মানুষের সামর্থ্য খুবই সীমিত। তবে হ্যাঁ, এই সীমিত পরিবেশের ভেতরে যে যতটুকু জানে, তাই নিয়ে বলতে পারে—আমার অল্প বুদ্ধিতে আমি যা জানি, বুঝি, তদনুযায়ী কাজ করছি; কোনো গ্যারান্টি দেবার মতো বিদ্যে-বুদ্ধি আমার নেই। এইটেই হ’ল স্পষ্ট স্বীকারোক্তি। আমি ইতোপূর্বে বলেছি যে জাগতিক জ্ঞান—যে রকমেই হোক আর যতই বেশী হোক না কেন—কারুর পূর্ণ জ্ঞান নেই, থাকতে পারে না। খণ্ড বিদ্যা, খণ্ড মনের দ্বারাই আহৃত হয়ে থাকে ও তাই তা চিরদিন থাকে না। [প্রকৃত] জ্ঞান একটাই ও তা ঈশ্বরবিষয়ক জ্ঞান, পরমপুরুষকে জানার যে প্রয়াস সেইটাই ঠিক জ্ঞান, বাকী জ্ঞান, জ্ঞান নয় কারণ তা আজ আছে, কাল থাকবে না ও যেটুকু আছে সেটুকুও পূর্ণ নয়, জাগতিক জ্ঞানের ব্যাপারে এ দুটো কথা মনে রাখতে হবে। একটা কথা হল—যে জ্ঞানটা আছে সেটা পারফেক্ট নয়, খুবই কম; আর দ্বিতীয়তঃ, সেই কম জ্ঞানটুকুও কেউ চিরদিন রাখতে পারবে না কারণ এ পৃথিবীতে কোনো খণ্ড বস্তুই চিরদিন থাকে না, তাই জ্ঞানও থাকবে না। সুতরাং মূর্খের মতো উক্তি করে কেন নিজেকে উপহাসাস্পদ করা হবে, না করাই ভাল। যদি কেউ বলে, ‘আমি ভূগোলে মহাপণ্ডিত, আমি ভূগোল ভালই জানি।’ আমি বলেছিলাম, তাহলে সেই ভদ্রলোককে আমি ভূগোলেই একটা প্রশ্ন করছি, ‘‘আপনার ওই কলকাতা শহরে কটা ইঁদুর আছে অথবা ক’টা পিঁপড়ে আছে বলুন তো।’’ এটাও তো ভূগোলের প্রশ্ন ও আমি আশা করি, ভূগোলের কোনো পণ্ডিতই এর যথাযথ উত্তর দিতে পারবেন না। খণ্ড জ্ঞানের ব্যাপারে জিনিসটাই এই রকম।
খণ্ড জ্ঞান কোন অবস্থাতেই পূর্ণ নয়, সুতরাং ডাক্তারের জ্ঞানও পারফেক্ট নয়, জ্যোতিষীর জ্ঞানও পারফেক্ট নয়। এককালে সমাজে জ্যোতিষী হিসেবে আমারও খুব নামডাক ছিল। অনেককে অনেক কিছু বলে দিতাম, সব মিলে যেতো, আর লৌকিক বিচারে দু’হাতে টাকা আসতো আর দু’হাতে দানও করতাম। তার পরে ভাবলাম—এতে লোকের উপকার করা হচ্ছে না। এক মুহূর্তে ছেড়ে দিলাম, আর শত অনুরোধ উপরোধেও করবো না কারণ ওসব বাজে জিনিস। সময় দেখে শুভাশুভ নির্ধারণ করা—এটাও বাজে। নিজের গুরুমন্ত্র উচ্চারণ করে, পরমপুরুষের নাম নিয়ে যখনি কাজ কর না কেন সেটাই শুভ সময়। সেটাই শুভ কাজ। এছাড়া আর অতিরিক্ত শুভ সময় কিছু হয় না। এখন যারা বলেন, বাইরে যাব, পশ্চিম দিকে যাব, তো পঞ্জিকায় যদি থাকে পশ্চিমে যাত্রা নাস্তি, তাহলে সেদিন যাব না বা পূর্বে যেতে চাই কিন্তু পূর্বে যাত্রা নাস্তি তো যাব না—তাঁরা সেখানে ভুল করেন, যদি পঞ্জিকায় কোনো দিন লেখা আছে—পশ্চিমে নাস্তি, তাই তিনি সেদিন মুম্বাই গেলেন না। তাহলে তার সেদিন কলকাতা থেকে হাওড়াও যাওয়া উচিত না কারণ হাওড়া পশ্চিমে, অথবা তার শিয়ালদা থেকে বড়বাজারেও যাওয়া উচিত নয়। কারণ বড়বাজার শিয়ালদার পশ্চিমে। এভাবে চলা যায় না। আর নিজের বাড়ীতেই কোনো ঘরটা পূর্ব দিকে রয়েছে, তাহলে পূর্ব দিকের ঘর থেকে পশ্চিম দিকের ঘরেও যাওয়া উচিত নয়। সুতরাং এ সবের কি আর শেষ আছে? এ সমস্ত একবারে বাজে জিনিস। তোমরা এ সমস্তের খপ্পরে একদম পড়বে না। যখন যেখানে যাবার ইচ্ছে, ইষ্টনাম নাও, গুরুমন্ত্র নাও, বেরিয়ে পড়ো। পঞ্জিকার নিষেধাজ্ঞার শক্তি যতটা, পরম পুরুষের নামের শক্তি তার চেয়ে অনেক বেশী। সুতরাং ঘাবড়িও না। ছেলেমেয়ের বিয়ের ব্যাপারে ঠিকুজী, কোষ্টি বিচার করে লোকে।
শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তির ‘আনন্দ বচনামৃতম্’ (১০-১৩ খণ্ড) থেকে