কোনও কিছুতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভাববেন। শত্রুতার অবসান হবে। গুরুজনদের কথা মানা দরকার। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সুফল ... বিশদ
মূল কথা হল, শাসক কে? সে কতটা দখলদারি রাখতে চাইছে? এই মুহূর্তে দেশে বিজেপির একচ্ছত্র আধিপত্য। সেই কারণেই সংসদে ফটাফট বিল পাশ, ভারতের মানচিত্রের মাথার দিকের রাজ্যে উল্লম্ব বক্ররেখা টেনে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। একটায় বিধানসভা থাকবে, একটায় থাকবে না। কাশ্মীরে দীর্ঘ স্বায়ত্তশাসন সংক্রান্ত বেশ পুরনো কিছু ধারা এক খোঁচায় উড়িয়ে দিয়েছে বিজেপি। তাই শুধু অঙ্কের ৩৭০ কিংবা লেজে অক্ষর নিয়ে ৩৫এ, সবই বাতিলের পথে। সেই প্রেক্ষিতে পঞ্চায়েত নির্বাচন সংক্রান্ত আলোচনা তো তুচ্ছ। ত্রিপুরায় বিজেপিরই সরকার, এবং তারা ক্ষমতায় এসেছে বামেদের দীর্ঘ শাসনের অবসান ঘটিয়ে।
ফলে, সেখানকার পঞ্চায়েত নির্বাচনে জয়জয়কার নিয়ে খুব বেশি ভুরু কোঁচকানোর জায়গা নেই। এমনটাই হওয়া স্বাভাবিক। পশ্চিমবঙ্গ বা ত্রিপুরায় বাম শাসনের ইতিহাসের সঙ্গে এর পার্থক্য কতটা? তা হল, বাম আমলে বিভিন্ন পৌরসভা বা পঞ্চায়েত নির্বাচনে শাসক দলের দাদাগিরি বজায় থাকলেও, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিরোধীদেরও অস্তিত্ব ছিল। বাম শাসনের অবসানে বিরোধীদের চিহ্নটুকুও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ত্রিপুরার ক্ষেত্রে আর একটি পর্যবেক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ। তা হল ত্রিপুরা বিধানসভা নির্বাচনে পরাজয়ের পর বামেদের অবক্ষয় সাংঘাতিক গতিতে হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের থেকেও দ্রুত। বিধানসভায় হারার সময়েও বামেরা যথেষ্ট বাহুবলী দ্বিতীয় শক্তি ছিল। তারপর গত লোকসভা নির্বাচনে ভোট শতাংশের হিসেবে বিজেপি ছিল প্রথম, কংগ্রেস দ্বিতীয় আর বামেরা তৃতীয়। এই পঞ্চায়েত নির্বাচনও সেই পরিসংখ্যানই পেশ করছে। অর্থাৎ বাম শক্তি ক্ষমতা থেকে সরে গেলে প্রধান বিরোধী পক্ষ হিসেবেও নিজেদের অবস্থান বজায় রাখতে পারছে না, চলে যাচ্ছে একেবারে তৃতীয় সারিতে।
বিজেপির যে ভাবনা, তাতে রাজনৈতিকভাবে বামেরাই সবথেকে বড় শত্রু। সুতরাং তাদের মূল লক্ষ্য সংসদীয় গণতন্ত্রে বামেদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। সেই কাজে অবশ্যই সফল বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরায় ভোট শতাংশে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে বামফ্রন্ট। বাকি শুধু কেরল। সেখানেও এবারের লোকসভা নির্বাচনে আসনের হিসেবে বামেরা শূন্যের কাছাকাছি। লোকসভায় প্রতিনিধিত্বের নিরিখে সারা দেশে এক অঙ্ক পার করতে পারে নি এই জোট।
এখানে প্রশ্ন উঠবেই যে বিজেপি কি সামরিক শক্তি ব্যবহার করে বামেদের নিশ্চিহ্ন করেছে? মোটেই তা নয়। একেবারে সংসদীয় ব্যবস্থার মধ্যে থেকে বামেদের বিরুদ্ধে ঘুঁটি সাজিয়েছে তারা। রণে আর প্রণয়ে নীতির বালাই কখনওই থাকে না। সেটুকু গোলমালের সুযোগ বামেরা তাদের সুসময়ে নিয়েছে। আর সেই হিসেব কড়ায়গণ্ডায় নয়, একেবারে কয়েকগুণ বাড়িয়ে ক্ষমতা দখল করছে বিজেপি। সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিধিতে বিজেপির যে আগ্রাসী মনোভাব, তা সামলানোর জন্যে এই সময় প্রস্তুত নয় ভারতের অন্যান্য রাজনৈতিক দল।
এই বিজেপি বাজপেয়ি আমলের বিজেপি নয়। যেখানে বিরোধীদের জন্যে কিছুটা জায়গা রাখা থাকত। নরেন্দ্র মোদি আর অমিত শাহের নেতৃত্বে বিজেপি এখন পুরোপুরি ডানপন্থী। মোটামুটিভাবে সংবিধানের আওতায় থেকে যে কোনও উপায়ে ক্ষমতা দখল তাদের কর্মসূচি। সেই পথেই চলছে তারা। কর্ণাটক দখল হয়ে গেছে বিধায়ক সরিয়ে। মধ্যপ্রদেশও টলোমলো। পশ্চিমবঙ্গে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির ফল ভালো হওয়ার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন অনেকে। সামনের দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে আম আদমি পার্টি বিজেপির কাছে হেরে গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। দুহাজার কুড়ির শেষের দিকে গোটা দেশে বিজেপি কিংবা বিজেপির বন্ধু সরকার থাকবে প্রায় সব জায়গাতেই। বড়জোর চার পাঁচটি রাজ্যে থাকতে পারে বিরোধী পক্ষ। সেই হিসেবে ছোট্ট ত্রিপুরার পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপি তার বিরোধী দলগুলোকে আসন পেতে দুপুরের ভাত মাছের ঝোল সাজিয়ে দেবে এরকমটা ভাবার কোনও কারণ নেই।
বরং বিজেপি এখন এমন একটা ক্ষমতার জায়গায় এসে গেছে যে তারা ঠিক করে নিতে পারে যে কোন রাজ্যে তাদের বিরোধী কে হবে। অবশ্যই সারা দেশের নিরিখে বিজেপির সবথেকে পছন্দের বিরোধী দল কংগ্রেস। দুর্বল নেতৃত্ব সমেত একটি সর্বভারতীয় বিরোধী দলকে খাড়া করে রাখতে পারলে বিভিন্ন নির্বাচনে আঞ্চলিক দলগুলোর ভোট কেটে দেওয়া যায় সঠিক অঙ্কে। ফলে কংগ্রেসকে দ্বিতীয় স্থানে রাখার দায় বিজেপির আছে।
সেই কারণেই বাম-বিদায়ের পর ত্রিপুরায় কংগ্রেসের উত্থান প্রধান বিরোধী দল হিসেবে। যেখানে বিজেপির জিততে কিছুটা সময় লাগবে, সেখানে বাম দলগুলোর তুলনায় কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকা বিজেপির পক্ষে মঙ্গলের। কেরলের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে। বামেরা নিশ্চিহ্ন, আর প্রায় সব আসন পেয়েছে কংগ্রেস। কিন্তু বিজেপির অগ্রগতি সেখানে লক্ষণীয়। সামনের বিধানসভা নির্বাচনে কেরল অবশ্যই দেখবে ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা। সেখানে বামেরা তিন নম্বরে নেমে গেলে খুব অবাক হওয়ার কিছু নেই। তবে শক্তিশালী আঞ্চলিক দলও তো একেবারে বিনা যুদ্ধে লড়াই ছাড়বে না। সেই হিসেবে আলোচনা করতে হবে তৃণমূলের কথা। তাদের সঙ্গে বিজেপির গোপন আঁতাঁতের তত্ত্ব অবশ্যই বামেদের নির্বাচনী ইস্তাহারে থাকবে।
কিন্তু সেটা না-মেনে যদি সত্যিই বিজেপি এবং তৃণমূলকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ধরা যায়, তাহলে সেখানেও লড়াইটা নিজেদের এক-দুই-এ রেখে বাকিদের অনেকটা পেছনে ফেলে দেওয়া। লক্ষ করলে দেখবেন, ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে বাম-কংগ্রেস জোট যথেষ্ট ভোট পেয়ে প্রধান বিরোধী জোট হলেও তারপর থেকে বিজেপির প্রকৃত উত্থান শুরু। পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল গায়ের জোর দেখালেও বিজেপি সেখানে দ্বিতীয় স্থান দখল করেছিল বেশ ভালোভাবেই। এখানেও সেই একই তত্ত্ব লাগানো যায়, যে রাজ্যের হিসেবে বামফ্রন্ট কিংবা বামঘেঁষা কংগ্রেসের তুলনায় তৃণমূল এবং বিজেপির নিজেদের এক আর দুই-এ রাখাটা অনেক বেশি যুক্তিযুক্ত। যথাক্রমটা তারাই ঠিক করবে।
লোকসভা নির্বাচনেও কংগ্রেস শেষমেশ কোনওভাবে দুটি আসন জোটালেও বামেরা এই রাজ্যে একেবারে শূন্য। অর্থাৎ ২০১৮ এবং ২০১৯-এ ভারতের ক্ষুদ্রতম (পঞ্চায়েত) থেকে বৃহত্তম (লোকসভা) নির্বাচনের সবকটাতেই বামেরা বিপর্যস্ত এবং ভ্যানিশ। বিজেপি রাজনীতির এখানেই চূড়ান্ত সফলতা।
আপাতত যা পরিস্থিতি তাতে বামেদের পক্ষে নতুন করে ক্ষমতায় ফেরা প্রায় অসম্ভব। ‘প্রায়’ শব্দটি যোগ করতে হল কারণ রাজনীতিতে কখনও কখনও অবাক করার মতো কিছু ঘটনা ঘটে। যদিও তার সম্ভাবনা কম। তাহলে বামেরা করবেনটা কি?
একটা সহজ সমাধান দলে দলে বিজেপিতে যোগ দেওয়া, এবং সেই দলের মধ্যে ঢুকে নিজেদের বাম মতামত প্রকাশের চেষ্টা করা। আরএসএস-এর বেশ কিছু কর্মসূচিতে দেশের পিছিয়ে-পড়া মানুষের উন্নয়নের কথা আছে। সেই সমস্ত কাজে যোগ দিতে পারেন বাম নেতৃত্ব। বিজেপিরও এ ব্যাপারে বিশেষ ছুঁতমার্গ নেই। যে-কোনও দল থেকেই লোক নিতে তারা আগ্রহী। আর এর মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু বাম জনপ্রতিনিধি তৃণমূল কিংবা বিজেপিতে ঢুকে আবার ভোটে জিতেছেন।
তবে শিক্ষিত বাম নেতৃত্ব তো এরকম সহজ সমাধান মেনে নেবেন না। সুতরাং জটিল হিসেবে দলটা থাকবে। সেখানে অন্য দলগুলোর তুলনায় হয়তো শিক্ষিত এবং সৎ নেতাকর্মীর ঘনত্ব চূড়ান্ত অবক্ষয় সত্ত্বেও কিছুটা বেশিই হবে। সিপিএমের স্বেচ্ছাসেবক হওয়ার জন্যে অন্তর্জালে নাম লেখানোর সাম্প্রতিক আহ্বানে অবশ্যই সাড়া দেবেন গুটিকয়েক যুক্তিবাদী যুবক-যুবতী। তবে তাতে আজকের পরিস্থিতিতে ভোট আসবে না। সংবাদমাধ্যমে প্রায় হারিয়ে যাবে এই দলের উপস্থিতি। বড়জোর দু-একটি বাক্যে খবর হবে যে কাশ্মীরে সিপিএম বিধায়ক তারিগামিকেও গ্রেপ্তার করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। সারা দেশের বাম ভোট ধীরে ধীরে শতাংশের হিসেবে দশমিকের ডানদিকের অঙ্কেও হারিয়ে যাবে। অন্তত আজকে সামনে তাকিয়ে তেমনটাই মনে হচ্ছে। গত বছরে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচন তাই তৃণমূলের দেখানো পথ, যেটা বছর বদলানোর পর ত্রিপুরায় রূপায়ণ করেছে বিজেপি।
কিন্তু, বিজেপির মতো উন্নত সাংগাঠনিক শক্তির অভাবে তৃণমূলের পক্ষে সে ধারা ধরে রাখা শক্ত। আর একটি মাত্র রাজ্যে ক্ষমতায় থেকে গোটা দেশের শাসকের বিরুদ্ধে লড়াই করা কঠিন, যদি না ভেতরে ভেতরে কিছুটা বোঝাপড়া করা যায়। ফলে, সামনের দিনগুলোতে রাজ্য কিংবা দেশের আসন-বিন্যাস ত্রিপুরার পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফলের মতোই হবে। বিজেপিই ঠিক করবে কোথায় তারা জিতবে, কোথায় তারা বিরোধীদের ক’টা আসন দেবে। গোপনে বা প্রকাশ্যে বিজেপির বিরোধিতা করে তাদের গাল দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু ফলাফল বদলানো কঠিন।
সেই কারণেই বোধহয় কাশ্মীর সংক্রান্ত বিষয়ে ভোট না-দিয়েই সংসদ ছেড়েছে তৃণমূল। পাড়ার ক্লাবের সভাসদ নির্বাচন তাই কাগজের ব্যালটেই হোক কিংবা বৈদ্যুতিন ভোটযন্ত্রে, দুর্গাপুজোয় এবার এরাজ্যের অনেকটা দখল নেবে বিজেপি। সামনের দু’বছর বিজেপিই স্থির করবে পশ্চিমবঙ্গে তারা কী চায়। থুড়ি, সারা ভারতেই—ত্রিবান্দ্রম থেকে ত্রিপুরা, কন্যাকুমারিকা থেকে কাশ্মীর।
লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক। মতামত ব্যক্তিগত