কর্মপ্রার্থীদের কর্মলাভ কিছু বিলম্ব হবে। প্রেম-ভালোবাসায় সাফল্য লাভ ঘটবে। বিবাহযোগ আছে। উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় থেকে ... বিশদ
দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির: কালীপুজো উপলক্ষে অন্তত দশদিন আগে দেবী মায়ের অঙ্গরাগ শুরু হয়। কালীপুজোর দিনে ভোরে বিশেষ মঙ্গল আরতিই পুজোর প্রধান আকর্ষণ। এছাড়া রয়েছে ঘট স্নান। যে ঘটটি মন্দিরে থাকে সেটিকেই গঙ্গায় নিয়ে গিয়ে নতুন করে জল ভরে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়। কালীপুজোর রাতে এখানে ডাবের জল দিয়ে পুজোর নিয়ম রয়েছে। শ্রীরামকৃষ্ণ প্রদর্শিত পথেই দেবীর আরাধনা হয়। কালীপুজোর রাতে জাঁকজমকপূর্ণ পুজোয় থাকে নানাবিধ ভোগ-উপচার। সাদাভাত, ঘি, পাঁচরকমের ভাজা, শুক্তো, তরকারি, চার থেকে পাঁচরকমের মাছের পদ, চাটনি, পায়েস আর মিষ্টি নিবেদন করা হয়। সেদিন মন্দির চত্বর সারাদিন খোলা থাকে। পুজো শেষের পর মায়ের ভোগ ভক্তদের হাতে হাতে দেওয়া হয়। কালীপুজোয় বলিপ্রথা বন্ধ। ভবতারিণী মাকে অন্যান্য দিনের মতো বেনারসি পরানো হয়। পরানো হয় সোনার অলঙ্কার। সোনার বাউটি, বালা, তাবিজ, বাজু, গলায় চিক, মুক্তোর সাতনর মালা, বত্রিশনর, তারাহার, সোনার মুণ্ডমালা। মাথায় মুকুট। কানে কানবালা, কানপাশা, ঝুমকো। নাকে নোলক ও নথ। এছাড়াও অন্যান্য বহু অলঙ্কারে সুসজ্জিত হন মা। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের একটি বিশেষ বিষয় হল এখানে মা সারাবছর বেনারসি শাড়ি পরিধান করেন। কোনও ভক্ত যদি দিতে চান তাহলে আজকের দিনের হিসেব অনুযায়ী প্রায় সতেরো-আঠারো বছর পর তা মাকে পরানো হবে। তবে তার আগে চিঠি দিয়ে তাঁকে বা তার পরিবারকে জানানো হয়।
ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি: বিধান সরণীতে অবস্থিত ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি। সারাবছর ভক্ত সমাগম এখানে লেগেই থাকে। প্রায় তিনশোর বেশি বয়েসের পুরনো এই মন্দির। এখানে রামকৃষ্ণদেব নিজে আসতেন। শিষ্য কেশবচন্দ্র সেন অসুস্থ থাকার সময় তিনি ডাব আর চিনি দিয়ে সিদ্ধেশ্বরী মাকে মানত করে পুজো দিয়েছিলেন। দীপান্বিতা কালীপুজোর জন্য কৃষ্ণাপঞ্চমীতে মাকে বেদি থেকে নামানো হয়। সে সময় দেবীর অঙ্গরাগ হয়। ধন ত্রয়োদশীতে ‘মা’কে পঞ্চমুণ্ডির আসনে আবার প্রতিষ্ঠা করা হয়। কালীপুজোর দিন পরানো হয় দুর্মূল্য বেনারসি শাড়ি। এছাড়া নানা অলঙ্কারে সাজানো হয় বিগ্রহকে। কালীপুজোর দিন ঠনঠনিয়া মন্দিরে সাজ সাজ রব। বিশাল আয়োজন। ভূতচতুর্দশীতে মা সিদ্ধেশ্বরীকে সাজানো হয় রাজরাজেশ্বরী রূপে। দেবীর মাথায় নটি রুপোর ছাতা, মুকুট, কানপাশা, বালা, কঙ্কণ, মানতাসা, সীতাহার তোড়া সহ নানা অলঙ্কারে সুসজ্জিতা করা হয়। মন্দিরের বহু বছরের পুরনো সেবায়েত গুণময় ভট্টাচার্যের কথায় মায়ের রাজরাজেশ্বরী বেশ দেখার জন্য দূরদূরান্ত থেকে ভক্তরা ছুটে আসে। এদিন মঙ্গলারতি হয় ভোর চারটেয়। রাতে নিরামিষ ভোগ হয়। ভক্তরা কুপন কাটলে মায়ের প্রসাদ পেতে পারেন। কালীপুজোর বিশেষ ভোগে থাকে লুচি, তিন থেকে পাঁচরকম ভাজা, আলুর দম, ধোঁকার ডালনা, ও নানা ধরনের মিষ্টি। আজও এই মন্দিরে বলিদান হয়। পুরোহিত গুণময় ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, কালীপুজোর দিন বা অন্যান্য সময়ে ভক্তদের দেওয়া সমস্ত উপচার মাকে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে নিবেদন করা হয়।
ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি: প্রথম এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয় শিবমন্দির হিসেবে। পরবর্তীকালে অ্যান্টনি সাহেবের হাত ধরে আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিনশো থেকে চারশো বছর আগে মায়ের মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই নামানুসারে এবং ফিরিঙ্গি পাড়া হিসেবে এই মায়ের মন্দিরের নাম হয়ে যায় ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি। হিন্দু ব্রাহ্মণ বিধবা নারী সৌদামিনির সঙ্গে বিয়ের পর সাহেব ক্রমশ হিন্দু ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। চর্চাও বেড়ে যায়। এরপর তিনি কবিগানও গাইতে শুরু করেন। মন্দিরের বর্তমান সেবায়েত সুদর্শন বিরাজ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে এই সুপ্রাচীন ইতিহাস শুনতে খুব ভালো লাগছিল। দীপান্বিতা অমাবস্যায় এই মন্দিরে বিশেষ পুজোপাঠ চলে। যার তোড়জোড় শুরু হয় লক্ষ্মীপুজোর পর থেকেই। মন্দির সাফসুতরো ও রং হয়। অঙ্গরাগ শুরু হয়ে যায় দেবীর। চলে সাত দিন ধরে। কালীপুজোর আগের দিন মাকে সাজিয়ে বেদিতে তোলা হয়। জমকালো শাড়িতে ও গয়নায় সুসজ্জিত করা হয়। নতুন রূপে, নতুন সাজে মায়ের রূপ দেখে মোহিত হয় দর্শনার্থীরা। সোনা, রুপোর মায়ের যত গয়না আছে মুকুট, বালা, চূড়, শাঁখা, পলা, হার, নাকের নথ, সোনা ও রুপোর মুণ্ডমালা, পায়ের নূপুর সবই মাকে পরানো হয়। সেবায়েতের তরফ থেকে শাড়ি পরানো হলেও ভক্তদের দেওয়া বিশেষ বিশেষ শাড়ি প্রায় একুশটা মতো শাড়ি মাকে পরানো হয় পর্যায়ক্রমে। এছাড়াও বাদবাকি সমস্ত শাড়ি ঘটে ও মায়ের চরণে নাম-গোত্র ধরে নিবেদন করে পুজো করা হয়। ওইদিন পঞ্চব্যঞ্জনসহ অন্ন ভোগ দেওয়া হয়, পোলাও, খিচুড়ি, সাত থেকে ন’রকম ভাজা, তরকারি দু’রকম, পায়েস এবং ন’রকমের মিষ্টি। সর্বসাধারণের মধ্যে পুজো শেষে ভোগ বিতরণ করা হয়। পরের দিন থাকে অন্নকূট মহোৎসব।
কালীঘাট মন্দির: একান্ন শক্তিপীঠের অন্যতম হিন্দু তীর্থক্ষেত্র এই কালীঘাট মন্দির। পৌরাণিক কিংবদন্তি অনুসারে, সতীর দেহত্যাগের পর তাঁর ডান পায়ের চারটি (মতান্তরে একটি) আঙুল এই তীর্থে পড়ে। এই তীর্থের পীঠদেবী দক্ষিণাকালী এবং ভৈরব বা পীঠরসক দেবতা নকুলেশ্বর। কালীঘাট মন্দির আটচালা গড়নের। মন্দিরের চূড়ায় তিনটি কলস। মাঝেরটিতে একটি পতাকা ও ত্রিশূলের অবস্থান। শিব ও শক্তির বর্ণময় সমারোহ কালীঘাটের মন্দির শীর্ষে। মন্দিরটি ছটি ভাগে বিভক্ত। ষষ্ঠীতলা, নাটমন্দির, জোড়বাংলা, হাড়িকাঠতলা, রাধাকৃষ্ণ মন্দির এবং কুণ্ড পুকুর। বড়িশার বিখ্যাত জমিদার সাবর্ণ রায়চৌধুরিদের বংশধরদের উদ্যোগে বর্তমান মন্দিরটি নির্মিত হয়। তবে আদি মন্দিরটি কত পুরনো তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে।
দীপান্বিতা অমাবস্যায় কালীঘাটের মহাকালীকে পুজো করা হয় লক্ষ্মীরূপে। কালী নয়, লক্ষ্মীকেই মূর্তির মধ্যে প্রত্যক্ষ করার রীতি এই শক্তিপীঠে। সারারাত ধরে চলে মা লক্ষ্মীর আরাধনা। নিত্যপূজার সঙ্গে ঘোর অমানিশার রাতে রাজবেশে অপরূপা সাজে আবির্ভূতা হন দেবী কালিকা। এদিনও দেবীর নিত্যপূজায় কোনও পরিবর্তন হয় না। খুব ভোরে দেবীকে জাগিয়ে মঙ্গলারতি করা হয়। দুপুরবেলা দেবীকে আরতি করে ভোগ নিবেদন হয়। নিত্যদিনের ভোগ হিসেবে থাকে বেগুনভাজা, পটলভাজা, কপি, আলু ও কাঁচকলা ভাজা, ঘিয়ের পোলাও, ঘি ডাল, শুক্তো, শাকভাজা, মাছের কালিয়া, পাঁঠার মাংস ও চালের পায়েস। অসংখ্য পাটকাঠি জ্বেলে মন্দিরকে তিনবার প্রদক্ষিণের পর শুরু হয় মায়ের রাত্রিকালীন পুজো। রাতে নিরামিষ ভোগ দেওয়া হয় লুচি, বেগুনভাজা, আলু ভাজা, জ্বাল দেওয়া দুধ, ছানার সন্দেশ আর রাজভোগ। কালীপুজোর রাতে মায়ের অঙ্গসজ্জায় চোখ ধাঁধানো রূপ। লাল বেনারসি, জরিপাড়ের শাড়িতে সিঁদুর পরিয়ে রাজবেশ ধারণ করানো হয়। সোনার অলঙ্কার আর ফুলের সাজে মায়ের তখন মোহময়ী মহামায়া রূপ। কষ্টিপাথরের এই মূর্তির জিভ, খাঁড়া, মুণ্ডমালা সব সোনার। ভক্তদের দেওয়া অলঙ্কার, শাড়ি, ফুল, মালা ভোগ সবই নিবেদন করা হয় দেবী কালিকাকে।
বাগবাজার ভবতারিণীর মন্দির: শোভাবাজার রাজবাড়ি থেকে দানপত্র হিসেবে এই মন্দিরটি পেয়েছেন বাগবাজার নিবাসী মুখোপাধ্যায় পরিবার। প্রায় তিনশো বছরের পুরনো। পূর্বপুরুষ কালীকিঙ্কর মুখোপাধ্যায়, অমূল্যরতন মুখোপাধ্যায়, পরেশনাথ মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে বর্তমানে কেদারনাথ মুখোপাধ্যায় আর অমরনাথ মুখোপাধ্যায় চারপুরুষের মন্দির। সকাল সাড়ে ছ’টা থেকে দুপুর একটা অবধি খোলা থাকে। আবার বিকেল সাড়ে চারটে থেকে রাত সাড়ে ন’টা। সারা বছর পুজোপাঠ লেগে থাকে। এই ভবতারিণী মায়ের অঙ্গরাগ অন্যান্য মন্দিরের মতো কালীপুজোর আগে হয় না। অঙ্গরাগ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায় মহালয়ার আগে থেকেই। সারাবছর অমাবস্যার পুজো দিনেরবেলা হয়। শুধু কালীপুজো আর ফলহারিণীপুজো রাতে পুজো হয়। রাত এগারোটা থেকে ভোর তিনটে অবধি অমাবস্যা তিথি অনুযায়ী পুজো চলে। মা তো রাজরাজেশ্বরী তাই উনি বেনারসি পরেন। দুর্গাপুজো থেকেই মাকে সুন্দর করে সাজানো হয়। একেকদিন চার পাঁচখানা শাড়ি হয়। ভক্তরা কামনা-বাসনা পূর্ণ হলে মাকে দেয়। কালীপুজোর দিন ভক্তদের দেওয়া সব শাড়ি মাকে দেওয়া হয়। বারোমাসই মা বেনারসি পরেন। এক ভক্ত প্রতি মাসে তিরিশ তারিখে এসে বেনারসি দিয়ে যান। কালীপুজোর দিন ও মন্দির প্রতিষ্ঠার দিনে মায়ের বিশেষ ভোগ হয়। খিচুড়ি, পোলাও, বেগুনি, আলুরদম, ফুলকপির কোর্মা, ন’রকমের ভাজা, মিষ্টি, খেজুর-আমসত্ত্বের চাটনি, পায়েস। প্রত্যেক মাসের মঙ্গলবার ঘটের ডাব পাল্টানোর রীতি। শীতলা মন্দিরও রয়েছে। শীতলা মন্দিরও খুব জাগ্রত। মন্দির থেকে শাড়ি, চাদর দুঃস্থদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। কালীপুজোর দিন ভোররাত থেকে পরের দিন পর্যন্ত সবাইকে প্রসাদ দেওয়া হয়।