কর্মপ্রার্থীদের কর্মলাভ কিছু বিলম্ব হবে। প্রেম-ভালোবাসায় সাফল্য লাভ ঘটবে। বিবাহযোগ আছে। উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় থেকে ... বিশদ
জ্যোতোভস্কি বললেন, ‘কী মনে হচ্ছে কমরেট, আপনার চান্স আসবে?’
প্রমোদিয়েভ বললেন, ‘ক্ষমতা হল আমার হাতের এই চুরুটের মতো, এলেও জ্বলন, না এলেও জ্বলন।’
জ্যোতোভস্কি বললেন, ‘বড় তাত্ত্বিক কথা।’
বলতে বলতেই ঘোষণা হয়ে গেল। টিভির সংবাদ পাঠক পড়লেন ‘এবছরের নভেম্বর বিপ্লব উদযাপন কমিটির প্রধান নির্বাচিত হয়েছেন কমরেট প্রমোদিয়েভ।...।’ জ্যোতোভস্কি উঠে গিয়ে বললেন, ‘অভিনন্দন কমরেট প্রমোদিয়েভ।’ তারপরই ওদিক পরপর ফোন আসতে শুরু করল। লেনিন, স্তালিন, ট্রটস্কি, বিনয়স্কি, হরেকৃস্তভ প্রমুখের ফোন ধরতে ধরতে যেন হাঁপিয়ে উঠলেন প্রমোদিয়েভ। ‘ধ্যুত্তেরি’ বলে তাঁর মোবাইলের স্যুইচ অফ করে দিলেন।
এর মধ্যেই ছুটতে ছুটতে পার্টি অফিসে ঢুকলেন কমরেট সুভনোৎসিন। হাতের ফুলের গোছা। সেটা প্রমোদিয়েভের হাতে দিয়ে মাথা থেকে স্পোর্টস হ্যাটটা টেবিলে রেখে টাকের ঘাম মুছতে মুছতে বললেন ‘অভিনন্দন কমরেট, আপনার এই সম্মান আমাদের গর্বিত করল।’
প্রমোদিয়েভ চুরুটে টান দিয়ে বললেন, ‘এই নভেম্বর বিপ্লবই একদিন সারা বিশ্বে কমনিষ্ঠদের ক্ষমতা দখলের পথ প্রশস্ত করেছিল। আমরাও একসময় আমাদের রাজ্যে ক্ষমতার এক মসৃণ অবস্থানে ছিলাম। কিন্তু কয়েকজন অর্বাচীনের জন্য সেখানে আজ আমাদের সাজানো বাগান শুকিয়ে গিয়েছে।’
জ্যোতোভস্কি একটা হুম শব্দ করে বললেন, ‘আঙুরের জমিতে শিল্প করতে যাওয়া আর ভৃঙ্গীগ্রামে জমি দখলের ভুলের মাশুল আমাদের দিতে হচ্ছে। মানুষ টিভিতে দেখেছে সেই অত্যাচারের দৃশ্য। কমরেটরা পুলিশের পোশাক পরে কীভাবে গুলি চালিয়ে মানুষ মেরেছে, কীভাবে মানুষের ঘরে আগুন দিয়েছে। তার পাল্টা রিঅ্যাকশন হবেই।’
সুভনোৎসিন বললেন, ‘এখানে একটা কথা আমার বলা দরকার। সেটা হল এর থেকে অনেক বড় হত্যাকাণ্ড রাশিয়ায় লেনিনবাবু আর স্তালিনবাবুরা করেছিলেন। মস্কো, সেন্ট পিটার্সবার্গে যে গণহত্যা হয়েছিল সেটা হিটলারের থেকে কোনও অংশে কম ছিল না। তাও ওঁরা ক্ষমতা হারাননি। ওনাদের গণহত্যার তুলনায় আঙুর আর ভৃঙ্গীগ্রামের হত্যাকাণ্ড ছেলেমানুষ।’
জ্যোতোভস্কি বললেন, ‘চুপ করে বোস। তোমার এই এক মাথা গরম। আমরা এখান থেকে সব নজর রাখছি। প্রতিটা ভোটের ফল বিশ্লেষণ করে দেখেছি। প্রতিদিন ওখানে আমাদের ভোট কমে যাচ্ছে। আমরা শুধু মানুষের কথা বলতাম। আর ওরা মা মাটি মানুষের কথা বলে সব ভোট ছিনিয়ে নিয়ে গেল। এখন তো আবার শুনছি গোমূত্র, গোময় নিয়েও কেউ কেউ ভোটের আসরে অবতীর্ণ হচ্ছে। কিন্তু আমাদের নেতারা বসে ঝিমোচ্ছেন।’
প্রমোদিয়েভ বললেন, ‘তোমাদেরই তো দোষ। নিজেরাই ক্ষমতা ভোগ করেছ। কখনও ইয়ং জেনারেশনকে পাত্তাই দাওনি। ফলে দল এখন তরুণ শূন্য। তোমাদের সব কথা জানতে পারলে কমরেট স্তালিনরা ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড় করিয়ে সবাইকে গুলি করে মারতেন।’
জ্যোতোভস্কি বললেন, ‘লেটেস্ট রিপোর্টে দেখলাম সারাদেশে আমাদের পার্টি সদস্যের সংখ্যা দশকোটি ছড়িয়ে গিয়েছে।’
প্রমোদিয়েভ বললেন, ‘ওসব জল মেশানো রিপোর্ট। তুমি ওই রিপোর্টকে অথেন্টিক বলে মনে কর? আমাদের দুর্ভাগ্য হল আমরা সব কাজের লোকগুলো একে একে মৃত্যুলোকে চলে এলাম আর পড়ে রইলেন শুধু বাক্যবাগীশগুলো। দু’একজন বাদে কারও সঙ্গে মানুষের কোনও যোগ নেই। এদের দেখে মানুষ আমাদের ভোট দেবে? ফুঃ!’
এর মধ্যে একজন বেয়ারা এসে একটা স্লিপ দিয়ে গেলেন। প্রমোদিয়েভ সেটা পড়লেন। ‘মিঃ ঝংকারিয়া। ইনি আবার কে? আমার সঙ্গে দেখা করতেই বা চাইছেন কেন?’
সুভনোৎসিন বললেন, ‘উনি আমার সঙ্গে এসেছেন। আপনার সঙ্গে একটু দেখা করতে চান। মর্ত্যলোকে বড় শিল্পপতি ছিলেন। ওখানেই আমাদের পরিচয়। এখন এখানে এসেও সেই ধান্দা করতে চান।’
প্রমোদিয়েভ বললেন, ‘না, কোনও বুর্জোয়া শিল্পপতিকে আমি কাছে ঘেঁষতে দেব না।’
সুভনোৎসিন বললেন, ‘আজ্ঞে উনি মর্ত্যলোকেও আমাদের অনেক সেবা করেছেন। আপনি কি মনে করেন, শুধু কৌটো নাড়িয়ে পার্টির এত কোটি টাকার সম্পত্তি হয়েছে?’
প্রমোদিয়েভ বললেন, ‘দেখুন কমরেট জ্যোতোভস্কি, আপনার শিষ্যের কথাবার্তা শুনুন।’
জ্যোতোভস্কি বললেন, ‘হ্যাঁ, চিরকালই ও একটু একগুঁয়ে। পার্টিতে থেকেও অনেক সময় পার্টিলাইন মানেনি। তাতে অবশ্য অনেক সময় পার্টির উপকারই হয়েছে। আপনি একবার কথা বলে দেখতে পারেন।’
প্রমোদিয়েভের সঙ্কেত পেয়ে উঠে বাইরে গেলেন সুভনোৎসিন। একটু পরে এক ব্যক্তিকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ইনিই মিঃ ঝংকারিয়া।’
ঝংকারিয়া সবাইকে প্রণাম করে একটা প্যাকেট টেবিলে রাখলেন। সেটা দেখে প্রমোদিয়েভ বললেন, ‘এটা কী?’
মিঃ ঝংকারিয়া বললেন, ‘আজ্ঞে পরনামি। মন্দিরে দেওতা দরশন করতে যাব, আর থালায় পরনামি দেব না! ই কালচার হামার নেই স্যার।’
প্রমোদিয়েভ: ‘না, না ওটা নিয়ে যান। ওসব দেবতা টেবতার কথা আমাদের বলবেন না।’ সুভনোৎসিন বললেন, ‘মিঃ ঝংকারিয়ার একটা ইচ্ছে আছে। সেটা হল আমাদের নভেম্বর বিপ্লবের যে উৎসব হবে, তার খরচ সবটাই উনি বহন করতে চান। আমার ইচ্ছে এই সুযোগটা দিয়ে ওনাকে সম্মানিত করা হোক।’
হাতের নেভা চুরুটটা অ্যাসট্টেতে রাখতে রাখতে প্রমোদিয়েভ বললেন, ‘বেশ তাই।’
মিঃ ঝংকারিয়া বললেন, ‘হামার একটা নিবেদন আছে। এটা ওবশ্য মোরতোলোকের কেস আছে।’
প্রমোদিয়েভ তাঁর পাকা ভুরু দুটো বাঁকিয়ে বললেন, ‘বলুন।’
মিঃ ঝংকারিয়া গদগদ হয়ে বললেন, ‘থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। হামার লেড়কা আভি মরতোলোকে রিয়্যাল ইসটেটের বেওসা করে। তাই উস লোক মে একটা বড়া জমি চাই।
জ্যোতোভস্কি চটে গিয়ে বললেন, ‘আমরা কি জমি লেনদেনের ব্যবসা খুলেছি নাকি? আপনি অন্য কোথাও যান।’
মিঃ ঝংকারিয়া হাত দুটো জোড় করে বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘চটে যাবেন না স্যার। আপনারা চাইলেই হোবে।’
সুভনোৎসিন তাঁকে থামিয়ে বললেন, ‘মিঃ ঝংকারিয়া। আপনার যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন। একটু পরেই অন্য কমরেডরা চলে আসবেন। আজ পলিতবুড়োর মিটিং আছে।’
মিঃ ঝংকারিয়া বললেন, ‘হাঁ হাঁ, ঠিকই বলিয়েছেন। হামি চাইছিলাম আলুমুদুয়েভ স্ট্রিটের পার্টি অফিসটা হামাকে দিয়ে দিন। হামার লেড়কা ওখানে একটা মাল্টিস্টোরেড বিল্ডিং আউর শপিং কমপেলেক্স বনাবে। উও ইমন বিল্ডিং বনাবে যে লোকে আঁখ ফিরাতে পারবে না। হামার লেড়কা উধারকা নেতাকো সাথ বাতচিৎ করতা। লেকিন উও লোগ নেহি মানতা।’
প্রমোদিয়েভ বললেন, ‘কেন মানবে? আমাদের পার্টি কি মরে গেছে নাকি যে আপনাকে বাড়িটা দিয়ে দেবে?’ মিঃ ঝংকারিয়া এবার বললেন, ‘আপনি বোলেন স্যার, পার্টি ইখন ইত্তটুকুন হয়ে গ্যাছে। বড়া বড়া বাড়ি কী কামে লাগবে? হামি ওখানে ফ্ল্যাট বানানোর পর পাঁচ হাজার স্কোয়্যার ফিটের একটা ফ্ল্যাট পার্টিকে ভেট দিব। আউর আভি একশো করোড় রুপেয়া ক্যাশ দিয়ে দিব। ছোটা পার্টি ছোটা ঘর। ইয়ে হুয়ি না বাত। ইসি কা সাথ হামার লেড়কা ডিস্ট্রিক্ট পার্টি অফিস ভি খরিদ লেনা চাহতা হ্যায়। ঝংকারিয়া ডেভেলপার্স লাল পার্টিকো এক নয়া জিন্দেগি দে সকতা হ্যায়।’
প্রমোদিয়েভ বুঝলেন পার্টির বেঁচে থাকাটা খুব জরুরি। মুমুর্ষু রোগীর জন্য নতুন পথ্য দরকার। স্ট্রাগল ফর এগজিস্টেন্ট। তাই তিনি বললেন, ‘সবই তো শুনলাম। কিন্তু আমরা এখান থেকে কীই বা করতে পারি?’
মিঃ ঝংকারিয়া বললেন, ‘আপনারা সোব পারেন। হামি ইখান থেকে আমার লেড়কাকে প্ল্যনচেটে প্ল্যান দিচ্ছি আর আপনারা প্ল্যানচেটে সোব চ্যাট করে বাতিয়ে দিন।’
সুভনোৎসিন বললেন, ‘আমার মনে হয় মিঃ ঝংকারিয়ার প্রস্তাব আমাদের মেনে নেওয়া উচিত। আমি ব্যক্তিগতভাবে সেই অনাগত ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি। এখন অনেকেই পার্টি ছেড়ে পালাচ্ছে। লাল আর সেভ নয়। লড়াই এখন সবুজে-গেরুয়ায়। আর আমরা করছি হায় হায়। আর কিছুদিন পরে ওটা হানাবাড়ি হয়ে যাবে। ভূতেদের বাসা হবে ওটা। পার্টি এখন কলসির তলানি জল। কয়েকজন নেতা পনেরো মিনিটের মিছিল করে এক ঘণ্টা হাঁফায়। এই সময় ঘুরে দাঁড়ানোর রসদ দরকার। লেভি কমেছে। পার্টি সদস্য কমেছে। চাঁদা কম, কৌটো নাড়া বন্ধ। আমদানিটা হবে কোথা থেকে? এখন পার্টির ভরসা মিঃ ঝংকারিয়ার মতো মানুষজন। ওনারাই আমাদের অ্যাসেট। ওনাদের ভরসাতেই আবার ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখতে হবে। এনিয়ে আমি একটা কবিতা লিখেছি। দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে/ পার্টি আবার বেঁচে উঠুক ক্ষমতার দুধে-ক্ষীরে। পার্টি ক্ষমতায় এলে অমন বাড়ি আবার বানিয়ে নেওয়া সম্ভব। শুধু স্মৃতি আঁকড়ে পড়ে থাকলে পার্টির কোনও লাভ নেই।’
প্রমোদিয়েভ গম্ভীর মুখে সব কথা শুনলেন। তারপর বললেন, ‘মিঃ ঝংকারিয়া, আপনি আজ আসুন। আমরা পলিতবুড়োর মিটিংয়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব। তারপর মর্ত্যলোকের কমরেডদের সঙ্গে প্ল্যানচেটে চ্যাট করব। তারপর আবার যা হওয়ার হবে।’
কমরেট জ্যোতোভস্কি সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘শূন্য থেকে শুরু। হায়রে শূন্য থেকে শুরু।’