কর্মপ্রার্থীদের কর্মলাভ কিছু বিলম্ব হবে। প্রেম-ভালোবাসায় সাফল্য লাভ ঘটবে। বিবাহযোগ আছে। উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় থেকে ... বিশদ
সাম্প্রতিক যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে তা হল এই পরীক্ষার ভাষা নিয়ে। অর্থাৎ প্রশ্ন কোন ভাষায় হবে? এই পরীক্ষাগুলোর উত্তর সাধারণভাবে লিখতে হয় না, চারটে বিকল্পের মধ্যে টিক মেরে নিজের মত জানাতে হয়। অল্প কিছু ক্ষেত্রে শুধু একটি দুটি শব্দে উত্তর লিখতে হবে। আর মোটের উপর এখন সব পরীক্ষাই কম্পিউটারে, আর তাই ইংরেজিতে বোতাম টেপাই দস্তুর। মূল গোলমাল প্রশ্নের ভাষা নিয়ে। আগে সাধারণভাবে ইংরেজি আর হিন্দিতে প্রশ্ন করা হতো। যারা আজকাল এই ধরনের পরীক্ষার প্রশ্ন বানান, অর্থাৎ ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সি (এনটিএ), তাঁরা এবার গুজরাতিতেও প্রশ্ন বানাচ্ছেন। এখানেই চটে গেছেন আমাদের রাজ্যের শাসক দল। গুজরাতে বিজেপির দাপট বেশি। সেই হিসেবে তৃণমূলের বক্তব্য যে, সেই ভাষায় প্রশ্ন হলে বাংলায় নয় কেন? আর বিজেপি বলছে যে পশ্চিমবঙ্গ থেকে রাজ্য সরকার আদৌ কোন উদ্যোগ নেয় নি। পরীক্ষা নিয়ামক সংস্থা এনআইটি দাবি করেছে যে যেকোনও রাজ্য সরকার তাদের কাছে বিশেষ ভাষায় প্রশ্নপত্র বানাতে বললে তারা উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবেন। গুজরাত সময়মত তাদের দাবি তুলেছিল, আর অন্য কোন রাজ্য কিছুই জানায় নি। গুজরাত সরকারের দাবি মেনে নিয়ে এবার তাই প্রশ্ন হবে গুজরাতিতে, ইংরেজি আর হিন্দি ছাড়াও। বিষয়টা এখন পড়াশোনার বাইরে বেরিয়ে পুরোপুরি রাজনীতির আঙিনায় পৌঁছে গেছে।
পড়াশোনা যে সবাইকেই করতে হবে এমনটা নয়। মেসি কিংবা রোনাল্ডো কলনবিদ্যার অঙ্ক কষতে পারেন কিনা তাই দিয়ে তাঁদের বিচার হয় না। তাঁদের ক্ষেত্রে তাঁরা মহান। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রেও সেকথা প্রযোজ্য। অসাধারণ ব্যুৎপত্তির সঙ্গে তাঁরা ভারতবর্ষের যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধরে রেখেছেন। কিন্তু রাজনীতিবিদদের প্রিয়জনেরাও বলবেন না তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগ পড়াশোনায় ভালো। অবশ্যই আমাদের রাজ্যে এবং দেশে উচ্চশিক্ষিত রাজনীতিবিদ কয়েকজন আছেন, তবে তার বাইরে বেশিভাগেরই মাধ্যমিকের অঙ্ক কষতে গেলে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হতে পারে। ঠিক যেমন অঙ্কের গবেষক রাগবি খেলতে গেলে হাড়গোড় ভাঙার সম্ভাবনা প্রবল। অর্থাৎ যার কাজ তারই করা সাজে। এবার এই ভাষা বিতর্কে পাড়ায় পাড়ায় যদি মিটিং মিছিল শুরু হয়, সেক্ষেত্রে পড়ুয়াদের উপর তা যথেষ্ট প্রভাব ফেলবে। দেশ বা রাজ্যে যে সমস্ত বিপুল অর্থনৈতিক দুর্নীতি হয়ে থাকে তাতে একটা বড় অবদান থাকে রাজনীতিবিদদের। রাজনীতির বড় মাপের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন বেসরকারি অর্থলগ্নি সংস্থার মালিকেরা, আর রাজনৈতিক কর্মীরা হয়ে যান অর্থসংগ্রহের এজেন্ট। তাঁরাই জনগণকে বোঝান যে ব্যাঙ্ক কিংবা পোস্ট অফিসে টাকা না রেখে বেসরকারি ব্যাঙ্ক বা শেয়ার মার্কেটে টাকা খাটাও। সাময়িকভাবে কিছু কাজের ক্ষেত্র হয়তো তৈরি হয়, কিন্তু শেষমেশ আমজনতা বিপদে পড়ে। ঠিক একই কথা সত্যি জেইই মেনস দিতে যাওয়া ছাত্রছাত্রীদের। পশ্চিমবঙ্গের যে সমস্ত ছাত্রছাত্রী এই ধরনের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসেন, তাঁরা মোটামুটি ভালোভাবেই ইংরেজি পড়তে পারেন। তার জন্যে কংগ্রেস, সিপিএম, তৃণমূল বা বিজেপির কোনও কৃতিত্ব নেই। সারা দেশের মধ্যে বাঙালিরা যে শিক্ষা সংস্কৃতিতে বেশ এগিয়ে আছে সেটা বোঝার জন্যে প্রচুর পরিসংখ্যান আছে, যেগুলো জায়গামতো ছাপা হয় না। বিশেষ করে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এরাজ্যের ছেলেমেয়েরা ঐতিহ্যগতভাবে ভালো, ঔপনিবেশিক কারণে ইংরেজিতেও। সেখানে জেইই মেনসের মতো পরীক্ষার প্রশ্ন বাংলায় করতে হবে বলে বাংলার পরীক্ষার্থীদের না গুলিয়ে দেওয়াই মঙ্গল। তাঁরা ইংরেজিতে প্রশ্ন পড়েই পরীক্ষা দেন, এ রাজ্যে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ইংরেজিতে বিজ্ঞান বোঝার মত পরিকাঠামো আছে, আর যাঁরা এই ধরনে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সত্যি সফল হন তাঁদের ইংরেজিতে প্রশ্ন বুঝতে এতটুকু অসুবিধে হয় না।
আসলে বিজ্ঞানের কোনও ভাষা নেই। পুরোটাই যুক্তির খেলা। বিজ্ঞান বা অঙ্ক যেখানে যুক্তি দিয়ে কোনও কিছুর সমাধান করতে পারে না, সেখানে সে নিজের অসম্পূর্ণতার কথা স্বীকার করে নেয়। যুগে যুগে বিবর্তিত হয় বিজ্ঞান। গে লুসাকের পরমাণু সংক্রান্ত তত্ত্ব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন ডালটন। আবার তার পরে ডালটনের পরমাণুবাদ ভুল প্রমাণিত হয় অ্যাভোগ্রাডোর তত্ত্বের মাধ্যমে। সময়ের সঙ্গে বিজ্ঞান উন্নততর হয়, মানুষ শেখেন সঠিক উত্তর। ধর্ম আর রাজনীতি সেখানে পুরো চড়াই উৎরাইয়ের রাস্তায় চলে। সেখানে আজ যেটা সত্যি তা পরের মূহূর্তেই মিথ্যে হয়ে যায়। বিজ্ঞানের নাম করে মাটির তলায় মন্দির ছিল নাকি বৌদ্ধিক স্তূপ, তাই নিয়ে অগভীর বিশ্লেষণ ডানা মেলে। গ্যালিলিওকে থামিয়ে রাখা হয় ধমকে। এদিকে পশ্চিমবঙ্গের বাম আমলে ঘোষিত হয় “মার্কসবাদ সর্বশক্তিমান, কারণ এটাই সত্য”। এটা যে চরম সত্য নয় সেকথা মার্কস সাহেবই বলে গিয়েছিলেন, বাংলার বাম বুঝলো উল্টো। ঠিক সেই রকমই ধর্ম, রাজনীতি এবং ভাষার সরবত বানানো নিয়ে রাজ্যে লড়াই করছে বিজেপি আর তৃণমূল। কেন্দ্রীয় পরিসরে কংগ্রেস ধান্দা করছে কীভাবে নরম হিন্দুত্বের কথা বলে দুদিকই সামলানো যায়। মুশকিল হল রাজনীতির কারবারিরা সবসময় দাবি করেন যে তাঁরা সত্যি কথা বলছেন। এইখানেই সবথেকে বড় মিথ্যে। ঠিক সেইরকমই গুজরাতি বা বাংলায় প্রযুক্তিবিদ্যার প্রবেশিকা পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়টিতে পরীক্ষার্থীদের কোনও সুবিধে নেই। পুরোটাই আপাতত বিজেপি আর তৃণমূলের ভাষাভিত্তিক লড়াই। এখানে বিজ্ঞানের ভাষা বিপর্যয়ের প্রশ্নই নেই। শুধু বাংলায় কেন, গুজরাতের পরীক্ষার্থীদেরও বুঝতে হবে যে বিজ্ঞানের বেশিরভাগ ভালো বই-ই ইংরেজিতে লেখা। সেগুলো মন দিয়ে পড়লে সাফল্যের সম্ভাবনা বেশি। আর কয়েকমাসের মধ্যেই জেইই মেনস। এই সময় ছাত্রছাত্রীদের চিত্তবিক্ষিপ্ত না হওয়াই ভালো।
সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, রাজনীতিতে যে শিক্ষিত মানুষজন আছেন তাঁদের তো আর সোনা মেশানো দুধ গণেশকে খাইয়ে দিন চলবে না। তাঁরা দায়িত্ব নিন সারা দেশে যেন ভালো করে ইংরেজি পড়ানো হয়। তাতেই নেওয়া হোক উচ্চমাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞানের সব পরীক্ষা। অঙ্কে অসমীকরণের সমাধান করতে কয়েকটা চিহ্ন লাগে মাত্র। সেখানে অজানা চলরাশি ইংরেজির এক্স ধরা হয়, বাংলার ক-এ মধ্যন্য-শয়ে ক্ষিও নয়। যেভাবে বিজ্ঞান এগিয়েছে তাকে বাম কিংবা দক্ষিণপন্থার সমাজনীতি, কিংবা ভাষার সুড়সুড়ি দিয়ে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। বাংলা ভাষা নিয়ে রাজ্যের রাজনীতিবিদদের বেশি না ভাবাই মঙ্গল। সেক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের আত্মা ভয় পেয়ে বাংলা ছেড়ে অযোধ্যার রামমন্দিরের তলায় গিয়ে সেঁধোবে। উপসংহারে সারা দেশের সমস্ত উচ্চমাধ্যমিক স্তরের পড়ুয়াদের শুভেচ্ছা, আর অনুসিদ্ধান্ত হল আমাদের দেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে ইঁরেজিতে বিজ্ঞান শেখাটাই সাফল্যের এক প্রাথমিক ধাপ। জেইই মেনসে আর সব ভাষায় প্রশ্ন করা বন্ধ করে শুধু রাখা হোক ইংরেজি। দু-একটি ব্যতিক্রমী উদাহরণ দিতে গেলে শুধু তামিল, তেলুগু, ওড়িয়া, অসমীয়া নয়, কোনও এক দিন অলচিকি-তেও জেইই মেনসের প্রশ্ন করার দাবি উঠবে!
লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত