কর্মপ্রার্থীদের কর্মলাভ কিছু বিলম্ব হবে। প্রেম-ভালোবাসায় সাফল্য লাভ ঘটবে। বিবাহযোগ আছে। উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় থেকে ... বিশদ
কিন্তু, বিস্ময়ের কথাটি হল প্রশান্ত মহাসাগর এবং অতলান্তিক মহাসাগরে চিরপরিচিত এল নিনো এবং লা নিনা দিয়েও এই মৌসুমি বায়ুর চরিত্রকে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। গত তাপমাত্রার চেয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেশি হলেই এল নিনোর আবির্ভাব ঘটে এবং মৌসুমি বৃষ্টিপাত নেতিবাচক হয়ে যায় আর বিপরীতে ‘লা নিনা’ ঘটলে স্বাভাবিক কিংবা প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটে। কিন্তু, ১৯৯৭ সালকে বিবেচনায় আনলে দেখা যাবে, ‘এল নিনো’ সত্ত্বেও যে-বছর স্বাভাবিক মৌসুমি বৃষ্টিপাত ঘটেছে।
আরও তথ্য হল, ২০১৬ সালকে ধরা হয়েছিল ‘লা নিনা’ বছর। অর্থাৎ উদ্বৃত্ত বৃষ্টিপাতের বছর। কিন্তু, দীর্ঘকালীন গড় বৃষ্টিপাতের হিসেবে (এলপিএ) যে-বছর বৃষ্টিপাত ছিল ৯৭ শতাংশ আর সেই বছরই খরা দেখা দিয়েছিল পাঞ্জাব, হরিয়ানা, গুজরাত এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলে। ২০১৯-এর এই উদ্বৃত্ত বৃষ্টিপাতের নিরিখেই অতীতের এই সব তথ্যকে সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে।
১৮৭১ সাল থেকে তথ্য সংগ্রহে দেখা গেছে যে, জুনে বৃষ্টিপাতের ঘাটতি ৩০ শতাংশ কিংবা তার বেশি হলে বছর-শেষে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাতই ছিল প্রবণতা। আর, চলতি বছরে বৃষ্টিপাতের ঘাটতি ছিল ৩৩ শতাংশ, যা পূরণ করা যাবে না বলেই মনে করা হয়েছিল। কারণ, এতটা ঘাটতি অতীতে কখনোই পূরণ করা যায়নি। ২০১৯-এ তার ব্যতিক্রম ঘটে। জুন-পরবর্তী তিনমাসে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। শুধুমাত্র সেপ্টেম্বরে বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি পায় ৫০ শতাংশের বেশি। মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রঘু মুর্তেগুড্ডে বলেছেন, মৌসুমি বৃষ্টিপাতের শুরু, প্রত্যাহার, বর্ষার স্থায়িত্ব, বর্ষার অদৃশ্য হওয়া সবকিছুতেই এক বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছে। আর এরই সঙ্গে চরম বৃষ্টিপাতের ঘটনা ক্রমশ বাড়ছে। চরম বৃষ্টিপাত নিয়ে সর্বসম্মত কোনও সংজ্ঞা নেই। ২৪ ঘণ্টায় ১২ সেমি-র বেশি বৃষ্টিপাত হলে, সেটাকে অতি ভারী বৃষ্টিপাত বলা হবে। আর সেই একই সময়ে ২৫ সেমি বৃষ্টিপাত হলে তাকে বলা হবে চরম বৃষ্টিপাত।
এলডোরাডো জলবায়ু সংক্রান্ত ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, বিগত ২৪ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে পৃথিবীর যে ১৫টি জায়গায় সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে তার মধ্যে ৮টিই ভারতে। গুজরাতের নালিয়া শহরে বৃষ্টিপাত ঘটে ১০.৩ ইঞ্চি, তারপরেই সেই গুজরাতের ওখাতে ৬.৫৪ ইঞ্চি, রাজকোটে ৫.৮৩ ইঞ্চি এবং মহারাষ্ট্রের মহাবালেশ্বরে ৫.৫৯ ইঞ্চি, আর কেরলের কোচিতে ৪.৯৭ ইঞ্চি, আলাপ্পুঝাতে ৪.৪৫ ইঞ্চি এবং কোঝিকোড়ে ৪.৫৭ ইঞ্চি উল্লেখযোগ্য। আরও একটি তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ভারতে ১৩টি রাজ্যে এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাত হয়েছে ১৮০০ শতাংশের বেশি! ব্যাপারটি কল্পনাতীত হলেও প্রাকৃতিক বাস্তব। পরিবেশবিদরা এর কারণকে সরাসরি জলবায়ু পরিবর্তনের উপরেই নিয়ে ফেলেছেন। এবং, সতর্ক করেছেন এই বলে যে, এটাই নতুন বাস্তব। এই নতুন বাস্তবকে স্বীকার করে নিলে বোঝা যাবে, কেন গুজরাতের সৌরাষ্ট্র এবং কচ্ছ বা রাজস্থানে ২৪ ঘণ্টায় ১০০০ শতাংশের বেশি বৃষ্টিপাত হয়! সৌরাষ্ট্রে ১১ আগস্ট ১,৮৪৪ শতাংশ বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে আর রাজস্থানের কোনও কোনও অংশে ১৯ জুন বৃষ্টিপাত হয়েছে ১,৩০৪ শতাংশের বেশি। এই অস্বাভাবিক একদিনের বৃষ্টিপাত রেকর্ড সৃষ্টি করেছে হিমাচলপ্রদেশেও। ২০১১-র পর এবছরের ১৮ আগস্ট এখানে বৃষ্টি হয় ১,০৬৪ শতাংশ আর পাঞ্জাবে ওই একই দিনে বৃষ্টিপাত ১,৩০০ শতাংশেরও বেশি!
খুব অল্প সময়ে অত্যধিক বৃষ্টিপাতের নজির আছে তেলেঙ্গানা, কর্ণাটক, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, জম্মু ও কাশ্মীর এবং গোয়াতে। আর, এই রাজ্যগুলোর বেশিরভাগই বন্যাদুর্গত। দিল্লির ডাউন টু আর্থ জানিয়েছে, হিমালয় অঞ্চলে তাপমাত্রা বেড়ে যাবে ২.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যে-কারণে ২০৩০-এর মধ্যে প্রাকৃতিক বিপর্যয় অর্থাৎ বন্যা ও খরা বাড়বে ২-১২ শতাংশ। বেড়ে চলবে হড়পা বান বা ফ্লাশ ফ্লাড ও ভূধস। যেটা এখন কেরলে ঘটছে। পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, বিগত বারো বছরের মধ্যে ২০১৯-এ মৌসুমি বৃষ্টিপাতের অগ্রগতি ছিল ধীরতম আর সেটা ঘটেছে জুনে। জুনেই বিগত ৭ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন বৃষ্টিপাতের ঘাটতি দেখা যায়। কিন্তু, তার চেয়েও যেটা বিস্ময়কর তথ্য সেটা হল, দেশের নানা প্রান্তে যখন খরা পরিস্থিতি চলেছে তখন উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতে ৭২ ঘণ্টা টানা বৃষ্টিতে ভয়ানক বন্যা দেখা যায় এবং ১৫ লক্ষেরও বেশি মানুষ দুর্গত হয়ে পড়ে। ২০১৬-তে মধ্যপ্রদেশ এবং রাজস্থানে খরা চললেও জুলাই-আগস্টে সেখানে বন্যা দেখা দেয় আবার বিহার ও অসমে তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি খরা দেখা দিয়েছিল। গত শতকে গোটা বিশ্বের মৌসুমি বৃষ্টিপাতের খামখেয়ালি চরিত্রে এক বিপজ্জনক প্রবণতা দেখা দিয়েছে। বৃষ্টিপাতের দিনগুলোর সংখ্যা কমছে কিন্তু বৃষ্টিপাতের তীব্রতা সেটা একদিনেই ১০-১৫ সেমি হয়ে যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, গোটা বিশ্বের ৫০ শতাংশ বার্ষিক বৃষ্টিপাত ঘটেছে মাত্র ১১ দিনে। ‘নেচার কমিউনিকেশন’ জার্নালে মন্তব্য করা হয়েছে, ১৯৫০-২০১৫ এই ৬৬ বছরে মধ্য ভারতে বৃষ্টিপাতের তীব্রতা তিন গুণ হয়ে গিয়েছে। আবার এই মন্তব্যও করা হয়েছে যে, ভারতের এক-একটি অংশে দিনে ১৫ সেমি বৃষ্টিপাত হওয়ার পরেও যেখানে মৌসুমি বৃষ্টিপাত দুর্বল হয়ে যাওয়ার চিহ্ন ধরা পড়েছে।
২০১৯-এর এই উদ্বৃত্ত বৃষ্টিপাত আবহাওয়াবিদদের হিসেবেই ছিল না। উদ্বৃত্ত বৃষ্টিপাত ভূগর্ভস্থ জলস্তরকে পুনরুজ্জীবিত করবে সন্দেহ নেই, কিন্তু আগামী বছর যদি আরও দেরিতে কেরলে মৌসুমি বায়ু প্রবেশ করে, ভারতের কৃষি আবার অনিশ্চয়তায় চলে যাবে। চলতি বছরের উদ্বৃত্ত জলকে ধরে রাখা হয়েছে—এমন সুখবর কিন্তু নেই।
লেখক মালদহে চাঁচল কলেজের অধ্যাপক