেলে বাঘের দেখা পাওয়ার সুযোগ বেশি। কারণ জলের সন্ধানে তারা বেরিয়ে পড়ে, খুঁজে নেয় ওয়াটার হোল। আর তাড়োবার মতো জঙ্গলে রাস্তার পাশে বা কাছেই আছে একাধিক ওয়াটার হোল। তাই বছর বছর ধরে বাড়ছে পর্যটকের সংখ্যা যাদের বেশির ভাগ আসছেন বাঘ দেখতে আর ছবি তুলতে। প্রকৃতি বা অন্যান্য পশু জগৎ গৌণ।
বাঘ দেখার আনন্দে গাড়ির ছয় সওয়ারি আমরা বেশ খুশি। মনে হচ্ছে যেন গরম বোধটাও আর হচ্ছে না। রাস্তা ধরে যেতে যেতে পিলার মতো দেখতে পেলাম। এক সময় নাকি গোণ্ড উপজাতি এখানে বাস করতেন। তারাই এই পিলারগুলো বসায়। কেউ বলে উপজাতি রাজার লোকলস্কর সহ যাতায়াতের সুবিধার জন্যে এর ওপর নাকি আলো জ্বালানো হতো, কেউ বলেন পিলারে বাঁধা ঘণ্টার সাহায্যে খবর পৌঁছনো ছিল উদ্দেশ্য। এখন বন দপ্তরের নানা বাণী নিয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে প্রাচীন পাথুরে পিলার। যেতে যেতে অবাক হয়ে দেখছি জঙ্গলের রূপ —কোথাও হলুদ, কোথাও ধূসর। এর মধ্যে প্রায়ই দেখা দিচ্ছিল ময়ূর আর চিতল হরিণের দল। জঙ্গলের সঙ্গে প্রায় মিশে থাকা এক সম্বর পরিবারের দেখাও পেলাম। সামনে দাঁড়ানো ডালপালার মতো শিংওলা পুরুষ, পেছনে একাধিক স্ত্রী-সম্বর।
ইতিমধ্যে গাইড জানালেন ৬০০ বর্গ কিলোমিটারের কিছু বেশি এলাকা জুড়ে তাড়োবা-আন্ধারি ব্যাঘ্র প্রকল্প, যার মধ্যে রয়েছে তাড়োবা ন্যাশনাল পার্ক এবং আন্ধারি ওয়াইল্ডলাইফ স্যাংচুয়ারি। শুষ্ক পর্ণমোচী জঙ্গলে সেগুন গাছের আধিক্য। তাছাড়াও আছে আইন, বিজা, তেন্দু, হলদু, বহেড়া, মহুয়া, বাঁশ ইত্যাদি। জন্তু-জানোয়ারের মধ্যে বাঘ ছাড়াও রয়েছে লেপার্ড, ভল্লুক, গাউর, নীলগাই, ঢোল বা জংলি কুকুর, সম্বর, চিতল, বার্কিং ডিয়ার, ইত্যাদি। পাখিও আছে বহু প্রজাতির। কোথাও কোথাও জলের ব্যবস্থা করা হয়েছে জঙ্গলের প্রাণীদের জন্য। সিমেন্টের বাঁধানো চৌবাচ্চা - সেখানে হরিণ থেকে গাউর থেকে ক্রেস্টেড, সার্পেন্ট ঈগল থেকে হনুমান, অনেককেই দেখলাম গলা ভিজিয়ে নিচ্ছে। ইতিমধ্যে সাফারির সময় শেষ। ঘরমুখো পথ ধরল জিপসি। পরদিন ভোরবেলা বেরিয়ে ইতিউতি ঘুরে তেলিয়া লেকের পারে হাজির হলাম। পৌঁছে দেখি জিপসির মেলা। বিশাল লেকের এক ধারে আমরা, অন্য ধারে এক বাঘিনী তার দুই সন্তান নিয়ে। তিনজনেই আধশোয়া হয়ে বিশ্রামে। শাবকদুটি তখনও মানুষ দেখায় সড়গড় হয়নি বোধ হয়, মাঝে মধ্যেই মাথা তুলে দেখছে আমাদের দিকে। মা নির্বিকার। গাড়ি ভর্তি লোক দেখা তার কাছে নতুন নয়।
আমার প্রথম তাড়োবা ভ্রমণ ছিল দেড় দিনের। তারপর আরও বেশ কয়েকবার গিয়েছি সেখানে। কখনওই নিরাশ করেনি এই জঙ্গল। বাঘ দেখার পাশাপাশি দেখেছি ভল্লুক, গাউর, এমনকি জলপানে ব্যস্ত লেপার্ডেরও দেখা মিলেছে। প্রচণ্ড গরমে জঙ্গল ঢুঁড়ে ফেলেছি কিন্তু ময়ূর আর হরিণের বেশি কিছু দেখছি না। এমন সময় একটি গাড়ি জানিয়ে গেল সামনে এক দল ঢোল অর্থাৎ জংলি কুকুর হরিণ তাড়া করেছে। বলা হয়, বাঘের চেয়েও সাংঘাতিক এই ঢোল। এমনকি বাঘও সতর্ক থাকে এদের থেকে। দলবদ্ধ ভাবে থাকে ঢোল, শিকারকে তাড়া করে ধরতে ওস্তাদ এরা, কিছুতেই ভয় পায় না। যতক্ষনে আমরা পৌঁছলাম সেখানে, ততক্ষণে তারা একটি চিতল হরিণ শিকার করে সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তার ওপর। হৃদয়বিদারক সেই দৃশ্য। হরিণটি তখন মারা যায়নি- ছটফট করছে, চেষ্টা করছে যদি ছাড়ানো যায় নিজেকে, কিন্তু ঢোলদের ভ্রূক্ষেপ নেই। ওই অর্ধমৃত শিকারকে তারা কামড়ে খেতে ব্যস্ত, তারা মরা পর্যন্ত অপেক্ষা করার সময় নেই। কষ্ট লাগলেও উপায় নেই। জঙ্গলের নিয়মের ওপর আমাদের নিয়ম খাটে না।
প্রয়োজনীয় তথ্য: তাড়োবা খোলা থাকে প্রতি বছর ১ অক্টোবর থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত। এই সময় মঙ্গলবার ও বিশেষ কিছু ছুটির দিন বন্ধ থাকে জঙ্গলের দরজা। মার্চ থেকে জুন - সকালের সাফারির সময় সকাল ৬টা থেকে ১০টা আর বিকেলের সাফারির সময় দুপুর আড়াইটে থেকে সন্ধ্যে সাড়ে ৬টা। তবে এই টাইমের অদলবদলও হয়, যেমন এখন সকালের সময় আধঘণ্টা করে এগিয়ে গিয়েছে আর বিকেলের সময় আধ ঘণ্টা করে পিছিয়ে গিয়েছে। বুকিংয়ের সময় সর্বশেষ সময় ও পার্কে প্রবেশের মূল্য যাচাই করে নেবেন। পার্কে প্রবেশের জন্য এখন ৬টি গেট নির্দিষ্ট করা আছে। এবং নির্দিষ্ট সংখ্যক গাড়িই প্রবেশ করতে পারবে প্রতি বেলা। অবশ্যই অনলাইন বুকিং করে যাবেন। আগাম বুকিংয়ের পাশাপাশি অনলাইনে তৎকালে বুকিং ও করা যায়। বিশদ জানতে দেখুন www.mahaecotourism.gov.in
ছবি: সঞ্জয় গঙ্গোপাধ্যায়