কর্মপ্রার্থীদের কর্মলাভ কিছু বিলম্ব হবে। প্রেম-ভালোবাসায় সাফল্য লাভ ঘটবে। বিবাহযোগ আছে। উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় থেকে ... বিশদ
যথাসময়ে শুরু হল স্মরণসভা। প্রথম বক্তা ছিলেন তাঁর কিছুটা ঘনিষ্ঠ। তাঁর কথায় উঠে এল মানুষ সেশনের জীবনের নানা দিক। বললেন, ‘উনি ছিলেন একজন অকুতোভয় মানুষ। সেই জওহরলাল নেহরুর আমল থেকে তিনি সরকারি পদের দায়িত্ব সামলেছেন। সেদিন সেই তরুণ সাহসী, সৎ কর্মীটি নেহরুর নজরে পড়েছিলেন। কর্মজীবনের প্রথম পর্যায়ে তিনি ছিলেন তামিলনাড়ুর পরিবহণ কমিশনার। দায়িত্ব নিয়ে পড়লেন মহা ফাঁপড়ে। তিনি না জানেন গাড়ি চালাতে, না জানেন গাড়ি সারাতে। সেদিনই ঠিক করলেন, পরিবহণ কমিশনার হলে এগুলো জানা দরকার। দু’মাসের মধ্যে গাড়ি চালানো এবং গাড়ি সারানোর কাজ শিখে নিলেন। একেবারে গোড়া থেকেই তিনি ঠিক করে নিয়েছিলেন আজীবন সৎ থাকবেন। পরবর্তীকালে জুনিয়র অফিসারদের বলতেন, ‘একজন সরকারি আধিকারিকের একটা গুণই থাকা দরকার। সেটা হল সত্ত্ব গুণ। তাহলে জীবনে কোনও গ্লানি থাকবে না।’ এই সৎপথে থেকেই তাঁর একের পর এক উত্থান।
অথচ তিনি নিজের অস্তিত্বের মধ্য থেকে তাঁর মাটির গন্ধটাকে কোনওদিন মুছে ফেলেননি। কেরলের পালাক্কাড়ের সেই নরম, ভক্তিভাবালু মানুষটি কিন্তু শেষ পর্যন্ত অন্তরে একইরকম ছিলেন। ১৯৫৫ সালের তামিলনাড়ু ব্যাচের এই আইএএস মানুষটির কঠোরতা আমরা দেখতে পাই তাঁর কেরিয়ারের গোড়া থেকেই। তামিলনাড়ুতে তখন চলছে হিন্দি ভাষা বিরোধী আন্দোলন। সেই আন্দোলন দমন করার জন্য তাঁকে দায়িত্ব দেন তৎকালীন কংগ্রেসী মুখ্যমন্ত্রী এম ভক্তবৎসলম। কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকার চাইছিল দক্ষিণী রাজ্যগুলিতেও জোর করে হিন্দি চাপিয়ে দিতে। এতেই আগুন জ্বলে ওঠে রাজ্যজুড়ে। সেশন কঠোর হাতে সেই আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করেছিলেন। এতে তিনি তৎকালীন বিরোধী দল ডিএমকের চক্ষুশূল হয়ে ওঠেন। পরের নির্বাচনে ডিএমকে ক্ষমতায় এলে তিনি দিল্লির প্রশাসনিক ক্ষেত্রে প্রবেশ করেন।
তাঁকে ভালোবাসতেন জওহরলালের নাতি রাজীব গান্ধীও। তখন তিনি রাজীবের সিকিউরিটি অ্যাডভাইসর। একবার এক অনুষ্ঠানে রাজীব গান্ধীকে খাবার দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে একটা সিঙ্গারা জাতীয় কিছু একটা তুলে রাজীব মুখে দিতে যাচ্ছিলেন। সেটা দেখে সেশন তাঁর হাত থেকে সেটি কেড়ে নিয়ে বলেন, ‘স্যার, এভাবে কোনও খাবার আপনার খাওয়া ঠিক নয়। কেননা এই খাবারটির গুণমান পরীক্ষিত নয়।’ সেদিন রাজীব মুচকি হেসে বলেছিলেন, ‘থ্যাঙ্ক ইউ’। রাজীব তাঁকে প্রমোশন দেন। পরিবেশ সচিবের পদ থেকে তাঁকে নিয়ে আসেন প্রতিরক্ষা সচিবের পদে। ভি পি সিং তাঁকে নিয়ে আসেন যোজনা কমিশনে। একজন পাবলিক সার্ভেন্ট হিসেবে তিনি আজীবন নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন।
দ্বিতীয় ব্যক্তি তাঁকে স্মরণ করতে উঠে বললেন, ‘একবার তিনি বসে একটি গান শুনছিলেন। গানটি তখনকার খুব বিখ্যাত গান। ‘তু চিজ বড়ি হ্যায় মস্ত মস্ত’। তাঁর ঘনিষ্ঠ একজন তাঁকে বললেন, ‘আপনার মতো মানুষ এমন গান শুনছেন?’ উনি হেসে বলেছিলেন, ‘আমার শুনতে শুনতে মনে হল গানের কথাটা ভুল লেখা হয়েছে। ওটা হওয়া উচিত- তু চিজ বড়ি হ্যায় ভ্রষ্ট ভ্রষ্ট।’ রাজনীতিকদের এভাবে ব্যঙ্গ করে নিজেই হা হা করে হেসে উঠেছিলেন। অধিকাংশ ‘ভ্রষ্ট’ রাজনীতিকের বিরুদ্ধে তিনি জেহাদে নেমেছিলেন। জেহাদ না বলে ধর্মযুদ্ধ বলাটাই শ্রেয় হবে। একজন সৎ আমলা সবসময় মন্ত্রী বা নেতাদের বশংবদ হন না। তাঁদের কাজে বা পরিকল্পনায় ভুল থাকলে মেরুদণ্ডসম্পন্ন আমলারা প্রতিবাদও করেন। হয়তো অনেক সময় সেই প্রতিবাদ শাসকের ক্ষমতার কাছে হার মেনে যায়। তাঁর সঙ্গেও বিভিন্ন মন্ত্রীর সঙ্ঘাত বেধেছিল। বহুক্ষেত্রেই এইসব সঙ্ঘাত আদর্শগত। তাঁর সঙ্গে বিরোধ বেধেছিল তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এমজি রামচন্দ্রনের। তিনি বিরোধিতা করেছিলেন সর্দার সরোবর প্রকল্পের। পরিবেশ সচিব থাকাকালীন তাঁর সঙ্গে বিরোধ হয়েছিল মন্ত্রী ভজনলালের। অনেক সময় অনেকের মনে হয়েছে তিনি অহংকারী, উদ্ধত, আত্মম্ভর। কিন্তু মনে রাখা দরকার ধর্মযোদ্ধারা এমনই নির্ভীক ও আত্মবিশ্বাসী হন।
আমরা তাঁকে জানি একজন বলিষ্ঠ নির্বাচন কমিশনার হিসেবে। কিন্তু তিনি আজীবন সত্যের জন্য লড়াই করেছেন। তিনি যখন হার্ভার্ডে পড়তে যান সেখানে তাঁর শিক্ষক ছিলেন সুব্রহ্মণ্যম স্বামী। তাঁর পরামর্শেই চন্দ্রশেখর তাঁকে নির্বাচন কমিশনারের পদে নিয়ে আসেন। তাঁকে ডেকে এই প্রস্তাব দেওয়া হলে তিনি প্রথমে ঠিক করতে পারেননি কী করবেন। দায়িত্ব কি নেবেন! উত্তর খুঁজতে সোজা চলে গেলেন কাঞ্চীপুরমের শঙ্করাচার্যের কাছে। সব কথা বললেন। বললেন, ‘আমি দায়িত্ব নিয়ে কাজ শুরু করলেই সারা দেশের রাজনীতিকরা আমার উপর চটে যাবেন। আমি সেটা চাই না। আমি সংবিধান মেনে কাজ করলেই সবাই রে রে করে উঠে আমার শত্রু বনে যাবেন। আমি সেটা চাই না।’ শঙ্করাচার্য তাঁকে গীতার শ্লোক বললেন। ধর্মপালন, ধর্মরক্ষা এবং সত্যের শক্তির কী মাহাত্ম্য বোঝালেন। মনস্থির করে ফেললেন সেশন।
দায়িত্ব নিয়েই তালিকা করতে বসলেন। কতরকম ভাবে নির্বাচনী দুর্নীতি হয়। তালিকা দীর্ঘ হতে থাকত। ঠিক করলেন এগুলিকে নির্মূল করে ভারতীয় নির্বাচন পদ্ধতিকে কালিমামুক্ত করবেন। নির্বাচনে কালো টাকার ব্যবহার বন্ধ করা, ছাপ্পা-রিগিং, গুন্ডাগার্দি বন্ধ করে নির্বাচনকে স্বচ্ছ করা এবং ভোটারদের একশো শতাংশ অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া। এই পণ নিয়ে তিনি কাজ শুরু করে দেন। স্বচ্ছ ভোটার তালিকা তৈরি থেকে ভোটারদের পরিচয়পত্র দেওয়ার কাজ তিনিই শুরু করেছিলেন। আজ নির্বাচন ব্যবস্থা যতটুকু স্বচ্ছ হয়েছে, তার পিছনে একমাত্র ব্যক্তি হলেন সেশন। অনেকে তাঁকে বলতেন হোলি টেরর। বহু রাজনীতিকের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন। মেগালোম্যানিয়াক, বুলডগ, খ্যাপা কুকুর যে যা ইচ্ছে তাঁকে বলেছেন। বহু রাজনীতিক আতঙ্কে তাঁদের সৌজন্যটুকুকে মুছে ফেলেছিলেন। মানুষ বুঝেছিলেন, তিনি দুষ্টু মৌমাছিদের চাকে ঢিল মেরেছেন। তিনি নিজেও ব্যাপারটা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতেন। সাংবাদিকদের তিনি মজা করে বলতেন। ‘আমি রাজনীতিকদের দিয়ে ব্রেকফাস্ট করি।’ তিনি বলতেন, ‘খেলার মাঠে যেমন রেফারি, তেমনই নির্বাচনী ময়দানে আমি। রেফারি যেমন কেউ ভুল করলে ফাউল বা অফসাইড দেন, আমিও তেমনই দুর্নীতি বা অন্যায় দেখলেই বাঁশি বাজাই।’
তৃতীয় ব্যক্তি তাঁকে স্মরণ করতে উঠে বললেন, ‘সেদিন সেশন সাহেব ভোটার কার্ড চালু করার কথা বলতেই অনেকে প্রমাদ গণেছিলেন। তাঁরা বুঝেছিলেন এতে রিগিং, অবাধ ছাপ্পা বন্ধ হয়ে যাবে। কাঁধে বন্দুক নিয়ে ভোটকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আর ভোট করা যাবে না। একচেটিয়া ভোট লুট বন্ধ হয়ে যাবে। জ্যোতি বসু, মুলায়ম সিং যাদব, লালুপ্রসাদ যাদব সহ অনেকেই পরিচয়পত্রের বিরোধিতা শুরু করলেন। তাঁরা বুঝেছিলেন ওই ভদ্রলোক তাঁদের পাকা ধানে মই দিতে এসেছেন। সেশনও কম যান না। রাজনীতিকরা বুনো ওল হলে তিনি বাঘা তেঁতুল। তিনি বললেন, ‘পরিচয়পত্র না হলে তিনি নির্বাচন হতে দেবেন না। সব স্থগিত করে দেবেন।’ অনেকেই দল বেঁধে সুপ্রিম কোর্টে গেলেন। কোর্ট জানিয়ে দিল মানুষের এই অধিকার কেড়ে নেওয়া যাবে না। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। তাঁর ক্ষমতায় থাকার শেষ ভাগে এসে শুরু হয়ে গেল ভোটারদের পরিচয়পত্র প্রদানের কাজ। সেই আনন্দ নিয়েই তিনি অবসর নিয়েছিলেন। সব কাজ তিনি করে যেতে পারেননি। কিন্তু অন্ধকারের শেষে এনে দিয়েছিলেন আলোর ইঙ্গিত। তাঁর আমলেই সারা দেশ দেখেছিল মডেল কোড অব কন্ডাক্ট কাকে বলে। সেই কন্ডাক্ট সেই সময় বহু রাজনীতিকের বুকে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছিল। তাঁদের স্বার্থে আঘাত লেগেছিল। তাই তাঁরা সেশনকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চেয়েছিলেন। তাঁরা বললেন, ‘নির্বাচন কমিশনে সেশন স্বেচ্ছাচার চালাচ্ছেন। এটা সেশনোম্যানিয়া। ভবিষ্যতে যাতে আর কেউ এমন ‘স্বেচ্ছাচারী’ মনোভাব না দেখাতে পারেন, বা ‘ভুল’ সিদ্ধান্ত নিতে না পারেন, তার জন্য একাধিক নির্বাচন কমিশনারের প্রয়োজন।’ তারপর থেকেই নির্বাচন কমিশন হয়ে গেল তিনজনের। অথচ রাজনৈতিক নেতারা কিন্তু বলেন না, একজন মুখ্যমন্ত্রী বা একজন প্রধানমন্ত্রী যাতে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে না পারেন, তার জন্য একাধিক মুখ্যমন্ত্রী বা একাধিক প্রধানমন্ত্রী দরকার।
গত কয়েক বছর ধরে তিনি লিখেছেন তাঁর আত্মজীবনী। বোঝাই যায়, সেই আত্মজীবনী একটা টাইম বোমার মতো। সে কথা জানতে পেরে তাঁর কয়েকজন শুভানুধ্যায়ী তাঁকে বলেছিলেন, ‘এটা ছাপা হোক, সকলে অনেক সত্যি কথা জানতে পারবেন।’ তিনি হেসে বলেছিলেন, ‘এই আত্মজীবনী আমি নিজের আনন্দের জন্য লিখেছি। এটা প্রকাশিত হলে অনেকেই অখুশি হবেন।’ সেই আত্মজীবনী প্রকাশিত হলে কার কার মুখোশ যে খসে পড়বে আমরা তা জানি না!