বিদ্যার্থীরা শুভ ফল লাভ করবে। মাঝে মাঝে হঠকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করায় ক্ষতি হতে পারে। নতুন ... বিশদ
রাসবিহারী বসুর স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল দুটি অধ্যায়ে বিভক্ত। ১৯১৫ সালের ১৫ মে পর্যন্ত একটি অধ্যায় যখন তিনি ছিলেন ভারতে এবং পরবর্তী অধ্যায় পি এন ঠাকুর নাম নিয়ে জাপানে তাঁর জীবনাবসান পর্যন্ত।
জাপানে থাকাকালীন দুই জাপানি মহিলা মা ও মেয়ে শ্রীমতি কোকো সোমা ও তোসিকা সোমা পরবর্তীকালে তোসিকা বসু রাসবিহারী বসুকে রক্ষা করার জন্য নিজেদেরকে উৎসর্গ করেছিলেন। নিজেদের জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁরা নিজেদের, ছেলেমেয়েদের কথা ভুলে শুধুমাত্র ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যে বিপ্লবী নিজের জীবন তুচ্ছ করে লড়াই করে চলেছেন তাঁরই পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন।
জাপানে থাকার সময়ে ইংরেজ দূতাবাস থেকে চাপ দেওয়া হতে থাকে জাপান সরকারকে, চর মারফত খবর নিয়ে ইংরেজদের দূতাবাস জানতে পারল যে, পি এন ঠাকুর আসলে রাসবিহারী বসু। তখন ইংরেজ দূতাবাস রাসবিহারী বসুকে জাপান থেকে বের করে দেবার জন্য চাপ দিতে থাকে। সেই সময় রাসবিহারী বসু মিঃ আইজু সোমার বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন।
আইজু সোমার স্ত্রী শ্রীমতি কোকো সোমা রাসবিহারী বসুকে ছেলের মতো স্নেহে আত্মগোপনে সাহায্য করতেন। ফলত, সোমা পরিবারের উপর পুলিসি নজরদারি শুরু হল, অত্যাচারও শুরু হল এবং সেটা চলতে লাগল ধারাবাহিকভাবে।
সেই সময় শ্রীমতি কোকো সোমা ভারতের স্বাধীনতার কথা ভেবে, ভারতের মঙ্গলের কথা ভেবে নিজের কথা ভুলে এমনকী নিজের বাচ্চার কথাও ভুলে গেলেন। একসময় স্নায়ুর চাপে নিজের শরীর খারাপ হতে লাগল, অপুষ্টি ও অযত্নে নিজের বাচ্চার মৃত্যু হল, শ্রীমতি কোকো সোমা অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন।
এই সময় ঘটল একটি ঘটনা। ১৯১৬ সালে ইংরেজ যুদ্ধ জাহাজ জাপ স্টিমারের ৬ জন জাপানির উপর নৃশংস অত্যাচার করে ও ধরে নিয়ে যায়। ফলে জাপ জনমত ইংরেজদের বিরুদ্ধে যায়, সেই সময় জাপান সরকার বিদেশ নীতি বদলাতে বাধ্য হয়।
ওই সময় রাসবিহারী বসু ছদ্মবেশে প্রকাশ্যে আসেন, সেটা ছিল ১৯১৬ সালের এপ্রিল মাস। শ্রীমতি কোকো সোমা রাসবিহারীকে অন্যত্র চলে যেতে বলেন এবং রাসবিহারী অন্যত্র চলে যান।
যাবার সময় অসুস্থ শ্রীমতি কোকো সোমার কাছে রাসবিহারী নিজে দেখা করতে যান এবং বলেন, ‘মাগো আমি জানি না আমি কীভাবে তোমায় ধন্যবাদ জানাব, শুধুমাত্র ভারতের কথা চিন্তা করে আমাকে বাঁচানোর জন্য তুমি তোমার প্রিয় শিশুটিকে হারিয়েছ, মাগো আমার কৃতজ্ঞতার ভাষা নেই।’
প্রত্যুত্তরে কোকো সোমা বলেছিলেন, উনি আমায় মা বলে ডাকছেন, তা শুনে আমার কথা সরল না, আমরা একে অপরের হাত ধরলাম। দু’জনের চোখ বেয়ে শুধু জল গড়াতে লাগল, কোকো সোমা বললেন, আমি আমার সন্তানকে হারিয়েছি বটে, কিন্তু পেয়েছি মহান ভারত আত্মার সান্নিধ্য। এই মহীয়সী রমণী বিদেশি হয়েও ভারতমাতার জন্য যে স্বার্থত্যাগ করলেন তা অবর্ণনীয়।
এবার বলব তারই কন্যা তোসিকো সোমার কথা।
রাসবিহারী বসু তো চলে গেলেন, কিন্তু ওঁকে কে বাঁচাবে এই চিন্তায় সোমা দম্পতির চিত্ত অস্থির হয়ে উঠল। ইতিমধ্যেই রাসবিহারীর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল মহাচীনের প্রথম অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট ডাঃ সান ইয়াৎ সেনের, সেই সময় তিনি ছিলেন দেশ থেকে নির্বাসনে। আলাপ হয়েছিল জাপানের একজন বিশিষ্ট দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদী নেতা প্রিন্স টায়োমার সঙ্গে। ঈঙ্গ জাপান জোট থাকা সত্ত্বেও তিনি মনে-প্রাণে চাইতেন যে ইংরেজদের শাসন থেকে ভারত মুক্তি পাক, স্বাধীন হোক। সেই সময় জাপানের রাজপরিবারের সন্তান টায়োমা, সোমা দম্পতিকে একটি প্রস্তাব দিলেন। সোমা পরিবারের বড় মেয়ে তোসিকা সোমা তখন স্কুলে পড়ে, তার সঙ্গে বসুর বিয়ের প্রস্তাব দেন টায়োমা। বসুকে সোমা পরিবার পুত্রবৎ স্নেহ করতেন কিন্তু তোসিকার সঙ্গে বসুর বিয়ের কথা কখনও ভাবেননি। অথচ বসুকে রক্ষা করার জন্য তোসিকা এ ঝুঁকিটা নিক, ভারতবর্ষের ৪০ কোটি মানুষের জন্য তোসিকা নিজের জীবন উৎসর্গ করুক এটি ছিল সোমা দম্পতির মনের ইচ্ছা। তাই তোসিকাকে একথা কোকো সোমা বললেন। কিন্তু অপ্রস্তুত তোসিকা, সে একমাস সময় চাইল। বসুকেও তার জীবন রক্ষার্থে বিবাহের কথা বলা হল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও নানা চিন্তা করে রাসবিহারী বসু রাজি হলেন।
তোসিকা একমাস পর প্রস্তাবে সম্মতি দিলেন। তখন টায়োমা ও তোসিকোর দাদা তিকাকো বিয়ের সব ব্যবস্থা করলেন। বাবা আইজু সোমা তোসিকার সঙ্গে রাসবিহারী বসুর বিবাহ দিলেন ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের ৯ জুলাই।
তারপর দীর্ঘ ৮ বছর ধরে ঘাতকদের হাত থেকে বসুকে বাঁচানোর জন্য তোসিকাকে ১৭ বার বাড়ি বদল করতে হয় এবং রাসবিহারী বসুকে লুকিয়ে রাখতে হয়।
১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ১৩ আগস্ট জন্ম হয় পুত্র মাশাহিদে যার ভারতীয় নাম ভারতচন্দ্র, ১৯২২-এর ১৪ ডিসেম্বর জন্ম হয় মেয়ে তেৎসুকোর। ১৯২৩ সালের ২ জুলাই জাপানের নাগরিকত্ব পান রাসবিহারী বসু এবং তিনি প্রকাশ্য জীবনে আসেন। কিন্তু হায়, প্রচণ্ড উত্তেজনায় ও স্নায়ুর চাপে তোসিকার শরীর ভেঙে পড়ল, সুখ তোসিকার জীবনে কোনও দিনই এল না। ২৮ বছর বয়সে ২টি সন্তান রেখে তোসিকা অমৃতলোকে যাত্রা করলেন।
একজন মহীয়সী রমণী ও একজন স্নেহময়ী মা যাঁরা বিদেশিনী হয়েও এবং বিদেশের মাটিতে থেকেও ভরতকে, ভারতের জনগণকে এতই ভালোবেসেছিলেন যে নিজেদের জীবন তুচ্ছ করেও তাঁরা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রণ করেন। সক্রিয়ভাবে যোগ না দিয়েও পরোক্ষে কাজ করেন। নিজেদের সংসার ও সন্তানকে তুচ্ছ করতেও দ্বিধা করলেন না। তাই ভারতদরদি সোমা কোকো ও তোসিকা কোকো চিরকাল আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন। অক্ষয় হয়ে থাকবে তাঁদের কীর্তি।