কোনও কিছুতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভাববেন। শত্রুতার অবসান হবে। গুরুজনদের কথা মানা দরকার। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সুফল ... বিশদ
কিন্তু, এবারের লোকসভা ভোটের ফলে কংগ্রেসের গুরুতর বিপর্যয়ের পর তার দায় নিয়ে সভাপতি পদ থেকে রাহুল গান্ধী সরে দাঁড়ানোর পর কংগ্রেসের অন্দরে এক অভূতপূর্ব নেতৃত্বহীনতা দেখা দিল! কংগ্রেসের নবীন, প্রবীণ, প্রৌঢ় কোনও শীর্ষ নেতা-নেত্রীই সভাপতি হতে আগ্রহী নন! সকলেই দফায় দফায় রাহুলজিকে অনুরোধ, উপরোধ করে চলেছেন—আপনি ফিরে আসুন পদে, আপনার নেতৃত্বে দল নরেন্দ্র মোদিজির গেরুয়া ব্রিগেডের বিরুদ্ধে লড়াই করবে জান বাজি রেখে—দেশ ও দশের স্বার্থে আগামী দিনের ভারতে ফের একবার কংগ্রেসের তেরঙ্গাকে স্বমহিমায় সগৌরবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজনৈতিক সংগ্রামে সভাপতি হিসেবে আপনি নেতৃত্ব দিন—সভাপতি তথা নেতা হিসেবে আপনাকে ছাড়া এই মুহূর্তে কোনও বিকল্প নেই আমাদের ইত্যাদি প্রভৃতি কত কী! হরেক নেতার হরেক দাবি, হরেক প্রার্থনা। কিন্তু, রাহুল গান্ধী অনড়। তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন—সভাপতি পদে তিনি আর ফিরছেন না। অবশ্যই এখানে ‘আপাতত’ কথাটা যোগ করে নিতে হবে। কারণ, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু হয় না।
কিন্তু, যেটা লক্ষণীয়, রাহুল না করে দেওয়ার পর গত তিন মাস যাবৎ খালি পড়ে থাকল জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতির আসন! গোটা দেশ থেকে একজন সভাপতি খুঁজে পাওয়া গেল না কংগ্রেসে! সংসদে বাংলার অধীর চৌধুরীকে নেতা করে সোনিয়া, রাহুল সামাল দিলেন বটে কিন্তু ‘হাইকমান্ডে’র পাশের চেয়ারটি খালিই রইল দিনের পর দিন। তো, কংগ্রেসের মতো এমন একটা বিরাট ঐতিহ্যশালী দলের শীর্ষস্তরে এমন নেতৃত্বহীনতা দেখলে প্রশ্ন তো উঠবেই—উঠেছেও। কংগ্রেসের সাধারণ কর্মী সমর্থক নেতা-নেত্রী থেকে কংগ্রেস-বিরোধী শিবির মায় দেশের আমজনতা সর্বত্র জিজ্ঞাসা একটাই—রাহুল সরে দাঁড়াতেই কংগ্রেস এমন নেতৃত্বহীনতায় ভুগতে শুরু করল কেন? গান্ধী ফ্যামিলির বাইরে কি আজ একজনও নেই যিনি আপন রাজনৈতিক যোগ্যতাবলে শক্ত হাতে কংগ্রেসের হাল ধরতে পারেন, হতে পারেন উমেশচন্দ্র, সুরেন্দ্রনাথ, প্যাটেল, নেতাজি, চিত্তরঞ্জন প্রমুখের মতো চিরস্মরণীয় মহারথীদের আধুনিক উত্তরসূরি!?
সত্যি বলতে কি, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপের কেন্দ্রীয় উদ্যোগের পর প্রশ্নটা যেন আরও জোরালো হয়ে উঠেছে। তার অবশ্য সুনির্দিষ্ট কারণও আছে। কারণটা হল, ভারতের সংসদে এত বড় একটা ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে গেল, কাশ্মীরের জনগণ ৩৭০ ধারা রদের সঙ্গে সঙ্গে এতদিন পাওয়া বিশেষ সুযোগ-সুবিধা হারাল, এই রদ প্রক্রিয়ায় নরেন্দ্র মোদি সরকারের বিরুদ্ধে সাংবিধানিক রীতিনীতি না মানার অভিযোগ উঠল, দেশের রাজনৈতিক মহল থেকে জনতার দৈনন্দিন জীবন—সর্বত্র এই সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় তোলপাড় চলছে অথচ, দেশের অন্যতম প্রভাবশালী দল কংগ্রেসের তথাকথিত হাইকমান্ড বা মাস কয়েকের প্রাক্তন সভাপতি রাহুল গান্ধীর তরফে তেমন কোনও সাড়া-শব্দ নেই! বরং ঘটনার দিন সংসদে কংগ্রেসের পক্ষে অধীর চৌধুরীর বক্তব্য শাসক বিজেপি তথা মোদি, অমিত শাহ জুটিকে সন্তুষ্ট করতে পারুক না পারুক সনিয়া-রাহুলের পক্ষে প্রীতিকর হয়নি বলেই খবর!
অন্যদিকে দেখা গেল—কংগ্রেসের তরুণ-প্রবীণ ব্রিগেডের কয়েকজন নেতার মন্তব্যেও ৩৭০ ধারা রদ নিয়ে সেই মিশ্র-ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে! গত বুধবার রাতে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে পর্যন্ত ৩৭০ নিয়ে গরিষ্ঠ জনমতের পক্ষ নেওয়ার জন্য সওয়াল ওঠে বলে খবর! বৈঠকে উপস্থিত কংগ্রেস নেতৃত্বের একাংশ সেই সূত্রে মোদিজি, অমিত শাহের ৩৭০ ধারা বাতিলের সিদ্ধান্ত সমর্থনের কথা বলেন। অবশ্য, রাহুল গান্ধী সেই ভাবনা সরাসরি নাকচ করে দিয়ে পাল্টা লড়াইয়ের কথা বলেন। চিদম্বরম, আহমেদ প্যাটেলের মতো প্রবীণ এবং প্রিয়াঙ্কার মতো নবীন নেতা-নেত্রীর সমর্থনে রাহুলের যুক্তিই কমিটি বৈঠকে শেষ পর্যন্ত মান্যতা পায়। কিন্তু, ৩৭০ বাতিল নিয়ে কংগ্রেসের অন্দরের মতপার্থক্যটি তাতে কতটা আড়াল করা গিয়েছে তা নিয়ে রাজনৈতিক তথ্যভিজ্ঞমহলে যথেষ্ট সংশয় ছড়িয়েছে।
তার প্রমাণও মিলেছে। জম্মু-কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়ে দল যে দ্বিধার ভাবটা কাটিয়ে উঠতে পারেনি—গত বৃহস্পতিবার সংসদে অধীর চৌধুরী ও গুলাম নবি আজাদের বিতর্কিত মন্তব্য এবং পরবর্তীতে কংগ্রেস নেতা কর্ণ সিং ও তাঁর পুত্রের বক্তব্য তার প্রমাণ। গুলাম নবি বলে দিলেন, কাশ্মীরের মানুষজনকে টাকা দিয়ে কেনা যায় আর অধীর কাশ্মীরের বর্তমান অবস্থাকে ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে’র সঙ্গে তুলনা করে বিতর্ক বাধালেন। অন্যদিকে কর্ণ সিং ও তাঁর পুত্র বিক্রমাদিত্য মোদি-শাহের ৩৭০ রদের সিদ্ধান্তকে ভূস্বর্গে নতুন যুগের সূচনা বলে অস্বস্তিতে ফেললেন দলকে! শুধু তাই নয়, জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার মতো আরও কেউ কেউ এমনভাবে কেন্দ্রের ৩৭০ রদের সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে দাঁড়িয়ে—বর্তমান ক্ষেত্রে জাতীয় কংগ্রেসের রাজনৈতিক ভূমিকা কেবল ধোঁয়াশাচ্ছন্নই করে তোলেননি, পরন্তু সোনিয়া-রাহুল-প্রিয়াঙ্কা ঘোষিত বিরোধিতার নীতির গ্রহণযোগ্যতাকেই প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছেন। ফলে, শাসক পদ্মদলের ৩৭০ রদের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে দলের লাইন কী হবে তা নিয়ে রীতিমতো ধন্দে পড়ে গেছেন কংগ্রেসের উপর থেকে নিচুতলার প্রায় সকলেই। এবং প্রতিপক্ষের সবচেয়ে বড় ও প্রভাবশালী দল কংগ্রেসের অন্দর-বাহিরের এই দ্বিধা দোলাচল, রাজনৈতিক নীতি নির্ধারণে এই মতপার্থক্যে সঙ্গত কারণেই বিশেষ স্বস্তিতে পদ্ম শিবিরের শীর্ষ নেতৃত্ব। কংগ্রেসের এই টালমাটাল কাটতে কাটতে জম্মু-কাশ্মীর-লাদাখের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে, দেশের নানা প্রান্তে ৩৭০ ধারা রদ নিয়ে প্রতিবাদের যেটুকু ঢেউ-তরঙ্গ উঠেছে তাও মিলিয়ে যাবে, তখন এ নিয়ে আন্দোলনে নামা কংগ্রেসের পক্ষে খুব সুবিধেজনক হবে না—এমনই ধারণা শাসক বিজেপি’র। অন্তত তথ্যভিজ্ঞজনেদের অনেকে তেমনই বলছেন।
কিন্তু, এত বড় একটা দলে এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে এত বিপরীত মত আসছে কেন? তাহলে কি দলের শীর্ষস্তরে সোনিয়া-রাহুলের মানে গান্ধী পরিবারের কর্তৃত্ব শিথিল হতে শুরু করেছে, ‘হাইকমান্ডে’র সার্বজনিক মান্যতায় টান পড়ছে? দলে গান্ধী পরিবারের বাইরের প্রভাব বাড়ছে? তাই যদি, তবে তিন মাসে গান্ধী ফ্যামিলির বাইরে থেকে একজন যোগ্য সভাপতি খুঁজে পাওয়া গেল না কেন? তাহলে কি প্রকৃত অর্থেই যোগ্য বলিষ্ঠ নেতৃত্বের খরা দেখা দিয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জাতীয় কংগ্রেসে? অন্যগুলো নিয়ে মতপার্থক্য থাকলেও শেষ প্রশ্নটিতে দেখা যাচ্ছে অনেকেই সহমত। ইন্দিরার আমল থেকেই কংগ্রেস পুরোপুরিভাবে গান্ধী পরিবার নির্ভর। সীতারাম কেশরী বা নরসীমা রাওয়ের মতো যাঁরা সভাপতি হয়েছেন তাঁরা কার্যত গান্ধী পরিবারের নির্দেশ-নীতিকে শিরোধার্য করেই কাজ চালিয়েছেন। ফলে সভাপতির চেয়ারে যে-ই থাকুন গান্ধী পরিবারের কর্তৃত্ব ও শাসনই বহাল থেকেছে কংগ্রেসে—নিন্দুকেরা তেমনটাই বলেন। শনিবার এই লেখা যখন লেখা হচ্ছে তখনও সভাপতি ঠিক হয়নি কংগ্রেসে। ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক হচ্ছে। কুমারী শৈলজা মল্লিকার্জুন খাড়গে, মুকুল ওয়াসনিক, বেণুগোপালের মতো কিছু নাম উড়ছে বাতাসে।
শেষ পর্যন্ত কার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বে সেটা রাজনীতির ভাগ্যদেবতা জানেন। আমরা কেবল অতীত অভিজ্ঞতার নিরিখে এটুকুই অনুমান করতে পারি—সভাপতি পদে যিনিই মনোনীত হোন—তিনি গান্ধী পরিবারের বিশেষ প্রীতিভাজন হবেন। কিন্তু, আপন রাজনৈতিক দক্ষতা কৌশলে আজকের এই দিশেহারা জাতীয় কংগ্রেসকে তিনি কতটা দিশা দিতে পারবেন, জাতীয় রাজনীতিতে তার হৃত মহিমা কতটা ফেরাতে পারবেন তা বলবে সময়। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করেন, সময়ের সেই পরীক্ষায় নয়া সভাপতির সাফল্যই নেতৃত্বহীনতার চলতি দুর্বলতা থেকে কংগ্রেসকে রেহাই দিতে পারে। না হলে ফের গান্ধী রাহুলেরই দ্বারস্থ হতে হবে কংগ্রেসকে। কংগ্রেসে গান্ধী-পরিবার নির্ভরতা কাটিয়ে ওঠার স্বপ্ন যাঁরা দেখেন তাঁদের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। নান্য পন্থা।