শঙ্করাচার্য্য গঙ্গাস্নান করে আসছিলেন। চণ্ডাল মাংসের ঝুরি নিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ তাঁকে ছুঁয়ে ফেলেছিল। শঙ্কর বিরক্ত হয়ে বললেন, “তুই আমায় ছুঁলি যে।” সে বললে, “ঠাকুর তুমিও আমায় ছোঁও নাই, আমিও তোমায় ছুঁই নাই। তুমি বিচার কর।” তুমি কি দেহ, কি মন, কি বুদ্ধি, কি তুমি বিচার কর। জড় ভরত রাজা রহুগণের পাল্কা বহিতে যখন আত্মজ্ঞানের কথা বলতে লাগল, রাজা পাল্কী হতে নেমে এসে বল্লে, “তুমি কেগো?” জড় ভরত বল্লেন, “আমি নেতি নেতি শুদ্ধ আত্মা।” শুদ্ধ আত্মা নির্লিপ্ত। শুদ্ধাত্মা নিষ্ক্রিয়, তিন অবস্থায় স্বাক্ষীস্বরূপ। যখন সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয়কার্য্য ভাবি, তখন তাঁকে ঈশ্বর বলি। চুম্বুক পাথর অনেক দূরে আছে, অথচ ছুঁচ নড়ছে কিন্তু চুম্বুক পাথর চুপ করে আছে—নিষ্ক্রিয়। শুদ্ধাত্মা সেইরূপ। ব্যাকুল হয়ে তাঁকে প্রার্থনা করলে আর কাঁদলে চিত্তশুদ্ধি হয়। নির্ম্মল জলেই সূর্য্যের প্রতিবিম্ব পড়ে। প্রতিবিম্ব সূর্য্যই সগুণ ব্রহ্ম আদ্যাশক্তি। সেই প্রতিবিম্বকে ধরেই সত্য সূর্য্যের দিকে যেতে হয়। সগুণ ব্রহ্মই প্রার্থনা শুনেন, তাঁরেই বল, তিনিই সেই ব্রহ্মজ্ঞান দিবেন। কেননা যিনিই সগুণ ব্রহ্ম তিনিই নির্গুণ ব্রহ্ম। যিনিই শক্তি তিনিই ব্রহ্ম। পূর্ণ জ্ঞানের পর অভেদ। ভক্তের আমি রূপ আর্সিতে সেই সগুণ ব্রহ্ম আদ্যাশক্তির দর্শন হয়। আর্সি খুব পরিষ্কার চাই, ময়লা থাকলে ঠিক প্রতিবিম্ব পড়ে না।
তিনি আছেন বলে জীব, জগৎ, চতুর্ব্বিংশতি তত্ত্ব,—এসব আছে। সাপ চুপ করে কুণ্ডলী পাকিয়ে থাকলেও সাপ, আবার তির্য্যকগতি হয়ে এঁকে বেঁকে চললেও সাপ। বাবু যখন চুপ করে আছে তখনও যে ব্যক্তি, যখন কাজ করছে তখনও সেই ব্যক্তি। তাঁকে বাদ দিলে কিছুই থাকে না। একের পিঠে অনেকশূন্য দিলে সংখ্যা বেড়ে যায়। এককে পুঁছে ফেললে শূন্যের কোন মূল্যই থাকে না। ব্রহ্ম আর শক্তি অভেদ। এককে মানলেই আর একটীকে মানতে হয়। যিনিই ব্রহ্ম তিনিই শক্তি। তাঁকেই মা বলে ডাকি। কালীই ব্রহ্ম, ব্রহ্মই কালী। যেমন অগ্নি আর তার দাহিকাশক্তি,—অগ্নি মানলেই দাহিকাশক্তি মানতে হয়, একটাকে ছেড়ে আর একটাকে ভাবা যায় না। সূর্য্যকে ছেড়ে সূর্য্যের রশ্মি ভাবা যায় না। আবার রশ্মিকে ছেড়ে সূর্য্যকে ভাবা যায় না। দুধ কেমন? না, ধোবো ধোবো। দুধকে ছেড়ে দুধের ধবলত্ব ভাবা যায় না। আবার দুধের ধবলত্ব ছেড়ে দুধকে ভাবা যায় না। তাই ব্রহ্মকে ছেড়ে শক্তিকে, শক্তিকে ছেড়ে ব্রহ্মকে ভাবা যায় না। নিত্যকে ছেড়ে লীলা, লীলাকে ছেড়ে নিত্য ভাবা যায় না।
সেই আদ্যাশক্তি বা মহামায়া ব্রহ্মকে আবরণ করে রেখেছে। আবরণ গেলেই যা ছিলুম তাই হলুম। ‘আমিই তুমি,’ ‘তুমিই আমি।’ বেদান্তবাদীদের সোঽহং অর্থাৎ ‘আমিই সেই পরব্রহ্ম,’ যতক্ষণ আবরণ রয়েছে ততক্ষণ একথা খাটে না। জলেরই তরঙ্গ, তরঙ্গের কিছু জল নয়। পূর্ণজ্ঞানে সমাধি হয়, চতুর্ব্বিংশতি তত্ত্ব ছেড়ে চলে যায়—তাই অহং তত্ত্ব থাকে না। ঠিক জ্ঞান হলে অহঙ্কার থাকে না। সমাধি হলে মানুষ তাঁর সঙ্গে এক হয়ে যায়। সমাধি না হলে ঠিক জ্ঞান হয় না। ঠিক দুপুরের সময় সূর্য্য মাথার উপর থাকলে নিজের ছায়া দেখা যায় না। তাই ঠিক জ্ঞান হলে, সমাধি হলে অহংরূপ ছায়া থাকে না। আমি একটী, তুমি একটী—এ ভেদ বোধ তিনিই করাচ্ছেন। যতক্ষণ এই ভেদবোধ, ততক্ষণ শক্তি মানতে হবে। যতক্ষণ ‘আমি’ আছে, ভেদ বুদ্ধি আছে,—ব্রহ্ম নির্গুণ বলবার যো নাই। ততক্ষণ সগুণ ব্রহ্ম মানতে হবে। বেদ পুরাণ, তন্ত্রে এই সগুণ ব্রহ্মকে কালী বা আদ্যাশক্তি বলে গেছে।
কুমারকৃষ্ণ নন্দী সংকলিত ‘শ্রীরামকৃষ্ণ বাণী ও শাস্ত্রপ্রমাণ’ থেকে