নির্বাচনের ঘণ্টা বাজার অনেক আগে থেকেই প্রচুর অভিযোগ, আশ্বাস, বিবৃতি আর বক্তব্যে আবহাওয়া গরম হয়ে উঠেছে। এইসবের মাঝে যে প্রস্তাবটি নকশালপন্থী নেতা দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বিহারের নির্বাচনের পরেই দিয়েছিলেন অনেকের কাছে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। তিনি বিজেপি-বিরোধী দলগুলিকে একসঙ্গে লড়ার জন্যে আবেদন করেছেন। তা না করলে ওই বৃহৎ শক্তিশালী, সমৃদ্ধ ও অপ্রতিরোধ্য দলের আক্রমণের হাত থেকে কেউই বাঁচবেন না। যে যাই বলুক, আমাদের মানতেই হবে যে গত সাতদশক ধরে যে তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলায় রাজ করেছে তারা সকলেই মূলত ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস রাখে। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল, তাঁদের শীর্ষস্থানীয় নেতারা সব এরাজ্যেরই, প্রতি সপ্তাহে দিল্লি বা অন্য রাজ্য থেকে আমদানি করতে হয়নি। তৃতীয়ত, তাঁরা জন্ম থেকে বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত এবং জানেন যে বাংলার সব মনীষীই বহুত্ববাদে আর সহিষ্ণুতায় একেবারে অনড় ছিলেন। যাঁরা এই মহাপুরুষদের শুধু রাজনৈতিক প্রচারে ব্যবহার করেন তাঁরা এইসব জানেনই না, তাই অনর্গল অসত্য বক্তব্য রাখেন। এর মানে এই নয় যে বাংলার তিন দল তাদের নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ে কোনও অংশে কম নির্মম বা হিংস্র ছিল, কিন্তু ধর্ম নিয়ে কোনও প্রকার বিদ্বেষ তারা ছড়ায়নি। এই নির্বাচনেই প্রথম এর ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে এবং ধর্ম ও সম্প্রদায়ের নামে ভোট চাওয়া হচ্ছে।
এটাও সত্য যে তিনটি দলেরই একে অন্যের বিরুদ্ধে প্রচুর অভিযোগ আছে আর ক্ষোভও পোষণ করে। কিন্তু সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ এক দর্শক হিসেবে শুধু এটাই বলা যায় যে প্রতিটি দলের লোকই কোনও না কোনও সময় অন্য দলের সমর্থকদের হাতে গুরুতরভাবে আক্রান্ত হয়েছেন এবং খুনও হয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে এটাও সত্যি যে নিজেদের জমানায় তাঁরাই আবার অন্য বিরোধী দলের সদস্যদের অত্যাচার ও মারধর করেছেন, এমনকী হত্যাও করেছেন। গত কয়েক বছর ধরে বিরোধী দলের উপর তৃণমূল কংগ্রেসের লাগাতার আক্রমণের জন্যেই সেইসব দলের অনেক সদস্যই কেন্দ্রীয় সরকারের সমর্থিত বিজেপিতে আশ্রয় নিয়েছেন, হালের দলবদলের খেলার আর বিজেপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের অনেক আগেই। তার ফলেই বাংলায় বিজেপি বিশাল একটি প্রতিমূর্তিতে পরিণত হয়েছে। বিজেপি-বিরোধী আঁতাতের প্রধান দায়িত্ব ছিল এরাজ্যের শাসক দলের ওপর। আর বাম দলেরা এবং কংগ্রেস যদি তাদের রক্তমাখা ইতিহাস ভুলে হাত মেলাতে পারে, তবে রাজনীতিতে সবই সম্ভব।
সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফলাফল স্পষ্ট বলছে যে এবার সংযুক্ত মোর্চা বা তৃতীয় ফ্রন্টের ভূমিকা খুবই সীমাবদ্ধ। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের সংখ্যা অনুযায়ী ২৯৪টি বিধানসভা আসনের মধ্যে তৃণমূল এগিয়ে আছে ১৬৪টিতে, আর বিজেপি ১২১টিতে। মার্কসবাদী কমিউনিস্ট দল বা বামফ্রন্ট একেবারে শূন্য, যা সত্যিই অভাবনীয়। ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে জাতীয় কংগ্রেস ৪৪টি আসন পেয়েছিল, কিন্তু ২০১৯-এ এই দল এগিয়ে ছিল মাত্র ৯টি আসনে। ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় বিজেপি তাদের ভোটের হার একলাফে ২২.৭ শতাংশ বাড়িয়ে, পৌঁছে গেছে ৪০.১-এ। এটা একটা সর্বকালীন রেকর্ড। তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট ৪৩.৩ শতাংশ যা ২০১৪-র তুলনায় ৩.৫ শতাংশ বেশি। তাই ২২টি কেন্দ্রে তারা জয়লাভ করল, নাহলে পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা ছিল। অতএব, বিজেপির বর্তমান উৎসাহ ও উদ্দীপনার যথেষ্ট কারণ আছে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ধাক্কা খেল সিপিএম, যার প্রাপ্ত ভোটের হার ১৬.৭ শতাংশ কমে ঠেকল গিয়ে এক লজ্জাদায়ক ৬.৩-তে। তাই এবার নির্বাচনে অনেক নতুন ও উদ্যমী তরুণ প্রার্থী এনেছে। কংগ্রেসের দুর্দশা সবচেয়ে বেশি, তাঁদের ভোটার অংশ হ্রাস পেতে পেতে শেষে এখন ৫.৭-এ।
এবার তৃতীয় ফ্রন্টে যোগ দিয়েছে আব্বাস সিদ্দিকির নব গঠিত ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট বা আইএসএফ। তিনি একটি ধর্মের শীর্ষস্থানে থেকে আর সম্পূর্ণভাবে সেই ধর্মকে ব্যবহার করার পরেও ধর্মনিরপেক্ষ কী করে হয় বোঝা মুশকিল। অনেকেই খুব বিস্মিত হল যখন বাম দলেরা তাঁর সঙ্গে জোট বাঁধল। তাঁর বেশ কয়েকটি উক্তি বিতর্ক সৃষ্টি করেছে আর তিনি মুসলমান ভোট বিভাজন নিশ্চিতরূপে করবেন। তাতে বাম বা কংগ্রেসের কতখানি লাভ হবে বলা যায় না, কিন্তু বিজেপির নিঃসন্দেহে সুবিধা হবে। এরাজ্যে মুসলমানদের সংখ্যা ২৭ শতাংশের কিছু বেশি আর গত কয়েকটি নির্বাচনে তার বৃহৎ অংশ তৃণমূল কংগ্রেস পাচ্ছে। বলা বাহুল্য যে, বিজেপির রাজনীতিই বিশেষভাবে এই সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে। তাঁদের প্রধান অভিযোগ হল, এদের বেশি তোয়াজ করা হয়েছে, আর এই তর্কে যুক্তির বা তথ্যের খুব একটা স্থান অবশ্য নেই। অজস্র টাকা ঢেলে লাগাতার প্রচার চলছে যে তাঁদের জনসংখ্যা বাড়ছে ভয়ঙ্কর হারে, আর রাজ্য সরকারের প্রশ্রয়ে তাঁরা কোনও আইন মানেন না, এমনকী মহামারীর বিধিনিষেধও নয়। এই নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে কত ছবিই না ছড়ানো হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মাথায় হিজাব পরে দোয়া চাইছেন, অতএব হিন্দুধর্ম বিপন্ন। সুপরিকল্পিতভাবে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে যে মোদি এবং বাজপেয়িও ইসলামীয় উৎসবে ফেজ টুপি মাথায় দিয়ে ছবি তুলেছেন। উদ্বেগের কারণ হচ্ছে যে এই অবিরাম এবং সম্পূর্ণ সুদক্ষ প্রচারের ফলে খুব উচ্চশিক্ষিত মহলেও মুসলমান বিদ্বেষ বেড়েছে। শুধু উচ্চ বর্ণ আর শ্রেণির অহংকার দিয়ে একে বোঝানো যায় না। প্রচুর ভোটার যারা মনেপ্রাণে সাম্প্রদায়িক নয় তারাও প্রভাবিত হয়েছে। তোলাবাজদের উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য খাল কেটে যে কাদের আনছে তা বোঝার সময় নেই।
আর যাঁর একের পর এক সাংঘাতিক ভুল সিদ্ধান্তের জন্যে ভারতের অর্থনীতি আজ এই ঐতিহাসিক সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছেছে তাঁর মুখে অন্তত বিকাশের বাণী শোভা পায় না। সব পরিকল্পনার সামনে ‘প্রধানমন্ত্রী’ নাম জুড়ে চলেছেন কিন্তু ঘাড় ঘুরিয়ে তিনি দেখছেন না যে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন যে তাঁর অতি প্রচারিত উজ্জ্বলা যোজনার গরিবেরা গ্যাস নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। কর্মসংস্থান আর অর্থনীতি ছেড়ে সমাজের দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে যে জাতপাতের রাজনীতি যা এরাজ্যে নগণ্য ছিল এখন মাথাচাড়া দিচ্ছে। এতে তাঁদেরই সুবিধে যাঁরা সারা উত্তর ভারতে জাত নিয়ে ভোট টানেন। মতুয়াদের ভোটব্যাঙ্কের অবশ্য তোয়াজ শুরু করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই, কিন্তু এখন তার পুরোপুরি ফায়দা নিচ্ছেন মোদি। শুধু এরাজ্যে নয়, বাংলাদেশেও। রাজবংশী-মাহাত তো আছেই, এখন তার সঙ্গে জুড়েছে মাহিষ্যদের নিয়ে খেলা। আমরা এগচ্ছি না পিছিয়ে যাচ্ছি বোঝা মুশকিল। দু’শো বছর আগে বাংলায় নবজাগরণ ঘটায় সংস্কারমুক্ত ও উদারমুখী বাঙালিরা যারা ভারতবর্ষের অনেক প্রদেশের রক্ষণশীল মানুষকে পিছনে ফেলে দ্রুত গতিতে এগিয়ে গিয়েছিল। এখন তাঁদেরই উত্তরসূরিদের এক অংশ ব্যস্ত হচ্ছে সেই ধর্মান্ধতা গ্রহণ করার জন্য। শুধু উত্তরপ্রদেশে মুসলিম, দলিত ও মহিলাদের ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখলেই বোঝা যায় ধর্মোন্মত্তরা আমাদের কোথায় নিয়ে যেতে পারে। বিশ্বভারতী আর কফি হাউসের অশান্তি তো শুধুমাত্র ম্যাচের আগেকার ‘নেট প্র্যাকটিস’ মাত্র।
ভারতের অনেক রাজ্যে যত সহজে সংখ্যাগরিষ্ঠ আধিপত্য ও অসহিষ্ণুতাকে গ্রহণ ও সমর্থন করেছে, কেরল, তামিলনাড়ু পাঞ্জাব ও বাংলা কিন্তু এখনও মেনে নিতে পারেনি। এদের ইতিহাস, সংস্কৃতি আর বিশ্বদৃষ্টি অনেকখানি আলাদা। বাংলার ইতিহাসে কোনওদিন এরকম পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি যেখানে একটি দলের সম্পূর্ণ নির্বাচনী প্রচার স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পরিচালনা করছেন এবং সিবিআই আর ইডি যাঁদের বিশেষ অস্ত্র। ইভিএম নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তা আছে আর এই সংশয়গুলি সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি লোকুরও তুলে ধরেছেন। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা সকলেই হিন্দি ভাষাতেই নির্বাচনী সভাতে তাঁদের বক্তব্য রাখছেন। বাংলার বিজেপির এত নেতা থাকতেও কাউকে তাঁরা অধিনায়কত্বের উপযুক্ত খুঁজে পাচ্ছেন না। তাঁরা এবার ধরেই নিয়েছেন যে মমতার সরকারের বিরুদ্ধে সব ক্ষোভ পরিণত হবে তাঁদেরই হিন্দি হিন্দু হিন্দুত্ব ভোটে। এর ফলে এখানকার প্রচুর হিন্দিভাষী লোককে বোঝানো হচ্ছে, রাম ও হনুমান এবার এখানে রাজ করবে। এইসব নিয়ে প্রশ্ন তুললেই সর্বভারতীয় মিডিয়ারা প্রচার করে বাংলায় নাকি সংকীর্ণ উপজাতীয়তাবাদ শুরু হয়েছে। আমাদের সৌভাগ্য যে এখনও অব্দি সাম্প্রদায়িক বা ভাষা-ভিত্তিক কোনও দ্বন্দ্ব লাগাতে পারেনি।
বেশিরভাগ লোকের মনে সন্দেহ নেই যে এবারকার নির্বাচন দ্বিপাক্ষিকই হবে। বেশিরভাগ কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা মূলত তৃণমূল আর ভারতীয় জনতা পার্টির মধ্যে। নির্বাচকেরা কোনও ভোট নষ্ট করবেন না। তাঁরা যেখান মনে করবেন বাম বা কংগ্রেসের
প্রার্থী বিভেদপন্থী শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারবেন, সেখানে তাঁদেরই ভোট দিতে পারেন। আর এবার তো খেলা হবে নির্বাচনের পরেও, কেননা বিধায়ক কেনার ব্যাপারে একটি দল অলিম্পিক স্বর্ণ পদকও পেতে পারেন।
লেখক প্রসার ভারতীর প্রাক্তন সিইও। মতামত ব্যক্তিগত