মনোরম স্থানে সপরিবারে ভ্রমণ ও আনন্দ উপভোগ। সম্পত্তি সংরক্ষণে সচেষ্ট না হলে পরে ঝামেলায় পড়তে ... বিশদ
বাংলা মানে জামদানি। বাংলা মানে কাঁথা। বাংলা মানে শাড়ির গায়ে কত রকম গল্প। বিশ্বে বস্ত্রশিল্পের দরবারে শতকের পর শতক জুড়ে ঐতিহ্য, নকশা, হাতের জাদুর স্বপ্ন মাখা গল্পকথা তুলে এনেছেন বাংলার হস্তশিল্পীরা। বাংলার সেই বস্ত্রশিল্পের ঐতিহ্য ভোলার নয়। আধুনিক সময় আধুনিক প্রযুক্তি অনেক দ্রুত অনেক পণ্য নিয়ে বাজার দখল করছে ঠিকই। কিন্তু অবিভক্ত বাংলার প্রাচীন শিল্পসৌকর্য ভোলার নয়। সময় যতই ছুটে চলুক, অতীতের দিকেও মুখ ফেরাতে হয়। এই প্রজন্মকে সেইভাবেই মনে করিয়ে দিতে হবে ঐতিহ্যের কথা।
এমন ভাবনা থেকেই উইভার্স স্টুডিও রিসোর্স সেন্টার আয়োজন করেছে এক প্রদর্শনীর। ৩০ জানুয়ারি থেকে কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি-তে আয়োজিত হবে ‘টেক্সটাইলস ফ্রম বেঙ্গল: এ শেয়ার্ড লেগাসি’ নামে এই প্রদর্শনী।
মোগল আমলের ঐশ্বর্য থেকে ঔপনিবেশিক সময়ের আঁচ— অবিভক্ত বাংলার বস্ত্রশিল্প যে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এসেছে তার মধ্যে জামদানি, বালুচরী আর কাঁথা কাজের মতোই রয়েছে আরও নানা হাতের ছোঁয়া। এই বিষয়ে কথা হচ্ছিল উইভার্স স্টুডিও-র প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রোজেক্ট ডিরেক্টর দর্শন শাহ-র সঙ্গে। তিনি জানালেন, এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে বয়নশিল্পের প্রাচীন কারুকাজ ফিরে দেখার চেষ্টা করবেন তাঁরা। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এই ঐতিহ্য তুলে ধরা, তাদের অনুপ্রাণিত করা একটা অন্যতম লক্ষ্য এই উদ্যোগের।
উইভার্স স্টুডিওর তিন দশক ধরে নিজস্ব যে বিরল কালেকশন রয়েছে, তা দেখা যাবে এই প্রদর্শনীতে। বাংলার শিল্পীদের নৈপুণ্য আর দক্ষতার এক একটি ‘মাস্টারপিস’ বলা যেতে পারে এই সব সৃষ্টিকে। শতাব্দীপ্রাচীন মসলিন ও সিল্ক থেকে শুরু করে মাটির টানে জুড়ে থাকা আদিবাসী শিল্পীদের কাজ, দর্শকরা সবই দেখতে পাবেন এখানে। থাকছে প্রদর্শনীর নামেই একটি বই। যাতে আলোচিত হয়েছে বাংলার সুতি, সিল্ক, পাট শিল্পের সুদীর্ঘ বয়ন ইতিহাস।
দর্শন শাহ উইভার্স স্টুডিও শুরু করেন ১৯৯৩ সালে। ৩০ বছরেরও লম্বা যাত্রাপথ। বাংলার কাপড় নিয়ে উৎসাহ কীভাবে জাগল? আইআইএম আমেদাবাদে বিভিন্ন প্রোজেক্ট-এ কাজ করার সুবাদে তাঁর মার্কেটিং সংক্রান্ত জ্ঞান হয়েছিল ভালোই। স্থানীয় শিল্পীদের কাজ দেখা, কেস স্টাডি পর্যবেক্ষণ ইত্যাদির মাধ্যমে টেক্সটাইল সম্পর্কে আরও আগ্রহ ক্রমে তৈরি হয়। সেখান থেকে কলকাতা ফিরে আবার অন্য একটা জীবনের সাক্ষী হতে হয় তাঁকে।
কিন্তু এশহরে অন্য কাজের মধ্যে দর্শনের মাথায় ঘুরছিল কিছু একটা অন্য কাজের ভাবনা। মন বলছিল, তাঁর মধ্যে উদ্যোগপতি (অন্ত্রোপ্রোনর) হওয়ার মতো সম্ভাবনা রয়েছে। শিল্প সংক্রান্ত কাজের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখা সম্ভব— এমনই একটা ডাক কোনও একটা সূত্র থেকে যেন শুনতে পাচ্ছিলেন। কলকাতা শহরে তখন প্রদর্শনীর বিশেষ চল ছিল না। এখনকার তুলনায় ভাবলে প্রদর্শনী করার মতো প্র্যাকটিসটাই ছিল না বলা যায়। দর্শন দেশের বিভিন্ন শহর থেকে শিল্পীদের নিয়ে কাজ করানোর কথা ভাবলেন। বিশেষ কোনও উৎসবে বা আর্ট গ্যালারিতে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করলেন। ক্রমে সেগুলো জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। তিনি বলছেন, ‘এই যে প্রদর্শনী করে মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়া, এই বুদ্ধিটা সৃষ্টিশীল মন থেকে আসেনি। এসেছে বাজার অর্থনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয়ে কাজ করার ফলে। যোগাযোগ তৈরির ইতিবাচক ক্ষমতাও সহায়ক হয়েছে এক্ষেত্রে।’
এবার দেখা গেল কোনও একটি শহরের এক শিল্পীর কাছে দশটি ওড়না রয়েছে। এবার তিনি বললেন, ওড়নায় বাংলার কোনও নকশা যদি জুড়ে দেন, তাহলে কেমন হয়? কাঁথা কাজ, ব্লক প্রিন্টিং এবং বাটিকের কাজ— সেই সময় এই তিনটি দিক থেকে বাংলার ফ্যাব্রিক তখন দারুণ জনপ্রিয়। দর্শন করলেন কী, ওই ধরনের ফ্যাব্রিকে বাংলার সংস্কৃতির ছোঁয়া যোগ করে দারুণ কোনও পিস তৈরি করিয়ে ফেললেন। কালে কালে সেটি অনেকেরই ভালো লাগে ও জনপ্রিয় হতে থাকে। এর জন্য কখনও শান্তিনিকেতনে গিয়ে কাঁথা কাজ করানো, কখনও শ্রীনিকেতনে গিয়ে বাটিকের কাজ করানো কখনও পার্ক স্ট্রিটে গিয়ে ব্লক প্রিন্ট করানো— এগতে থাকেন তিনি।
বিভিন্ন মেলা, ক্রাফ্ট কাউন্সিল অথবা কলকাতার পুরনো শাড়ির দোকান, ওয়ার্কশপ, কারিগরদের কাছে ঘুরে ঘুরে তিনি আরও জ্ঞান বাড়াতে থাকেন। টেক্সটাইল সম্পর্কে ক্রমে আরও সমৃদ্ধ হয়ে তিনি শুরু করেন উইভার্স স্টুডিও। যেখানে শুধু হাতে তৈরি কাজেরই দর। কোভিড বা চীনা ফ্যাব্রিক, বাজারে থাবা বসাতে যা-ই আসুক না কেন হাতে তৈরি সামগ্রীর যে কোনও বিকল্প নেই, এটা খুব ভালো বুঝেছিলেন তিনি। হাতের সেই কাজ এখনও স্বমহিমায় এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশ, জাপানের বিভিন্ন অংশ ঘুরে হ্যান্ড ক্রাফ্ট নিয়ে আরও জ্ঞান বাড়িয়েছেন তিনি। তা বাটিক হোক বা ব্লক প্রিন্ট।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দাবিও তো পাল্টেছে? ফ্যাশনে অনেক কিছু চলে যায়, আবার ফিরে আসে। দর্শনের কথায়, ‘ঐতিহ্য এমনই, তাকে যেমন-তেমন করে ভুলিয়ে দেওয়া যায় না। ফ্যাশন দ্রুত পাল্টাবে। ডিজিটাল যুগে আরও বেশি পরিবর্তন আসবে। কিন্তু আমরা যে কাজটা করি, তার সঙ্গে ধারাবাহিকতা জড়িয়ে। টেক্সটাইলে একটু একটু করে কীভাবে বদল এসেছে, তার সাক্ষী হতে ভালো লাগে। এখনকার প্রজন্ম অনেক কিছু সম্পর্কে সচেতন। ইন্টারনেট থেকে তারা অনেক কিছু পাচ্ছে। চিন্তার ধারা বদলাচ্ছে।’
কিন্তু অন্য সংস্কৃতিকে আপন করতে গিয়ে নিজের সংস্কৃতি কি ভুলতে বসেছে এই প্রজন্ম? দর্শনের মতে, ‘এটা সব সময় প্রজন্মকে দায়ী করার বিষয় নয়। এক্ষেত্রে বিষয়টাই অনেকটাই বাজার নির্ভরও বটে। চাহিদার সঙ্গে অনেক কিছু পাল্টায়। সেটা মানতে হবে। কিন্তু জানেন তো মূল কিছু জিনিস কখনও পাল্টায় না, বা হারিয়ে যায় না। এত বছর কাজ করে এটা আমি দেখেছি। কাঁথা কাজ, বাটিক বলুন বা ব্লক প্রিন্ট কোনওটা কি অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছে? বা হ্যান্ড পেন্টিং? স্ক্রিন বা ডিজিটাল প্রিন্ট এসেছে ঠিকই। আজকাল অবশ্য এই ধরনের প্রিন্ট থেকে হ্যান্ডমেড কাজ আলাদা করা খুব কঠিন। বিশেষজ্ঞ না হলে বা নিয়মিত এগুলো নিয়ে কাজ না করলে তফাত ধরা মুশকিল। কিন্তু সংস্কৃতিতে ঐতিহ্য থেকে যায়। এই ভরসা আমাদের আছে। সময়ের সঙ্গে কিছু কিছু বদল তো আসবেই। সমসাময়িক কাজ করতে হলে মূলগত ঐতিহ্যকে ভুলে যাওয়া অসম্ভব।’
এই প্রজন্মের মেয়েদের শাড়ি সম্পর্কে সঠিকভাবে গাইড করতে কী বলবেন? তিনি বলছেন, ‘ঠাকুরমার আলমারি খুলে দেখতে বলুন শাড়ির সংগ্রহ। ওই সংগ্রহ যে কী ভীষণ মূল্যবান সেটা হাতে ধরে না দেখলে তারা বুঝবে না, শিখবে না। তাদের এই শেখাটা দরকার। বনেদি পরিবার হোক বা সাধারণ, প্রত্যেকের বাড়িতে এক একটা আস্ত ‘মিউজিয়াম’ আছে। এগুলো না দেখলে হবে? শাড়ি–গয়না–রান্না সব কিছুই সম্পদের মতো।’
ছবি সৌজন্য: উইভার্স স্টুডিও