নারীবাদ ও নারীমুক্তি
মহিষাসুরের কবল থেকে স্বর্গরাজ্য উদ্ধারের জন্য দেবতাগণ দেবী দুর্গার আবাহন করেছিলেন। তিনি দশভুজা, অসুরদলনী এবং সর্বোপরি তিনি মা। নারীকে তুলনা করা হয় দেবী দুর্গার সঙ্গে। ঋগ্বেদের যুগে সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক। সেই সমাজে নারীই ছিল প্রধান। পরবর্তী সময়ে নারীর ক্ষমতা ক্রমশ খর্ব হতে শুরু করে এবং সমাজ পিতৃতান্ত্রিক বা পুরুষতান্ত্রিক হয়ে যায়।
কালক্রমে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও বঙ্গদেশের কিছু সমাজ সংস্কারকের অগ্রণী ভূমিকায়, ব্রিটিশ সরকারের আনুকূল্যে সতীদাহ বা বাল্য বিবাহের মতো প্রথা বন্ধ হয়। নারীদের শিক্ষার জন্য ‘বেথুন স্কুল’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ১৮৩৭ সালে কুমিল্লায় প্রথম বালিকা বিদ্যালয় ও ১৮৯৩ সালে মহিলা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৮৫ সালে বাংলার প্রথম নারীবাদী ‘সখী সমিতি’ প্রতিষ্ঠা করেন স্বর্ণকুমারী দেবী। লাঠি খেলা ও অস্ত্রচালনার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে তিনি দেশপ্রেম সঞ্চারিত করার চেষ্টা করেন। সরোজিনী নাইডু, সরলা দেবী চৌধুরাণী প্রমুখ নারী নেত্রী কংগ্রেস সভাপ্রধানের পদেও উন্নীত হন। ভারতবর্ষের প্রথম নারীবাদী আন্দোলনের সংগঠিত রূপকার মহারাষ্ট্রের পণ্ডিত রামবাই প্রকাশ্য আন্দোলনে নামেন। আইন-নিয়ম-ক্ষমতার জোরে আচার-অনুষ্ঠানকে পরিবর্তিত করা যায় বটে, কিন্তু সংস্কার ও মানসিকতার পরিবর্তন ঘটানো কি ততটা সহজ? তাই গৃহের অভ্যন্তরেই নারীর ওপর যে অত্যাচার চলছিল তা শাস্ত্রীয় নিয়মের অপব্যাখ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়।
আজ একবিংশ শতাব্দীতে আমরা নারীরা অনেক বেশি ফরওয়ার্ড। পাশ্চাত্য শিক্ষার ভাবাদর্শের বন্যায় আমরা পরিচিতি, সত্তা, স্বীকৃতি, সম্মান এই শব্দগুলির তাৎপর্য অনুধাবনের সঙ্গে সঙ্গে এগুলিকে অনেকটাই বাস্তবায়িত করতে সক্ষম হয়েছি। সে যুগে নারী ছিল পর্দানশিন, আর এ যুগের নারী রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে উচ্চপদ অলঙ্কৃত করছেন। তবুও নারী নির্যাতন সমূলে উৎপাটিত হয়নি। দিল্লিতে নির্ভয়া থেকে শুরু করে কামদুনি, কুশমণ্ডি ও স্কুল-কলেজ পর্যন্ত ভারতের প্রায় সর্বত্রই নির্যাতন, অত্যাচার এমন ভয়ঙ্কর পাশবিক রূপ ধারণ করেছে যে তা ভাষায় বর্ণনা করা দুঃসাধ্য।
যে অশুভ শক্তি, অশুদ্ধ ইচ্ছাকে দমনের জন্য মা কালীর আবাহন, যে মহিষাসুরকে বধের জন্য মা দুর্গার আবাহন এবং একদিকে হিন্দু ধর্মে তথা ভারতে যেখানে নারীকে পূজা করা হয়েছে মহাশক্তি, মহামায়ারূপে, সেই নারীর আজ এ কোন অবস্থা দেখা যাচ্ছে? পুরাণ প্রভৃতিতে বর্ণিত আছে, একসময় আসুরিক শক্তির নিকট দেবতাদের পরাজয় ঘটেছিল, দেবতারা স্বর্গরাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন। আজ সমাজে যে অনাচার, অত্যাচার ও নিপীড়ন তা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে নির্বিকল্প প্রভুত্বের আস্ফালন ব্যতীত আর কিছুই নয়। কার্ল মার্কস মনে করতেন, যখন শ্রেণী বৈষম্য ধ্বংস হবে, তখন আর নারী বৈষম্য থাকবে না। শ্রেণী বৈষম্য এবং শ্রেণী শোষণকে সর্বাঙ্গে দূর করার জন্যই শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম হয়েছে। কিন্তু আমাদের মন-মানসিকতার উত্থান ঘটেনি। ফলে স্বীকৃতি, সম্মান ও পরিচিতি লাভের উদ্দেশ্য নিহিত সামাজিক ন্যায়-আন্দোলনকে ভিতর থেকে দুর্বল করে দিয়েছে এবং বৈষম্য বৈষম্যের জায়গাতেই রয়ে গেছে। উচ্চশিক্ষিতা, আধুনিকারা আজ সমাজের সর্বস্তরে পুরুষের সঙ্গে সমানে পাল্লা দিতে গিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করছেন।
লিবারাল ফেমিনিজম ও র্যাডিকাল ফেমিনিজমের দৌলতে নারীও আজ বহুগামী। ‘বিল্বমঙ্গল’ নাটকে এক বণিকের তাঁর সহধর্মিনীকে লম্পট অতিথির শয্যায় প্রেরণ প্রসঙ্গটিকে ‘নারীর মূল্য’ প্রবন্ধে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কটাক্ষ করেছেন। তিরস্কার করেছেন সমগ্র পুরুষজাতিকে এবং তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ সচিব জন কেরির মতে, যে সব দেশ বিভিন্ন নীতি নির্ধারণে মেয়েদের অংশগ্রহণের সম্পূর্ণ সুযোগ দেয়, তারাই তুলনায় বেশি সুস্থিতি, সমৃদ্ধি এবং শান্তি অর্জন করে। আলাপ-আলোচনার পরিসরে যেখানে মেয়েদের স্থান দেওয়া হয় না, সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা তুলনায় কঠিন। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের দিনটিতে মেয়েদের সুযোগকে প্রসারিত করার মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে শান্তি ও সমৃদ্ধির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার যে অঙ্গীকার করা হয়, তা কি সত্যিই সর্বাংশে বাস্তবায়িত হয়? মেয়েরা কি বিভিন্ন ক্ষেত্রে আজও নির্যাতিত হয় না? মেয়েদের সব অধিকার কি তারা সঠিকভাবে পায়? এমন নানা প্রশ্নের সম্মুখীন আজকের সমাজ। তবু তার কোনও সঠিক উত্তর মেলে না। পুরুষদের মন থেকে এখনও অবদমনের ইচ্ছা লুপ্ত হয়নি। তাই নারী আজও বহুলাংশেই অবদমিত।
সতীত্ব কি শুধু নারীর জন্য, পুরুষের জন্য নয়? নাকি ঘোমটা ও পর্দার কারণেই সতীত্বের প্রশ্ন? তার বাইরে সতীত্ব অপ্রয়োজনীয়? ধর্ষণ বা অ্যাবিউস যাই হোক না কেন, তা তো শুধু শরীরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, শরীরের ঊর্ধ্বে যে বিষয়টিকে সর্বাগ্রে রাখা উচিত, তা হল মর্যাদা। যুগ বদলের পরেও নারী সব ক্ষেত্রে তার প্রাপ্য মর্যাদা পায় না। তাকে ক্রমাগত বঞ্চিত করে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। সে কখনওই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। যখনই মাথা তুলতে যায় তখনই তাকে টেনে নামিয়ে দেওয়া হয়।
শুধুমাত্র সংখ্যালঘিষ্ঠতার কারণে অত্যাচারিত নারীদের কাহিনী আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। অনেক সময়ই পুরুষ নারীকে নির্যাতন করার পরও দিব্যি পার পেয়ে যায়। কেন এই বৈষম্য? কেন এই একমুখিনতা? তা কি শুধুই নারী সংখ্যালঘু তাই? নাকি বহুদিন অবদমিত থাকার ফল? মেয়েরা সংসারে শান্তি বজায় রাখতে চায়। কিন্তু তাই বলে যুগ যুগ ধরে কখনও প্রকাশ্যে কখনও বা নীরবে অত্যাচার হবে তাদেরই বিরুদ্ধে তাও তো মেনে নেওয়া যায় না।
তবে বিপরীত ছবিও যে দেখা যায় না তা নয়। এমন সংসারও আছে যেখানে মেয়েরা উচ্চ মান ও মর্যাদা পায়। স্ত্রী উচ্চপদে চাকুরিরতা হওয়ার জন্য অনেক পুরুষ কর্মস্থল থেকে বাড়িতে ফিরেও সন্তানকে সামলান। দিবারাত্রি মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যাঁরা পরিবার পরিজনদের প্রতি সকল দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করেন, কর্মজীবন থেকে অবসরগ্রহণের পরও এই বৃদ্ধ বয়সে, যে গৃহকর্তা তাঁর অসুস্থ স্ত্রীর সেবা করেন, সেইসব পুরুষও যে সমাজে নেই তা নয়। তবে তাদের কথা অনেক সময়ই আমাদের সমাজ মনে রাখে না। কারণ এমন পুরুষ সমাজে আজও কম।
স্ত্রী স্বামীর চেয়ে বেশি রোজগার করলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্বামীদের মনে একরকম হিংসার উদ্রেক হয়। যে হিংসা থেকে অধিকাংশ পুরুষই একটা ডিপ্রেশনে চলে যেতে থাকেন। স্ত্রী’র কৃতিত্বটাকে তখন তাঁরা নিজেদের পরাজয় বলে মনে করতে শুরু করেন। আর সেই কারণেই তাঁদের এই মনঃকষ্ট। উল্টো দিকে স্বামীর রোজগার বেশি হলে বা তাঁর কোনও কৃতিত্ব বৃদ্ধি পেলে স্ত্রী কিন্তু সত্যিই খুশি হয়।
তখন তাদের মনে কোনও খেদ বা ক্লেশ থাকে না। স্ত্রীকে স্বামীর গৌরবের কথা জাহির করে বলতে প্রচুর শোনা যায়। কিন্তু উল্টো ক্ষেত্রে তেমনটা হয় না। বা বলা উচিত কম হয়। আসলে এই যে আচরণ, এগুলো সবই মানসিক শিক্ষার পরিচয়। আধুনিকতা ততক্ষণ আসবে না যতক্ষণ আমাদের মন আধুনিক না হচ্ছে। নারী মানেই পুরুষের চেয়ে নিম্ন, পুরুষ অপেক্ষা হীন এই ধারণা মন থেকে মুছে ফেলে প্রকৃত অর্থে উন্নত হতে হবে পুরুষকে। তবেই আমাদের সমাজ এগবে।
আসলে নারী আর পুরুষের মধ্যে এই বিভেদটা চিরকালই ছিল, চিরকালই থাকবে। তবু সমাজকে উন্নততর করতে হলে, সমাজকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে হলে এমন বিভেদ থাকা ভালো নয়। ব্যবহারিক দিক দিয়ে নারী ও পুরুষকে এই বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে।
জীবনের পথে চলতে গিয়ে অনেক বাধা আসে, কিন্তু সেগুলোকে সরিয়ে এগিয়ে যাওয়ার নামই জীবন। বর্তমান সমাজে নারীকেও সেই পথেই চলতে হবে। আর নারীর এগিয়ে চলার পথকে আরও সুন্দর করে তোলার দায়িত্ব অনেকটাই পুরুষের ওপর। তারা যদি নিজেদের ছোটখাট অহং ভুলে নারীর পরিপুরক হয়ে উঠতে পারে তবেই আমাদের সমাজ উন্নত হবে।
শুধু সমাজই বা কেন? পরবর্তী প্রজন্মকেও তো উন্নত করতে হবে। তাদের মনকে আলোকিত করার দায়িত্বও তো আমাদেরই ওপর। তাই নারী-পুরুষ নিজেদের মধ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টি না করে বরং একে অপরের সঙ্গে, একে অপরের হাতে হাত রেখে এগিয়ে চলুক। তবেই আমাদের সমাজ লাভবান হবে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এক উন্নত দেশের নাগরিক হয়ে জীবনযাপন করার সুযোগ পাবে। সন্তানের কাছে বাবা ও মায়ের যেমন গুরুত্ব, সমাজের কাছেও নারী ও পুরুষের তেমনই গুরুত্ব। যতদিন এই গুরুত্ব আমাদের সমাজ বুঝতে না পারবে ততদিন নারী তার পূর্ণ মর্যাদা কখনওই পাবে না।
সোমা চক্রবর্তী
16th November, 2019