বিদ্যার্থীরা শুভ ফল লাভ করবে। মাঝে মাঝে হঠকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করায় ক্ষতি হতে পারে। নতুন ... বিশদ
এই বিধবা বিবাহ প্রচলন নিয়ে একটি ঘটনার উল্লেখ করা প্রয়োজন। ছোটবেলায় রাইমণি নামে খেলার সঙ্গিনী ছিল বিদ্যাসাগরের। রাইমণিকে ভালোবাসতেন তিনি। রাইমণির খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। কিছু বছর পরে বিধবা হয়ে একমাত্র সন্তান গোপালকে নিয়ে নিজের গ্রাম বীরসিংহে ফিরে আসে রাইমণি। বিদ্যাসাগরও গ্রামে ফিরে একদিন খোঁজ নিতে গিয়ে দেখেন রাইমণি শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সেদিন ছিল একাদশী। সারাদিন রাইমণির উপবাসের করুণ চিহ্ন প্রত্যক্ষ করে বিদ্যাসাগরের মনে একদিকে যেমন বৃষ্টির মতো কান্না ঝরছিল তেমনি অন্যদিকে আগুনও জ্বলছিল। তিনি অনুভব করেছিলেন হিন্দু বাল্য বিধবাদের বৈধব্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে হলে প্রয়োজন তাদের পুনর্বিবাহ। শুরু হয় বিদ্যাসাগরের লাগাতার আন্দোলন।
রামমোহন রায় জ্বলন্ত চিতার আগুন থেকে বিধবাদের ফিরিয়ে এনেছিলেন। কিন্তু সংসার আর সমাজের নির্মমতায় তারা প্রতিদিন দগ্ধ হচ্ছিল। সেই চিতার আগুন নেভানোর উদ্দেশ্যে বিধবা বিবাহের কাজে নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করতে এগিয়ে এলেন বিদ্যাসাগর।
তিনি বুঝেছিলেন ধর্মের, সমাজের শাস্ত্রের গোঁড়ামি শাস্ত্র দিয়েই ভাঙতে হবে। শাস্ত্র ঘেঁটে ‘পরাশর সংহিতা’ থেকে বিধবা বিবাহের পক্ষে অকাট্য যুক্ত পেলেন। সেই যুক্তির নিরিখে বিধবাদের বিয়ের পক্ষে দুটি বই লিখলেন। এছাড়াও পত্র-পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে বিধবা বিবাহের সপক্ষে জনমত গঠন ও সেইসঙ্গে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। আইনের মাধ্যমে বিধবা বিবাহকে বৈধ করার লক্ষ্য নিয়ে ৯৮৭ জনের সই সংগ্রহ করে বিদ্যাসাগর আবেদনপত্র জমা দিলেন তৎকালীন ভারত সরকারের কাছে। তাঁর আবেদনপত্রের প্রবল বিরোধিতা করলেন সনাতন পন্থী হিন্দুরা। রক্ষণশীল সমাজের নেতা রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বে ৩৬,৭৬৩ জনের সই সংগ্রহ করে পাল্টা আবেদনপত্র ভারত সরকারকে জমা দিলেও বিদ্যাসাগরের যুক্তির কাছে হার মানল বিরোধীদের আবেদন।
রাধাকান্ত দেব কলকাতার শোভাবাজার রাজবাড়িতে পণ্ডিতসভা ডাকলেন। সেখানে তীব্র বাদানুবাদ হল বিদ্যাসাগর ও পণ্ডিত ব্রজনাথ বিদ্যারত্নের মধ্যে। বিদ্যাসাগর শাস্ত্রের ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছেন পণ্ডিতরা তা প্রমাণ করার জন্য জোর সওয়াল করলেন। তবু ব্যর্থ হলেন তাঁরা। রাধাকান্ত দেব এই বিধবা বিবাহে সমর্থন না করলেও বিদ্যাসাগরের যুক্তিতে মুগ্ধ হয়ে এক জোড়া শাল তাঁকে দেন। অবশেষে ১৮৫৬ সালের ২৬ জুলাই হিন্দু বিধবা বিবাহ বৈধ বলে আইন পাশ হল। সেই পরিপ্রেক্ষিতে গ্রামবাংলায় নানা আলোচনা, সভা হতে লাগল। এছাড়া ব্যঙ্গ, কবিতা, নাটক, নকশা, গল্প, পালা-গান রচনা হল।
বাংলাদেশের যেন এক নতুন যুগের সৃষ্টি হল। যাঁরা সমাজের ভয় করত তাঁরাও এগিয়ে এসে বিধবা বিবাহকে সমর্থন জানান। উমেশ চন্দ্র মিত্র লিখলেন বিধবা বিবাহ নাটক। প্রথমে সিঁদুর পাটির গোপাল মল্লিকের বাড়ি, পরে পাইকপাড়ার রাজবাড়িতে সেই নাটকের অভিনয় হল। যার উদ্যোক্তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কেশবচন্দ্র সেন। বিধবা বিবাহ নাটকের অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন ব্রাহ্মধর্মাবলম্বীরা। নাটক বেশ কয়েকবার দেখেন স্বয়ং বিদ্যাসাগর।
তাঁর উদ্যোগেই আয়োজিত হয় শ্রীশচন্দ্র-কালিমতীর ঐতিহাসিক বিধবা বিবাহ। যা ছিল ভারতে প্রথম। ১৮৫৬ সালের ৭ ডিসেম্বর, বাংলা ১২৬৩ সালের ২৩ অগ্রহায়ণ বিবাহ আসর নির্দিষ্ট হয়েছিল কলকাতার সুকিয়া স্ট্রিটের রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি।
কালিমতী ছিল বাল্য বিধবা। বাল্য বিধবাদের জীবনধারণ ছিল মৃত্যুযন্ত্রণার চেয়েও বেশি। সেই সময় অকাল বৈধব্য ছিল মেয়েদের জীবনে নিত্যসঙ্গী। তখনই বাল্য বিধবাদের ওপর খাদ্যাখাদ্য নিয়ে নানা বিধিনিষেধের পাশাপাশি পোশাক, অলঙ্কার পরার কড়াকড়ি থাকত। তবে সবচেয়ে নিষ্ঠুরতা ছিল অমাবস্যা, পূর্ণিমার উপবাস ও নির্জলা-একাদশী পালনের মতো পাশবিক নিয়মকানুন।
বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালীন সেই কলেজের মেধাবী ছাত্র ছিল শ্রীশচন্দ্র। শ্রীশচন্দ্র ২৬ বছর বয়সে বাল্য বিধবাকে পুনর্বিবাহ করার মতো কাজে ব্রতী হন।
বাংলার লাটসাহেব স্যার ফ্রেডেরিক হ্যালিডেও এই বিবাহ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ঐতিহাসিক ঘটনাটির সাক্ষী হিসাবে। এ ছাড়া বিবাহ বাসর উজ্জ্বলতর হয়েছিল প্যারিচাঁদ মিত্র, কালিপ্রসন্ন সিংহ, শম্ভুনাথ পণ্ডিত, রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ, রাজা দিগম্বর মিত্র, বিচারক হরচন্দ্র ঘোষ, দ্বারিকানাথ মিত্র প্রমুখের উপস্থিতিতে।
বিধবার বিয়ে দিয়ে এক অসাধ্যসাধন করলেন বিদ্যাসাগর। আর কোনও ক্রমেই বিধবা বিবাহ বন্ধ করতে না পেরে হিন্দু সমাজপতিরা রাগে অন্ধ হয়ে শ্রীশচন্দ্রকে সমাজ থেকে পতিত ঘোষণা করেন। এদিকে ধর্মান্ধরা আইনের বিচারে হেরে গিয়ে বিদ্যাসাগরকে রাতের অন্ধকারে কলকাতার ঠনঠনিয়ার কাছে গুন্ডাদের দিয়ে মারার চেষ্টা করে। কিন্তু বিদ্যাসাগরের সঙ্গী বীরসিংহের লাঠিয়াল শ্রীমন্ত সেই গুন্ডাদের হটিয়ে দেয়।
বিদ্যাসাগর গোটা নারীসমাজকে পথ দেখিয়ে নিজেও কিন্তু পিছিয়ে থাকলেন না। নিজের একমাত্র ছেলে নারায়ণ চন্দ্রর বিয়ে দিয়েছিলেন ভবসুন্দরী নামে এক বিধবার সঙ্গে। গ্রামের প্রতিবেশী ও আত্মীয়রা বিয়েতে না এলেও বিদ্যাসাগরের সংগ্রাম সফল ও সার্থক হয়েছে। বিদ্যাসাগর বলেছিলেন— ‘আমি দেশাচারের নিতান্ত দাস নহি, নিজের বা সমাজের মঙ্গলের নিমিত্ত যাহা উচিত বা আবশ্যক বোধ হইবে তাহা করিব, লোকের বা কুটুম্বের ভয়ে কদাচ সঙ্কুচিত হব না।’ রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন— তাঁর দেশের লোক যে যুগে বদ্ধ হয়ে আছেন। বিদ্যাসাগর সেই যুগকে ছাড়িয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার প্রমাণ বিদ্যাসাগরের জীবনে ছড়িয়ে আছে।
বিধবা বিবাহ প্রচলনের পাশাপাশি তাদের দুরাবস্থা থেকে বাঁচানোর জন্য হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুয়িটি ফান্ড প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিদ্যাসাগর। সারা জীবন কঠোর সংগ্রামী, স্বাজাত্যভিমানী, কোনও কারণেই আপোস না করা— এই চরিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন বিদ্যাসাগর। ১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই তাঁর জীবনাবসান ঘটে।
অরূপকুমার ভৌমিক