কর্মপ্রার্থীদের কর্মলাভ কিছু বিলম্ব হবে। প্রেম-ভালোবাসায় সাফল্য লাভ ঘটবে। বিবাহযোগ আছে। উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় থেকে ... বিশদ
শারদ পাওয়ার তখন কংগ্রেসে। বিদেশিনী ইস্যু মাথাচাড়া দেয়নি। অর্থাৎ, সোনিয়া গান্ধীর নামে গাল পেড়ে দল ছাড়েননি তিনি। ১৩ মাসের অটলবিহারী বাজপেয়ি সরকারকে মাত্র এক ভোটে ক্ষমতাচ্যুত করার নেপথ্যে শারদ পাওয়ারের ভূমিকাই প্রবল বলে মনে করা হয়। এখন সময় বদলেছে। বালাসাহেব এখন অতীত। একজন কার্টুনিস্ট। শিল্পী। মারাঠা জাত্যাভিমানের লড়াইয়ের সেনাপতি। ‘সরকার’। ঠিক এই কারণে লোকে শিবসেনাকে মনে রাখে... ভোট দেয়। দলটা বাল থ্যাকারের। যে ভোট শিবসেনা পায়, তার বেশিটাই ওই গেরুয়া গায়ে, রুদ্রাক্ষের মালা পরা লোকটার লেগাসির জন্য। শুধু উদ্ধব থ্যাকারে বা আদিত্য থ্যাকারের ক্যারিশমায় আজকের দিনে কি ৫৬টা আসন শিবসৈনিকরা পেতে পারে? তর্কের ব্যাপার। কিন্তু সে যেভাবেই হোক, পেয়েছে। এবং এবার হয়তো দু’টোই হচ্ছে—মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে ‘পরিবারে’র কেউ, আর শারদ পাওয়ারের সঙ্গে জোট। অন্তত এনসিপি প্রধানের দাবি মানলে তো তাই মনে হচ্ছে। কংগ্রেস ও এনসিপি থেকে একজন করে উপ মুখ্যমন্ত্রী। আর মুখ্যমন্ত্রী শিবসেনার। অর্থাৎ, বাল থ্যাকারে যে আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন... এই পরিবার ক্ষমতার রসায়নের মধ্যে ঢুকে পড়লে মানুষের মধ্যে থেকে সেই বিশ্বাসযোগ্যতাটা চলে যাবে, সেই ভাবনাটাও আজ অতীত হতে বসেছে। হয়তো উদ্ধব থ্যাকারে মুখ্যমন্ত্রী হবেন। কিংবা আদিত্য। আবার বিজেপিও কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে। মহারাষ্ট্রজুড়ে কেমন একটা ঘোড়া কেনাবেচার গন্ধ। এর উপর বিজেপি আরও বলছে, এখনও সেনার জন্য দরজা খোলা। হাতে ১১৯টি আসন নিশ্চিত। শিবসেনা জোটে যোগ দিতে চাইলে দিতেই পারে। কিন্তু তার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
এটা হল আপাতত মহারাষ্ট্রের পরিস্থিতি। যার কি খুব প্রয়োজন ছিল? উদ্ধবরা যদি মুখ্যমন্ত্রিত্বের দাবি নিয়ে প্রাণপণ দড়ি টানাটানি না করতেন, তাহলে এতদিনে মহারাষ্ট্রে সরকার গঠন হয়ে যেত। আসলে ৫৬টি আসন ঝুলিতে চলে আসার পর শিবসেনা ভাবল, এই তো সুযোগ। ১০৫টা আসন নিয়ে বিজেপি একা সরকার গঠন করতে পারবে না। শিবসেনা যদি সমর্থন না করে, তাহলে হয় কংগ্রেস কিংবা এনসিপির সঙ্গে ওদের জোট বাঁধতে হবে। যা সম্ভব নয়। ২৯টি নির্দলের সবাইকে রাজি করাতে পারলেও ম্যাজিক ফিগার ১৪৫-এ পৌঁছনো যাবে না। ব্যাস! শিবসেনা দাবিতে অনড়... মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারই চাই। পুরো পাঁচ বছর না হোক, আড়াই বছর হলেও চলবে। আর বিজেপির গোঁ, দেবেন্দ্র ফড়নবিশই মুখ্যমন্ত্রী হবেন।
শিবসেনা আসলে একটা বিষয় স্পষ্ট বুঝে গিয়েছিল... হয় এবার নয় নেভার। আর দর কষাকষির ঘোরে উদ্ধবরা ভুলে গিয়েছিলেন, তাঁরা আসলে দলের রাজনৈতিক অস্তিত্বের ভিতেই কুড়ুল মেরে দিয়েছেন। বিজেপির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে। অন্যদিকে, কংগ্রেস-এনসিপিও পুতুল নাচন নাচাচ্ছে। এমন অবস্থায় যদি সরকার গঠন না হয়ে মহারাষ্ট্রে ফের বিধানসভা ভোট করাতে হয়, তার দায় পুরোটাই চাপবে তাঁদের উপর। প্রত্যক্ষ দায় যদি সেনার হয়, বিজেপিও কিন্তু ধোয়া তুলসিপাতা হয়ে থাকতে পারবে না! কুমিরছানার মতো দিনের পর দিন তারা একটাই ছবি দেখিয়ে যাচ্ছে—‘সব ঠিক আছে’। বেকারত্ব, কমতে থাকা জিডিপি, বাজারে নগদের ঘাটতি, উধাও হয়ে যাওয়া শিল্প-সম্ভাবনা... তাও তাদের দাবি ‘সব কুছ ঠিক হ্যায়’। ভোটার কিন্তু বোকা নয়। আর লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনের গঠনতন্ত্রটাও আলাদা। প্রধানমন্ত্রী হবেন নরেন্দ্র মোদি। তার বিকল্প কোনও মুখ ভারতের ভোটাররা খুঁজে পাননি। তাই বিজেপিতেই ভোট-ভরসা। কিন্তু বিধানসভা নির্বাচন নিজের রাজ্যের ব্যাপার। ঘরের ব্যাপার। বিকল্প অনেক বেশি। ছবিটা পরিষ্কার, ওভার কনফিডেন্সের চোরাবালিতেই ডুবতে শুরু করেছে বিজেপি। তারা মনে করছে, যেখানে হাত দেব সোনা ফলবে। তা কিন্তু হচ্ছে না! তাই মহারাষ্ট্রে নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ ডজন ডজন সভা করেও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা জোগাড় করতে পারেননি। এখনও অমিত শাহ কী ভেবে রেখেছেন জানা নেই। ধরে নেওয়া যেতেই পারে কোনও প্ল্যান বি রয়েছে। আপাতত সেটা সামনে আসেনি। বরং শিবসেনা-এনসিপি-কংগ্রেসের মধ্যে নিত্য বৈঠক চলছে। ছকটা হয়েছে। এবার কাঠামোটা বানাতে হবে। যেনতেনপ্রকারেণ সরকার গড়তেই হবে—এই মনোভাব থাকলে বিজেপি কিন্তু শিবসেনাকে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার ছেড়ে দিত। তা তারা করেনি। বরং এনসিপি-কংগ্রেস তেমন একটা টার্গেট নিয়েই ময়দানে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। সোনিয়া গান্ধী স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছেন, সুযোগ যখন মিলেছে সদ্ব্যবহার করো। এখানেও আর একটা ‘কিন্তু’ রয়েছে। সেটা কী? ধরা যাক সরকার হয়ে গেল। তারপর? কেউ বলছে এই বিয়ে দু’বছর টিকলে হয়! তো কেউ বাজি ধরছে, ছ’মাসও টিকবে না। রাজনীতি যতটা অঙ্ক, তার থেকে অনেক বেশি রসায়ন। একের সঙ্গে অপর শরিকের সম্পর্কটা পাঁচ বছর ধরে ঠিক কতটা মধুর থাকবে, তার উপর নির্ভর করছে অনেক কিছু। ভুল হল, সব কিছু।
এবার প্রশ্ন হল উদ্ধব থ্যাকারের কি সেই রাজনৈতিক যোগ্যতা আছে? গত সাত বছর ধরে নিজেকে বাবার পর্যায়ে উন্নীত করতে পারেননি তিনি। বরং দলটাকে বাল থ্যাকারের লেগাসিতে মুড়েই চালিয়ে যাচ্ছেন। আর অনুসরণ করছেন বাল থ্যাকারের পলিসি। গ্রামের দিকে নজর। কম দামে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের প্রতিশ্রুতি, মারাঠা জাত্যাভিমান। বিজেপি যা বলতে বা করতে চেয়েছে, শিবসেনা তারই উল্টো গান গেয়ে ফড়নবিশ ও মোদি সরকারকে বিরক্ত করেছে। কখনও জনসমক্ষে বিবৃতি দিয়ে, তো কখনও ‘সামনা’র সম্পাদকীয়র মাধ্যমে। উদ্ধবের এখানেও একটা ঢাল রয়েছে। স্বয়ং বাল থ্যাকারে। দু’দশক আগে তাঁকে যখন ছেলে উদ্ধব এবং ভাইপো রাজের রাজনৈতিক অনভিজ্ঞতার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তিনি বলেছিলেন, ‘রাজীব গান্ধীও তো প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। ওঁর রাজনৈতিক যোগ্যতা কী ছিল?’ রাজীব গান্ধীকে ডুবিয়েছিল তাঁর একের পর এক মিস-অ্যাডভেঞ্চার। উদ্ধব যদি মুখ্যমন্ত্রী হন, তাহলে অন্যরকম কিছু হতেই পারে। হয়তো ভালো কিছু! সেটা সময় বলবে। কিন্তু মহারাষ্ট্রের নিরিখে দেশজুড়ে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা যে বেশ কিছুটা বিগড়ে গিয়েছে, সে নিয়ে সন্দেহ নেই। বিজেপিকে এখন আস্তিন থেকে নতুন কোনও তাস বের করতেই হবে। সেই তাস শুধু বিরোধী বা শরিক দলের জন্য হলে চলবে না। সেটা হতে হবে ভোটারকুলের জন্য।
এগুলো অবশ্যই পর্দার আড়ালে থাকা ছবি। সামনের ছবিটা হল, কংগ্রেস হাত মেলাচ্ছে শিবসেনার সঙ্গে। কট্টর হিন্দুত্ববাদী একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে। ক্ষমতায় থাকার জন্য যে কারও হাত ধরা যায়, এটাই আপাতত বিরোধী দলগুলির এজেন্ডা। শারদ পাওয়ারের মিষ্টি কথায় শিবসেনা কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্ব ছেড়েছে। লোকসভার অধিবেশনে তারা এবার বসছে বিরোধী বেঞ্চে। আর দূরেরটা দেখলে? বিজেপি কিন্তু শক্তি হারাচ্ছে। আরও সোজাভাবে বলতে গেলে শরিকরা সরে যাচ্ছে। শিবসেনা সরে যাওয়ার পর জেডিইউ ছাড়া তেমন শক্তিশালী শরিক আর এনডিএতে নেই। সংখ্যায় হয়তো প্রচুর, কিন্তু ভোটারদের মধ্যে তাদের প্রভাব ফেলার ক্ষমতা দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হবে। জয়ললিতা বেঁচে থাকাকালীন তাও এআইএডিএমকের কিছু জোর ছিল। এখন নেই। বিধানসভা ভোটগুলিতে শরিকহীনতার প্রমাণ পাচ্ছে বিজেপি। এই প্রবণতা আরও বাড়বে। মহারাষ্ট্রই তার পথনির্দেশক। বন্ধুসুলভ আচরণ নয়, শরিকদের উপর দাদাগিরিটাই মারাত্মক বেড়ে গিয়েছে বিজেপির। অভিভাবক হতে গেলে অনেক সহনশীল হতে হয়, ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। লোকসভায় তিন শতাধিক আসনে বলীয়ান বিজেপি সেসব রাজনৈতিক নীতিকথা ভুলেছে। প্রথম ইউপিএ সরকারের সময় ডিএমকে সুপ্রিমো এম করুণানিধি দেখা করতে এলে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং নিজে নেমে আসতেন পোর্টিকোয়। দাঁড়াতেন গাড়ির সামনে। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি। শরিক দলের নেতাকে গাড়ির দরজা থেকে অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে না গেলেও মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ত না। কিন্তু তিনি সেটাই করতেন জোট-রাজনীতির খাতিরে।
এটাই শিক্ষণীয়। আজ বিজেপির সঙ্গে শিবসেনার মতো শক্তিশালী বন্ধুর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার নেপথ্যে অবশ্যই শারদ পাওয়ার। সেই পাওয়ার, যিনি ’৮২ সালে টেক্সটাইল কর্মীদের ধর্মঘটে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছিলেন বালাসাহেব থ্যাকারের সঙ্গে। কিন্তু আদর্শে কট্টর বাল থ্যাকারে পরবর্তীকালে রাজনীতির মুদ্রায় শারদ পাওয়ারের উল্টো পিঠ হয়ে যান। যা কোনওদিন মিলতে পারে না। সেনা সুপ্রিমোর জীবদ্দশায় তা মেলেওনি। কিন্তু তাঁর উত্তরসূরিরা? পদবিটা এক হতে পারে। চরিত্র নয়। তাই এই শারদ পাওয়ারই এখন লেজে খেলাতে শুরু করেছেন শিবসেনাকে। নিন্দুকে বলছে, দিল্লি থেকে নির্ঘাত হুমকি এসেছে। এনসিপির অজিত পাওয়ার ও প্রফুল্ল প্যাটেল এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের জালে পড়েছেন। আয়কর দপ্তরের হানা শুরু হয়েছে। এর থেকে বাঁচতে গেলে কিছু তো আত্মত্যাগ করতেই হবে। তাই শারদ পাওয়ার শেষ মুহূর্তে কোনদিকে যান, সেটাই লাখ টাকার প্রশ্ন।
যদি বাল থ্যাকারে বেঁচে থাকতেন...!