সন্তানের কর্ম সাফল্যে মানসিক প্রফুল্লতা ও সাংসারিক সুখ বৃদ্ধি। আয়ের ক্ষেত্রটি শুভ। সামাজিক কর্মে সাফল্য ... বিশদ
‘যে করুণ রসে আজি ডুবিল রে ও হৃদয় / শত স্রোতে তুই তাহা ঢালিবি জগৎময়’— ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ গীতিনাট্যে দস্যু থেকে কবিতে রূপান্তরিত বাল্মীকিকে দেওয়া দেবী সরস্বতীর এই আশীর্বচনই যেন এতদিন উদযাপন করলেন নৃত্যশিল্পী অলকানন্দা রায়। দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত আবাসিকদের অন্তরের অনুশোচনার করুণ আর্তিকে তাল, ছন্দ, লয়, মুদ্রার কোরিওগ্রাফিতে চিত্রায়িত করে উপস্থাপিত করেছেন। এবার সেই প্রবাহে ইতি টানতে চলেছেন অলকানন্দা। সংশোধনাগারের সাজাপ্রাপ্ত আবাসিকদের নিয়ে গড়া ‘বাল্মীকি প্রতিভা’র শততম গীতিনৃত্যাভিনয় মঞ্চস্থ হবে আগামী ১৭ নভেম্বর, রবীন্দ্রসদনে। ওই দিনই শেষবারের মতো বাল্মীকি, ব্যাধ, বনদেবী, দস্যু, লক্ষ্মী, বালিকা সেজে মঞ্চকে বিদায় জানাবেন সংশোধনাগারের নৃত্যপটু আবাসিকদল।
‘সব কিছুরই একটা শুরু ও শেষ থাকে। আমার মনে হয় মানুষের চাহিদা থাকতে থাকতেই শেষ করে দেওয়া ভালো’, বললেন গোটা দেশে প্রশংসিত প্রযোজনাটির প্রাণপ্রতিমা অলকানন্দা। সংশোধনাগারের আবাসিকদের নিয়ে অলকানন্দার কাজ শুরু ২০০৭ সালের মার্চে। ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ প্রথম মঞ্চস্থ হয় ২০০৮ সালে। টানা ১৭ বছরের পরিক্রমা। এর মধ্যে সাজার মেয়াদ শেষ করে মুক্তজীবনে পা রেখেছেন বহু ‘শিল্পী’। ‘১৭ বছরে প্রায় দুশোজন ছেলে-মেয়ে ‘বাল্মীকি প্রতিভা’য় অংশগ্রহণ করেছে। দস্যুদলের এক জন ছাড়া সবাই নতুন’, বললেন অলকানন্দা। এই নতুনত্বই তো প্রযোজনাটিকে সচল রাখতে পারত? মৃদু হেসে শিল্পী বললেন, ‘আমি তো আর বদলাচ্ছি না। ক্রমশ বয়স বাড়ছে। ৭৪ বছর বয়সে আর এত দৌড়ঝাঁপ করতে পারি না। তাছাড়া একটা জায়গায় পৌঁছে বন্ধ করে দিলে মানুষের মনে থাকবে হয়তো।’
এই সফল প্রযোজনা ছাড়াও সংশোধনাগারের আবাসিকদের নিয়ে বেশ কিছু পরিকল্পনা রয়েছে নৃত্যগুরুর। অলকানন্দার কথায়, ‘ওদের নিয়ে আরও তিনটে প্রোডাকশন তৈরি করে রেখেছি আমি। একটা যিশুখ্রিষ্টের উপর ‘ধ্রুবজ্যোতি তুমি যিশু’, সম্রাট অশোককে নিয়ে ‘মোক্ষগতি’ এবং নজরুল ইসলামের গান নিয়ে নৃত্যালেখ্য ‘গাহি সাম্যের গান’। এই প্রযোজনাগুলো মাঝেমধ্যে করার ইচ্ছে আছে আমার।’
শুরুতে আবাসিকদের লোকনৃত্য, মার্শাল ডান্স শেখাতেন অলকানন্দা। ‘দেখলাম ওদের মধ্যে একটা অদ্ভুত ভালোলাগা জন্মাচ্ছে। শরীরী ভাষা বদলাচ্ছে। তখন আমি ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ করার কথা ভেবেছি’, স্মৃতিমেদুর শিল্পী। সাফল্য ও দৃষ্টান্ত তৈরির পেছনে রয়েছে বিশ্বাস ও প্রশাসনিক স্তরে সহযোগিতা, ‘ছেলেমেয়েদের নিয়ে ট্রেনে করে মুম্বই, দিল্লি, বেঙ্গালুরু, ভুবনেশ্বর, পুনে গিয়েছি। ইচ্ছে করলেই তো ওরা পালাতে পারত। কেউ কখনও এক মুহূর্তের জন্য আমার মাথা নিচু করে দেয়নি। বরং আমার টাকা পয়সা, মূল্যবান জিনিস সব কিছু ওদের কাছে রাখি’, গর্বিত কণ্ঠে বলেন অলকানন্দা।
শেষ অনুষ্ঠানের আগে স্বাভাবিক ভাবেই মন খারাপ সকলের। অলকানন্দা বলেন, ‘সবচেয়ে খারাপ লাগবে আমার।’ শেষ সন্ধ্যায় দেখানো হবে অলকানন্দার কাজ নিয়ে কুড়ি মিনিটের তথ্যচিত্র ‘লাভ থেরাপি ইন মাই সেকেন্ড হোম।’ এই প্রযোজনায় নিজেকে উজাড় করে দিয়ে কী পেলেন? ‘মাতৃত্ব। ওরা সবাই আমাকে মা বলে ডাকে। এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি এক জীবনে আর কিছু হতে পারে না’, গলা কেঁপে ওঠে অদ্বিতীয়া অলকানন্দার।