কোনও কিছুতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভাববেন। শত্রুতার অবসান হবে। গুরুজনদের কথা মানা দরকার। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সুফল ... বিশদ
রাজনৈতিক দল হিসাবে বিজেপি জন্মলগ্ন থেকেই জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা দেওয়ার বিপক্ষে অবস্থান ছিল। বাস্তবে ৩৭০ ধারা বিলোপের কর্মসূচি বিজেপির আজকের নয়, জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় নিজের জীবন দিয়েছিলেন —‘দো নিশান, দো প্রধান এবং দো বিধান’ বন্ধের জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে। ১৯৮০ সালে বিজেপি গঠিত হলে দলের প্রতিটি নির্বাচনী ইস্তাহারে সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিলের প্রতিশ্রুতি ছিল। ২০১৯-র লোকসভা নির্বাচনের ইস্তাহারেও বিষয়টি স্থান পেয়েছিল। শাসন ক্ষমতায় দ্বিতীয়বার এসে বিজেপি নির্বাচকমণ্ডলীকে দেওয়া দলীয় প্রতিশ্রুতি পূরণ করবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু খটকা লাগছে বিজেপি কবে বলেছিল, কাশ্মীরকে পূর্ণ রাজ্য থেকে নামিয়ে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হবে! লাদাখ নিয়ে একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গড়ে তোলার দাবিকে বিজেপি সমর্থন করে আসছিল। সেই প্রতিশ্রুতি তারা রাখল বলা যায়। কিন্তু, দল হিসাবে বিজেপি কখনোই জম্মু ও কাশ্মীরকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হবে তেমন কথা বলেছে বলে শুনিনি। এমনকী, দলে ছোট-বড় নেতার মুখেও এই ভাবনা উচ্চারিত আগে কখনও হয়নি।
তবে এমন কী ঘটল যে, হঠাৎ করে জম্মু ও কাশ্মীরকে পূর্ণ রাজ্য থেকে একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করতে হল? আমরা সকলে জানি যে, ভারতীয় সংবিধানে পূর্ণ রাজ্যকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সেই ক্ষমতা কেন্দ্রশাসিত রাজ্যের হাতে নেই। জম্মু ও কাশ্মীর কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হওয়ায় পুলিশ-প্রশাসন মূলত কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা পরিচালিত হবে। তবে কি আইনশৃঙ্খলার কথা মাথায় রেখেই পূর্ণ রাজ্য থেকে জম্মু ও কাশ্মীরকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হল? সংসদে দু’দিনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর বক্তৃতাতে এমন ইঙ্গিতই ধরা পড়েছে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলার উন্নতি হলে জম্মু ও কাশ্মীরকে পূর্ণ রাজ্যে ফিরিয়ে নেওয়ার কথাও তিনি বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী টুইট বার্তাতেও আইনশৃঙ্খলার উন্নতি হলে আগামী দিনে জম্মু ও কাশ্মীরকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি রয়েছে।
জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ পৃথক দুটি কেন্দ্রশাসিত রাজ্য হওয়ায় সীমান্তের ওপার থেকে আসা জঙ্গি দমনে কেন্দ্র আরও কঠোর ভূমিকা নিতে পারবে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত প্রকল্পের সুযোগের দরজা এই দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের জন্য খুলবে। মিলতে পারে বিশেষ আর্থিক সহায়তা। ৩৭০ ধারা ও ৩৫ক ধারা রদ হওয়া জমি ক্রয়-বিক্রয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়াতে উন্নয়নের ক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে পর্যটন, কৃষি ও পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির সম্ভাবনার কথা বণিকমহলগুলির তরফ থেকে বলা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে বিগত দিনে বেসরকারি বিনিয়োগের প্রধান বাধাই ছিল ওই রাজ্যের জমির ক্রয়-বিক্রয়ের ওপর বিধি-নিষেধ জারি থাকার বিষয়টি। অর্থাৎ একদিকে উন্নয়ন আর অন্যদিকে মজবুত প্রশাসনিক কাঠামো প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কাশ্মীরের সমস্যার সমাধান খোঁজার চেষ্টা করলেন অমিত শাহ।
কাশ্মীরের বিশেষ অধিকার রদ করে অমিত শাহ-নরেন্দ্র মোদি কাশ্মীরের মানুষকে ভারতের মূল প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ধারার সঙ্গে যুক্ত করতে গিয়ে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সম্মুখীন হলেন। যেমন—কেন্দ্রীয় সরকারের এই ‘সংযুক্তিকরণ মডেল’ (Integration) কাশ্মীরের সমস্যা নিরসন করতে পারবে তো? পারবে তো কয়েক দশক ধরে চলা উপত্যকার অশান্ত পরিস্থিতি দূর করে শান্তি স্থাপন করতে? বিগত ৭০ বছর ধরে চলা কাশ্মীরের স্বাধিকার মডেল (Autonomy) থেকে সরে আসা ভুল হল না তো? যেভাবে সংবিধানে ৩৭০ ধারা ও ৩৫ক ধারা রদ করে এবং একটি পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা থেকে জম্মু ও কাশ্মীরকে কেন্দ্রশাসিত রাজ্যে পরিণত করা হল, তাতে রাজ্যের মানুষের মনে অভিমান নতুন করে জন্মাবে না তো? সংবিধান সংশোধন না-করে কেবল রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে নেওয়া সিদ্ধান্ত সুপ্রিম কোর্টের পর্যালোচনায় আটকে যাবে না তো?
এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে আগামী দিনে ইতিহাসের গর্ভে। কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্ত ভারতীয় সংবিধানের অভিভাবক হিসাবে সুপ্রিম কোর্ট কীভাবে বিবেচনা করে তা হয়তো অল্প সময়ের মধ্যেই জানা যাবে। বাকি প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে থাকবে আগামী ইতিহাসের গর্ভে।
তবে, এই সমস্ত প্রশ্ন আসলে আবর্তিত হচ্ছে মূলত কাশ্মীরসমস্যা সমাধানের প্রশ্নে ‘স্বাধিকার বনাম সংযুক্তিকরণ’ ভাবনাকে কেন্দ্র করে। নেহরুর অনুসৃত কাশ্মীরের স্বাধিকার মডেল বিগত ৭০ বছর ধরে কার্যকরী থাকলেও কাশ্মীরসমস্যার সমাধান কিন্তু অধরাই থেকে গিয়েছে। তৈরি হয়েছিল অচলাবস্থা। বিজেপির সংযুক্তিকরণ মডেলে কাশ্মীরের এই দীর্ঘ অচলাবস্থা ভেঙে এগিয়ে চলার কথা বলা হয়েছে। বিশ্বজুড়ে সংযুক্তিকরণ মডেলের যে অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে, তা মিশ্র। চীনের সঙ্গে তিব্বতের সংযুক্তিকরণ সফল হয়েছে। আলাস্কার ক্ষেত্রেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংযুক্তিকরণ সফল ছিল। আবার চীনের সঙ্গে হংকংয়ের সংযুক্তিকরণ প্রক্রিয়া কিন্তু কঠিন বাধার সম্মুখীন হয়েছে। এখন দেখার, কাশ্মীরকে ভারতের মূল প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সংযুক্তিকরণ প্রক্রিয়ার ফল কী হয়?
তবে, লাদাখের মানুষের দীর্ঘ দিনের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের দাবি মান্যতা পাওয়ায় ভারতের বাইরে (শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশ) এবং ভারতের ভেতরে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষ সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। ভারতের মাটিতে সৃষ্টি হওয়া এই প্রাচীন ধর্মের মানুষ নিজস্ব একটি রাজনৈতিক ভূখণ্ডের জন্য লড়াই করে আসছিলেন। অমিত শাহরা সেই প্রত্যাশা পূরণ করলেন। যদিও, লাদাখের মানুষের বিধানসভা না-থাকায় রাজ্য সরকার গড়ার অধিকার থেকে তাঁদের বঞ্চিত থাকতে হবে। ২৬,২৯৩ বর্গ কিমি এলাকার মানুষ ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে ডোগরা সেনাপতি জোরাওয়ার সিং কাহলুরিয়ার কাছে পরাজিত হয়ে কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন। ব্রিটিশদের হাত ঘুরে ডোগরা শাসক হরি সিং কাশ্মীরকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করলেও লাদাখকে জম্মু ও কাশ্মীরের সঙ্গেই রেখে দেওয়া হয়। দীর্ঘ ১৮৫ বছর পর অমিত শাহ-নরেন্দ্র মোদির হাত ধরে লাদাখের মানুষ আবার নিজভূমি ফিরে পেলেন। তবে, এই সময়ের মধ্যে তাকে হারাতে হয়েছে পাকিস্তানের কাছে বালটিস্থান উপত্যকা সমেত বহু অঞ্চল, চীনের কাছে রুদোক ও গুজ সহ আকসাই চীন ও নুব্রা উপত্যকা। তবে, সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, হারানো ওই জমির উদ্ধারে ভারতের লড়াই জারি থাকবে।