কর্মপ্রার্থীদের কর্মলাভ কিছু বিলম্ব হবে। প্রেম-ভালোবাসায় সাফল্য লাভ ঘটবে। বিবাহযোগ আছে। উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় থেকে ... বিশদ
বর্তমান নির্বাচনী রাজনীতি যে কতটা পঙ্কিল ও নোংরা, তারই জ্বলন্ত প্রমাণ আজকের মহারাষ্ট্র। সঙ্কীর্ণ স্বার্থসর্বস্ব রাজনীতিতে ক্ষমতা দখলের নেশায় ছোটবড় প্রতিটি রাজনৈতিক দলই আজ মরিয়া। মহারাষ্ট্রের ফল বেরনোর পর গত তিন সপ্তাহের রাজনীতির নাটকীয় ওঠাপড়া সেই অন্ধকার দিকটাকেই বড় প্রকট করে তুলেছে। ভোটের ফল ও কে মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে বসবেন, তা নিয়ে দুই পুরনো জোট শরিকের দ্বন্দ্ব যে দেশের বাণিজ্য পীঠস্থান মুম্বই তথা মহারাষ্ট্রকে এমন নজিরবিহীন সঙ্কটে ফেলবে, তা কে জানত? যে জোট পাঁচ বছর ধরে রাজ্য শাসন করল এবং এবারও গরিষ্ঠতা পেল, সেই জোটই ভেঙে খান খান! মহারাষ্ট্রে বিজেপি-শিবসেনা জোটের পথচলা শুরু গত ১৯৮৯ সালে। বাজপেয়ি-আদবানিদের আমলে। সেই দীর্ঘ তিরিশ বছরের সম্পর্ক চুরমার হওয়ার একমাত্র কারণ উন্নয়ন নিয়ে দ্বিমত কিংবা রাজ্যের স্বার্থরক্ষা নিয়ে বিরোধ নয়, ছোট শরিক শিবসেনা এবার মুখ্যমন্ত্রীর পদের হিস্যা চায়। অঙ্কটা কী রকম? মুখ্যমন্ত্রী হবেন আড়াই বছর ফড়নবিশ, আর আড়াই বছর উদ্ধব অথবা পুত্র আদিত্য। বালাসাহেবের নাতি তথা পরিবারের প্রথম কোনও নির্বাচিত সদস্য মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সি ছাড়া আর কোনও কিছু নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে নারাজ। আর সেইজন্যই বিজেপির সঙ্গে জোট ভেঙে এবার শারদ পাওয়ারের এনসিপি ও কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছেন উদ্ধব ও আদিত্য থ্যাকারে। শনিবারই এই নয়া জোটের নেতাদের রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করার কথা থাকলেও, শেষপর্যন্ত তা হয়নি। কংগ্রেস আবার বিষয়টিকে ঝুলিয়ে দিয়েছে। রবিবার দিল্লিতে সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে শারদ পাওয়ারের বৈঠক হওয়ার কথা। সেই বৈঠকের দিকেই সবাই তাকিয়ে। শোনা যাচ্ছে, তিন দলের আলোচনায় সরকার গঠনের যে ফর্মুলা তৈরি হয়েছে তাতে শিবসেনাই নাকি পাঁচ বছরের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর পদ পাবে। অন্যদিকে, এনসিপি ও কংগ্রেস পাবে উপমুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব। এখন সবকিছুই নির্ভর করছে রাজ্যপাল, কংগ্রেস এবং অবশ্যই শেষ প্রহরে মোদি-অমিত শাহ জুটির ওস্তাদের মার কোনও অঘটন ঘটায় কি না তার উপর।
আর এই ভোট-পরবর্তী নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ নিয়েই শুরু হয়েছে চাপান-উতোর। যদিও যুদ্ধে এবং রাজনীতিতে কোনও কিছুই অসম্ভব নয়। রাজনীতিতে স্থায়ী বন্ধু অথবা শত্রু বলে কিছুই হয় না। তবু, আসন ভাগাভাগি করে যে জোট নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পেল, তাকে পিছনে ফেলে, দীর্ঘ ৩০ বছর যারা একে অপরের বিরুদ্ধে লড়েছে, একে অপরকে উচ্চকিত আক্রমণ করেছে, তারাই এখন গা ঘষাঘষি করছে, গদি দখলের নেশায়। আর এটাই রাজনৈতিক মূল্যবোধকে আঘাত করার পক্ষে যথেষ্ট নয় কি? সদ্যসমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনেও শিবসেনা, কংগ্রেস ও এনসিপি ছিল একে অপরের তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বী। এককথায় রাজনৈতিক শত্রু। সেই ১৯৮৯ সাল থেকেই কংগ্রেসের সঙ্গে বাল থ্যাকারে ও তাঁর শিবসেনার কার্যত সাপে-নেউলে সম্পর্ক। রাজনীতির ময়দানে তাদের আক্রমণ ও পারস্পরিক শত্রুতা অনেক সময়ই শালীনতার ধার পর্যন্ত ধারেনি। একদা সোনিয়া গান্ধীকে প্রায় প্রতিদিনই বিদেশিনী বলে তীব্র আক্রমণ শানিয়েছেন প্রয়াত বালাসাহেব ও তাঁর অনুগামীরা। যদিও আবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কংগ্রেসের প্রতিভা পাতিল ও প্রণব মুখোপাধ্যায়কে সমর্থন দিতে কিন্তু পিছপা হননি বাল থ্যাকারে। তাই চিরদিনই রাজনীতির সম্পর্ক সরলরেখা মেনে চলে না। উত্থান-পতন, চড়াই-উতরাই তাই এই রাস্তার সহজাত উপকরণ।
দেশের ইতিহাসে সংবিধানের ৩৫৬ ধারা যেখানেই প্রয়োগ হয়েছে তা কখনও সর্বসম্মত হয়নি। ইন্দিরা গান্ধীর জমানায় রাষ্ট্রপতি শাসন জারি ছিল জলভাতের মতো। ইদানীং তা কমেছে সন্দেহ নেই। তবু, রাজ্যপালের চটজলদি সুপারিশ এবং ব্রাজিল সফরে যাওয়ার আগেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠকে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির সিদ্ধান্তে সিলমোহর, প্রমাণ করে যে স্ক্রিপ্টটা বোধহয় আগেই দিল্লিতে লেখা হয়ে গিয়েছিল। মোদি ও অমিত শাহের নেপথ্য কৌশলে শুধু যোগ্য সঙ্গতটুকু দিয়ে গিয়েছেন রাজ্যপাল ভগৎ সিং কোশিয়ারি। রাজ্যপালের ভূমিকা নিয়ে এক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। উঠেছেও তাই। কেন রাজ্যপাল রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত সময় দিয়েও দুপুর না হতেই দিল্লিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে মহারাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি শাসন জারির সুপারিশ পাঠালেন, তা নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে। গত ২১ অক্টোবর মহারাষ্ট্রে ভোটগ্রহণ হয়েছিল। ফল প্রকাশিত হয় ২৪ অক্টোবর। এরপর ইতিমধ্যেই প্রায় তিন সপ্তাহেরও বেশি কেটে গিয়েছে। মুম্বই তথা মহারাষ্ট্র হচ্ছে ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী। সারা দেশের ব্যবসায়িক উত্থান-পতন তথা আর্থিক লেনদেনের প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে মুম্বই। সেই শহরে শুধুমাত্র কোন দলের নেতা মুখ্যমন্ত্রী হবেন তা নিয়ে এমন নাছোড় বিরোধ এবং অচলাবস্থা মোটেই অভিপ্রেত নয়, বিশেষত, যখন দেশের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত সঙ্গীন। ভারতজুড়ে উৎপাদন মার খাচ্ছে, পণ্যের কাঙ্ক্ষিত চাহিদা বাড়ছে না, যার নিটফল—কাজ হারাচ্ছেন অগণিত কর্মক্ষম মানুষ।
একথা বলাই বাহুল্য, মহারাষ্ট্রে মানুষ কিন্তু সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনে বিজেপি-শিবসেনা জোটের পক্ষেই জনাদেশ দিয়েছিল। ২৮৮ আসনের মহারাষ্ট্র বিধানসভায় বিজেপি ১৫০টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জিতেছে ১০৫টি আসনে। আর শিবসেনা ১২৪টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৫৬টি আসনে জয়লাভ করেছে। অর্থাৎ বিজেপি-শিবসেনা জোট কিন্তু মোট ১৬১ আসনে জিতে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতাই পেয়েছিল। সরকার গড়তে তাদের অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বরং চিন্তা ছিল হরিয়ানা নিয়ে। কিন্তু ওই যে বললাম যুদ্ধ, আর রাজনীতিতে পাটিগণিতের সরল নিয়ম কখনও কখনও মেলে না। মহারাষ্ট্রেও তাই হল। ছেলেকে মুখ্যমন্ত্রী করতে মরিয়া উদ্ধব থ্যাকারে ভোটের ফল বের হতেই স্বমূর্তি ধারণ করলেন। বললেন, যেহেতু অমিত শাহের সঙ্গে বৈঠকে ভোটের আগেই ঠিক হয়েছিল মন্ত্রিসভায় দু’পক্ষের প্রতিনিধিত্ব হবে ৫০-৫০, তাই মুখ্যমন্ত্রীর পদকেও আড়াই বছর করে ভাগ করতে হবে। এই জটিলতা তিন সপ্তাহেও কাটেনি। উল্টে ২৪ অক্টোবর ফল বেরনোর পর থেকে মহারাষ্ট্রে কংগ্রেস, শিবসেনা এবং শারদ পাওয়ারের এনসিপি ক্ষমতা দখলের সঙ্কীর্ণ রাজনীতির সেই মেঠোপথ ধরেই ক্রমাগত কানাগলিতে ঘুরপাক খেয়ে অবশেষে একটা নয়া ফলপ্রসূ জোট গড়ার পথে এগতে পেরেছে। তবে তারা সরকার গড়ার ডাক পাবে কি না, তা এখনও পরিষ্কার নয়।
ভারতীয় সংবিধানে পরিষ্কার করে লেখা নেই সরকার গড়ার ক্ষেত্রে সঙ্কট দেখা দিলে রাজ্যপাল কোন দলকে কতটা সময় বরাদ্দ করবেন। শিবসেনাকে যতটুকু সময় দেওয়া হয়েছে শারদ পাওয়ারের এনসিপিকে দেওয়া হয়েছে তার চেয়েও কম। উল্টে রাত সাড়ে ৮টা যেখানে ছিল ডেডলাইন, সেখানে দুপুরবেলাই পাঠিয়ে দেওয়া হল রাষ্ট্রপতি শাসনের সুপারিশ। তাও আবার বিধানসভা ভঙ্গ না করে বিধায়ক কেনাবেচার মধ্যে দিয়ে যে কোনও সময় সরকার গড়ার পথকে সুগম রেখেই। ঠিক সেই সুযোগেই একটি বিকল্প শক্তি নতুন জোট গড়ে ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস ঘটিয়ে মহারাষ্ট্রে সরকার গড়ার দিকে এগচ্ছে। কিন্তু ক্ষমতা দখল সম্ভব হলেও আগামী পাঁচ বছর এই বিপরীত মতাদর্শের তিন দলের জোট সরকার স্থায়ী হবে কি না, সেটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন। ভয়টা সেই কারণেই।