সম্পত্তিজনিত মামলা-মোকদ্দমায় সাফল্য প্রাপ্তি। কর্মে দায়িত্ব বৃদ্ধিতে মানসিক চাপবৃদ্ধি। খেলাধূলায় সাফল্যের স্বীকৃতি। শত্রুর মোকাবিলায় সতর্কতার ... বিশদ
তৃণমূল আর বিজেপির এবারের লড়াইয়ে সিপিএম-কংগ্রেস জোটের অবস্থা অনেকটা দুধুভাতুর মতো। যা দু’একটা কুড়িয়ে বাড়িয়ে আসবে, তাতেই তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হবে। এখন তাদের অবস্থান অনেকটাই স্পষ্ট হয়েছে। প্রকারান্তরে তারা হাত মিলিয়ে নেমেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জব্দ করতে। তাতে অন্য কারও লাভ হলেও তাদের কোনও আপত্তি নেই। কংগ্রেস এবং সিপিএম এরাজ্যে পরস্পরকে খড়কুটো ভেবে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইছে। কিন্তু তারা বুঝতে চাইছে না, এরাজ্যে তাদের অক্সিজেন জোগান দেওয়ার মতো কোনও শক্তি নেই। বরং তারা নিজেদের নাক কেটে অন্যের যাত্রাভঙ্গ করতে আসরে নেমেছে। এবারের নির্বাচনে মমতার যাত্রাভঙ্গ করাই তাদের মূল লক্ষ্য। কেননা এখানে তাদের যেটুকু ভোট রয়েছে, তাতে তারা ভোট কেটে সুবিধা করে দিতে পারে বিজেপির। কিছুদিন আগে বিশিষ্ট সিপিআইএমএল নেতা দীপঙ্কর ভট্টাচার্য এরাজ্যে এসে বলে গিয়েছেন, এরাজ্যের সিপিএম ভুল করছে। যেখানে বিজেপিকে এক নম্বর শত্রু হিসাবে টার্গেট করা উচিত ছিল, সেখানে তাদের এক নম্বর টার্গেট মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এতে সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে বিজেপি। কিন্তু এরাজ্যের সিপিএম নেতাদের নাবালকত্ব কবে ঘুচবে কে জানে!
এরাজ্যে গত লোকসভার ভোটের হিসেবটার দিকে নজর দিলে কয়েকটা জিনিস কিন্তু পরিষ্কার হয়ে যাবে। ২০১৪ সালের থেকে ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে তৃণমূলের ভোট বেড়েছিল ৩.৪৮ শতাংশ। আসন কমলেও বেড়েছিল ভোট। তাহলে বিজেপির অত আসন পাওয়ার রহস্য কোথায়? কেননা সিপিএমের ভোটেই বিজেপি এখানে ১৮টি আসন জয় করেছিল। বিজেপি গত লোকসভা নির্বাচনে ভোট পেয়েছিল ৪০.৬৪ শতাংশ। তাদের ভোট বেড়েছিল ২২.২৫ শতাংশ। এবার একবার সিপিএম এবং কংগ্রেসের ভোটের দিকে নজর দেওয়া যাক। তাহলেই অঙ্কটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। সিপিএম ভোট পেয়েছিল ৬.৩৪ শতাংশ। তাদের ভোট কমেছিল ১৬.৭২ শতাংশ। অর্থাৎ সিপিএমের তথাকথিত ‘কমরেডমনস্ক’ বলে প্রচারিত ‘কমিটেড ভোট’ ঢুকে গিয়েছিল বিজেপির বাক্সে। আর কংগ্রেস পেয়েছিল ৫.৬৭ শতাংশ ভোট। তাদের ভোট কমেছে ৪.০৯ শতাংশ। এই দু’টি ভোট যোগ করলে দাঁড়ায় ২০.৮১ শতাংশ। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, কাদের ভোট গোপনে গোপনে এরাজ্যে বিজেপিকে বিশাল এক জায়গা করে দিতে প্রয়াসী হয়েছে। তৃণমূলের যে ৩.৪৮ শতাংশ ভোট বেড়েছে, সেই ভোট হল নতুন ভোটার, তরুণ প্রজন্মের ভোটার। সুতরাং চোখকান খোলা রাখলেই বোঝা যাবে, কে কাকে তলে তলে সাহায্য করে মমতাকে টাইট দিতে চাইছেন। পাগলের গো-বধে আনন্দ কথাটা তো একেবারে মিথ্যা নয়!
বিজেপির বিহারে কৌশলের কথা মনে আছে তো? কীভাবে বিহারের মুসলিম ভোট কাটার জন্য তারা মাঠে নামিয়েছিল আসাদুদ্দিন ওয়াইসির এআইএমআইএমকে। ওয়াইসি সেখানে পাঁচটি আসন পেয়েছেন বটে, কিন্তু তাঁরা মহাগঠবন্ধনের ভোট কাটতে পারেননি। উল্টে নীতীশকুমারের ভোটব্যাঙ্কের মুসলিম ভোট কেটে অন্যদিক থেকে বিজেপিকে তারা অক্সিজেন দিয়েছিল। বিজেপি মুসলিমদের প্রতি যতই কমপ্লেক্সে ভুগুক না কেন, ভোটে জেতার কূটকৌশলে তাদের সাহায্য নিতে ছাড়ে না। এই বাংলাতেও ভোটের আগে ওয়াইসির পার্টিকে টেনে এনে মমতার মুসলিম ভোটব্যাঙ্কের মজবুত ভিতটাকে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে। অথবা বিজেপি সেই কাজের জন্য তাকিয়ে থাকবে কংগ্রেস-সিপিএম জোটের দিকে। বিজেপির খুব আশা, ওই জোট হয়তো মমতার মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক থেকে ভোট কেটে তাদের সুবিধা করে দিতে পারবে। তবে সিপিএম-কংগ্রেস মমতার বিরুদ্ধে লাগাতার তোপ দাগায় মুচকি হাসছেন বিজেপি নেতারা। আড়ালে বলছেন, সাবাশ। সারা দেশে যে কংগ্রেস বিজেপির বিরুদ্ধে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করছে, এখানে কিন্তু লড়াইয়ের ময়দানে পরোক্ষভাবে তারা বিজেপির হাতকেই শক্ত করতে চাইছে। কিছু নেতার ব্যক্তিগত উষ্মা থেকেই কংগ্রেসের এই বিভ্রান্তি।
এখানে আর একটা তথ্য পরিবেশন করা যেতে পারে। সেটা হল ২০১৯ সালে ওড়িশা বিধানসভা ও লোকসভার ফল। এই রাজ্যের পরিপ্রেক্ষিতে এই বিশ্লেষণ অত্যন্ত জরুরি। বিগত লোকসভা ভোটের ফল দেখে এখানে বিজেপির প্রত্যাশা বেড়েছে। তাই এই সময়ে একবার ওড়িশার দিকে তাকানো যেতে পারে। ওড়িশায় নির্বাচন কভার করতে গিয়ে দেখেছিলাম একই মানুষের ভিন্নমত। একই সঙ্গে তাঁরা ভোট দিতে যাচ্ছেন। লোকসভার ভোট বিজেপিকে অনেকে দিলেও বিধানসভার ভোটে তাঁরা কিন্তু নবীন পট্টনায়েকের প্রতি আস্থা রেখেছিলেন। কোনও অ্যান্টি-ইনকাম্বেন্সি ফ্যাক্টর সেখানে কাজ করেনি। লোকসভা ভোটে সেখানে বিজেপি পেয়েছিল ৮টি আসন। আগের লোকসভা ভোটে তারা পেয়েছিল ১টি মাত্র আসন। গত লোকসভা ভোটে নবীনের দলের ভোট কমেছিল ১.৩ শতাংশ। দেখা গেল বিধানসভা ভোটে সেই ভোট নবীনের অটুট। বিজেপি লোকসভায় পেয়েছিল ৩৮.৪ শতাংশ ভোট। বিধানসভায় তাদের ভোট কিন্তু কমে হল ৩২.৪৯ শতাংশ। মনে রাখা দরকার, ভোট কিন্তু হয়েছিল একইসঙ্গে। সুতরাং লোকসভা ভোটের সঙ্গে সবসময় বিধানসভা ভোটের তথ্যকে মেলানো উচিত নয়।
নন্দীগ্রামও এবার হয়ে উঠছে ভোটের ইস্যু। নন্দীগ্রামের লড়াইটাকে আজ যদি কেউ একক লড়াই বলে সব ঝোলটুক টেনে সুবিধাভোগের চেষ্টা করেন, সেটা অত্যন্ত ভুল হবে। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের লড়াই ছিল একটা রক্তচক্ষু, বাহুবলী, উদ্ধত শাসকের ভুল সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মানুষের সম্মিলিত লড়াই। সেই লড়াইটার সেদিন নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই ইতিহাস কোনওভাবেই মুছে ফেলা যাবে না। গায়ে গেরুয়া পতাকা জড়িয়ে আজ যদি কেউ দাবি করেন, নন্দীগ্রাম তাঁরই আন্দোলনের ফসল,তবে মানুষ তার তীব্র প্রতিবাদ করবেন। একটা অগ্নিগর্ভ সময়ের মধ্য থেকে মমতার হাত ধরে একটা স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের নামই ছিল সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম। এই আন্দোলন তৈরি করা যায় না। এই আন্দোলন তৈরি হয়ে যায়। আগুনের পাকে পাকে লেখা হয়ে যায় ইতিহাস। সেই আন্দোলনের মুখ হয়ে ওঠেন একজন। এক্ষেত্রে তিনি ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাকিরা সকলেই ছিলেন দ্বিতীয় সারির সৈনিক।
এরাজ্যের একটা পরম্পরা আছে, শিক্ষার জোর আছে, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আছে, রাজনৈতিক সচেতনতা আছে। তার সঙ্গে কোনওভাবেই বিজেপির সংস্কৃতি এবং বৌদ্ধিক ঐতিহ্য মেলে না। এটা অবশ্যই ঠিক, এরাজ্যে যত দিন গিয়েছে, ততই অবাঙালি জনগণের সংখ্যা বেড়েছে। আসলে আমাদের সংস্কৃতি সব সময়ই দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে। তাই যে কেউ এরাজ্যে এসেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে এখানে কোনও আন্দোলন হয়নি। সকলেই নিরুপদ্রবে থেকেছেন। অন্য রাজ্যে কিন্তু অমুক খেদাও তমুক খেদাও আন্দোলন হয়েছে। আসলে বিভেদের মধ্য দিয়ে রাজনীতির কুশিক্ষা বাঙালি সম্ভবত কোনওদিন শেখেনি। আজ যেন এরাজ্যে বিজেপি মন্থরার মতো ঢুকে পড়ছে। যে কুমন্ত্রণার কারণে একদিন রামচন্দ্রকে সোনার অযোধ্যা ছেড়ে বনবাসে যেতে হয়েছিল। সোনার অযোধ্যা ছারখার হয়ে গিয়েছিল। আজ মানুষের সঙ্গে মানুষের বিভেদ সৃষ্টি করে বিজেপি অনেকটা সেই মন্থরার ভূমিকায় অবতীর্ণ। সুতরাং বাংলার সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকে রক্ষা করাই এবারের ভোটে প্রধান ইস্যু।