কর্মপ্রার্থীদের কর্মলাভ কিছু বিলম্ব হবে। প্রেম-ভালোবাসায় সাফল্য লাভ ঘটবে। বিবাহযোগ আছে। উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় থেকে ... বিশদ
ঐতিহাসিক যুগে দেবী মহিমা লোকজীবনে এক বিরাট স্থান অধিকার করে রয়েছে। গুরু রামদাস স্বামীর নির্দেশে ছত্রপতি শিবাজী তুলজাপুরে শিউনার দুর্গের মধ্যে আদ্যাশক্তি ভবানীদেবীর সাধনায় রত হয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্ররূপিণী দেশজননীর শক্তি ও প্রেরণা লাভ করে অশুভ শক্তির দমনে এক মহান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। আবার এই দেবী কালিকাই চিতোরেশ্বরী রূপে স্বাধীনতা রক্ষায় শৌর্যদীপ্ত রাজপুতবাসীগণের আরাধ্যা হয়ে উঠেছিলেন। বাংলার বীর প্রতাপাদিত্য স্বদেশ রক্ষায় পীঠদেবী যশোরেশ্বরী কালীমাতার বন্দনা করে বঙ্গমাতার শৃঙ্খল মোচনে মোগল বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। বঙ্গ-ভারতের নবযুগের দেশাত্মবোধের উদ্বোধনে আনন্দমঠ উপন্যাসে সাহিত্যসম্রাট ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের কম্বুকণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল মুক্তি সাধনার দীক্ষামন্ত্র, জাতির ঐক্য সাধনে অমোঘ মন্ত্র—‘বন্দেমাতরম্’। দেশমাতৃকা ও জগন্মাতৃকা মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল ঋষি-কবির উপলব্ধিতে। দেশমাতৃকার সোনার মন্দিরে মাতৃমন্ত্রের নবঋক্ ধ্বনিতে চিন্ময়ী মহাশক্তির আবরণ হয়েছিল উন্মোচিত। আর এই ‘বন্দেমাতরম্’ই আধুনিক ভারতের মাতৃবন্দনার মঙ্গলসূত্র। ‘বাহুতে তুমি মা শক্তি,/ হৃদয়ে তুমি মা ভক্তি/ তোমারি প্রতিমা গড়ি/ মন্দিরে মন্দিরে।’
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সাধন-ভূমি দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণী কালীমন্দিরেই হয়েছিল স্বামী বিবেকানন্দের অভ্যুদয়। যুগনায়ক বিবেকানন্দের চিন্তা ও চেতনায় বরাভয়দায়িনী মা কালীই হয়ে উঠেছিলেন দেশজননী ভারতবর্ষ। নূতন ভারত গঠনে দেশের যুবসমাজকে ডেকে বজ্রকণ্ঠে বলেছিলেন তিনি, ‘ভুলিও না তুমি জন্ম হইতেই মায়ের জন্য বলিপ্রদত্ত, ভুলিও না তোমার সমাজ সে বিরাট মহামায়ার ছায়া মাত্র।’—এই গরিমাময় মন্ত্রে দেশজননীর প্রাণ প্রতিষ্ঠায় স্বাদেশিকতার প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে শতশত মুক্তিপাগল সন্তানের প্রাণে-মনে সেদিন জাগ্রত হল স্বদেশ প্রেমের এক উত্তাল তরঙ্গ।
স্বামীজির বিখ্যাত কবিতা ‘নাচুক তাহাতে শ্যামা’ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাছে ছিল নবজীবন সঞ্চারের উৎস। নেতাজি সুভাষচন্দ্র এই কবিতার শেষ চার ছত্র প্রায়শই আবৃত্তি করতেন। চিরজাগ্রতা দেশজননীর অর্চনার মধ্য দিয়েই ঋষিবর শ্রীঅরবিন্দ আবিষ্কার করেছিলেন কোটি ব্রহ্মাণ্ড পালিনী মাতৃশক্তিকে। সুখপ্রদায়িনী জগন্মাতৃকা ও চরাচর বিহারিণী দেশমাতৃকাকে একীভূত করে ভারতবর্ষের মধ্যেই দেখলেন তিনি পরমানন্দ স্বরূপিণী পরমেশ্বরীর আবিষ্ট রূপ। স্বদেশমন্ত্রের মধ্যেই মহাকালিকার দর্শন। ১৯০৮ সালে স্বদেশি যুগে সেই তুমুল ঝড়ের মধ্যে আলিপুর বোমার মামলায় ধৃত হয়ে শ্রীঅরবিন্দ কারাগারের যে ঘরে নিক্ষিপ্ত হলেন, সেই ঘরে একটি কৌটোয় তিনি মাতৃতীর্থ দক্ষিণেশ্বরের মাটি এনে রেখেছিলেন। এক বছর পরে কারামুক্ত হয়ে তিনি ‘কারাকাহিনী’-তে লিখলেন, ‘দক্ষিণেশ্বরের মাটি’ কোন ভয়ঙ্কর তেজবিশিষ্ট স্ফোটক পদার্থের সমতুল্য বস্তু।’ বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস ‘আনন্দমঠে’ স্বদেশ প্রেমের যে পরিপূর্ণ চিত্র অঙ্কিত হয়েছিল, ১৯০৩ সালে ঋষি অরবিন্দ পরিকল্পিত ‘ভবানী মন্দির’ তার উজ্জ্বলতর প্রয়াস। ‘ভবানী মন্দির’ গড়ার আদেশ শ্রীঅরবিন্দ পেয়েছিলেন তাঁর নিজের কথায় ‘সূক্ষ্মদেহী শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের কাছ থেকে’।
অগ্নিতনয় নেতাজি সুভাষচন্দ্র নিরত থাকতেন মাতৃপুজো ও মাতৃবন্দনা করে ভারতের ক্ষাত্র শক্তিকে জাগ্রত করে পূর্ব গৌরবে প্রতিষ্ঠিত করতে। মাতৃমন্ত্রকে উপজীব্য করেই তিনি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন। নেতাজি ছিলেন কালীমায়ের ঐকান্তিক বন্দক। সুভাষচন্দ্রের দৃষ্টিতে কালীপুজো হচ্ছে দেশমাতৃকার পটভূমিকায় এক সার্থক ঐকতান। দক্ষিণ কলকাতার এলগিন রোডের বাড়িতে যখন তিনি গৃহবন্দি ছিলেন, তখন তিনি দক্ষিণেশ্বর থেকে ভক্তজনকল্পবল্লী ভবতারিণী মায়ের চরণামৃত, নির্মাল্য ও প্রসাদ আনিয়ে ছিলেন। তাঁর দেশব্রতী জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি দীপান্বিতা অমাবস্যায় শ্যামাপুজোর দিন। সবচেয়ে বড় ঘটনা—এই দেবীপুজোর পুণ্য তিথিতে ১৯৪৩ সালের ২১ অক্টোবর সিঙ্গাপুরে সর্বাধিনায়ক বীর সুভাষচন্দ্র আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রতিষ্ঠা করে স্বাধীন এক সরকার গঠন করেছিলেন। আজ থেকে ঠিক ৭৫ বছর আগের ভারত ইতিহাসে এক গরিমাময় প্রসঙ্গ।
ভারতমাতা যে স্বয়ং কালীমাতা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গানে তা পরিস্ফুট। ‘রানাপ্রতাপ’ নাটকে কবি লিখলেন, ‘চল সমরে দিব জীবন ঢালি—জয় মা ভারত জয় মা কালী।’
পরমা জননী এই মাতৃমূর্তির বাইরের রূপ দেখে ভীষণ, নিষ্ঠুর মনে হলেও অন্তরালে মায়ের মুক্তিদাত্রী মমতাময়ী রূপের কথা আমাদের চিন্তনীয় ও স্মরণীয়। তাই বিদ্রোহী কবি, মাতৃভক্ত কাজী নজরুল লিখেছেন: ‘(আমি) দেখছি যে বিপুল স্নেহের সাগরদোলে তোর আঁখিতে।/ কেন আমায় দেখাস মা ভয় খড়্গ নিয়ে মুণ্ড নিয়ে?/ আমি মা’র সেই সন্তান ভুলাবি মা ভয় দেখিয়ে?’
দেশ মৃন্ময়ী নয়, চিন্ময়ী। তাই সংহতির কবি নজরুলের প্রত্যয়:
‘এবার নবীন মন্ত্রে হবে জননী তোর উদ্বোধন
নিত্যা হয়ে রইবি ঘরে, হবে না তোর বিসর্জন।’