কোনও কিছুতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভাববেন। শত্রুতার অবসান হবে। গুরুজনদের কথা মানা দরকার। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সুফল ... বিশদ
এই বিলটির উত্থাপন দেখিয়ে দিল বিরোধীদের প্রতিরোধ সত্ত্বেও মোদি সরকার দ্রুত সমাজ সংস্কারের অঙ্গীকার রক্ষায় কতটা আন্তরিক। এটা সেই সমস্ত মুসলিম নারীর জন্য একটি বিধিবদ্ধ রক্ষাকবচ হয়ে উঠল যাঁরা একটি চূড়ান্ত অন্যায় প্রথার নীরব শিকার হচ্ছিলেন।
বিলটিকে রাজ্যসভায় জায়গা করে দেওয়ার বৃত্তান্ত এবং একইসঙ্গে সংসদের বাইরেটাও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত রেখে গিয়েছে। প্রথমত পরিষ্কার হল যে ভারতে নারীদের সামাজিক মর্যাদা, সম্মান ও সম্ভ্রম দিতে নরেন্দ্র মোদির সরকারের নিরলস প্রচেষ্টা রয়েছে। সমানভাবে প্রকট হয়ে গিয়েছে কংগ্রেস দলের দ্বিচারিতামূলক মতলবটি, যারা বরাবর সংখ্যালঘুদের ভোটব্যাঙ্ক হিসেবেই দেখে এসেছে, নারীর আত্মমর্যাদার কথা না-ভেবে তাদের নিদারুণ বৈষম্যের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেছে।
আর একটি উল্লেখযোগ্য দিক লক্ষ করা গিয়েছে যে তাদের তাঁবের দলগুলিকে বাগে আনার ব্যাপারে কংগ্রেসের ক্ষমতা আজ ক্রমহ্রাসমান। যখন কোনও একটি সরকার জনগণের ও সমাজের কল্যাণে ব্রতী থাকে, যেমনটা নরেন্দ্র মোদির সরকার রয়েছে, তখন অন্যদলগুলির পক্ষে তাতে সমর্থন দেওয়াটাই শুধু স্বাভাবিক।
তিন তালাক বিল এনডিএ-বহির্ভূত দলগুলির যে সমর্থন পেয়েছে তা স্বাগত। সমস্ত রাজনৈতিক দলের কাছে আমাদের আরও আবেদন, ভারতকে একটি জাতি এবং সমাজ হিসেবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথে বাধাস্বরূপ গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলিতে তারা রাজনৈতিক মতপার্থক্যের ঊর্ধ্বে উঠে আসুক এবং দলাদলি ভুলে সমর্থন দিক।
ভারতের সাম্প্রতিক ইতিহাস প্রিজমের মাধ্যমে তিন তালাকে কংগ্রেস দলের ভূমিকার বিশ্লেষণটি গুরুত্বপূর্ণ। তিন দশক আগে লোকসভায় কংগ্রেসের চারশোর বেশি এমপি ছিলেন, তাদের কাছে সুবর্ণ সুযোগ ছিল শাহবানু মামলাটিকে হাতিয়ার করে মুসলিম নারীদের প্রতি ঐতিহাসিক অন্যায়ের প্রতিকার করে ফেলার। ১৯৮৫ সালে সুপ্রিম কোর্ট তিন তালাকের শিকার শাহবানুর পক্ষে রায় দিয়েছিল, তাঁর জন্য প্রতি মাসে ৫০০ টাকা ভাতার সংস্থান করেছিল এবং বলেছিল যে তাদের রায়টি শরিয়া বা ইসলামি আইন মোতাবেক। যাই হোক, এটা কার্যকর করার পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সেদিন আত্মসমর্পণ করেছিল—মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের প্রতিনিধিদের চাপের কাছে এবং ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির লালসার কাছে, এবং আদালতের রায় নস্যাৎ করে দেওয়ার জন্য একটি আইনও প্রণয়ন করেছিল তারা।
কংগ্রেস সরকারের এই আত্মসমর্পণ আহত করেছিল বামপন্থী আইনজ্ঞ তথা সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি ভি আর কৃষ্ণ আয়ারকে। কংগ্রেস সরকারের মন্ত্রী আরিফ মহম্মদ খান আদালতের সিদ্ধান্তটিকে ‘সঠিক’ বলে মন্তব্য করেছিলেন এবং সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে তিনি ইস্তফাও দিয়েছিলেন। আরিফ মহম্মদ খানকে রাজীব গান্ধী বুঝিয়েছিলেন যে সুপ্রিম কোর্টের এই প্রগতিশীল রায়টিকে তিনি কার্যকর করবেন। ইস্যুটিকে সেই থেকে বছরের পর বছর ঠান্ডাঘরে ফেলে রাখা হয়েছিল, নরেন্দ্র মোদির সরকার যখন সেটাকে সামনে আনল, তখনও কংগ্রেসের বিদ্বেষপূর্ণ দোলাচলে কোনও পরিবর্তন দেখা গেল না। তিরিশ বছর আগে কংগ্রেসের যে ‘ডাবল স্ট্যান্ডার্ড’ এবং বিভাজনের রাজনীতি ছিল, সেটা স্পষ্ট হয়েছিল যখন রাজীব গান্ধীর ভুলটি নিয়ে অস্বস্তি এড়ানোর কৌশল তারা করেছিল। প্রতিবন্ধকতার নীতিতে অন্তরের চেহারাটি প্রতিফলিত হয়েছিল, যা তোষণ আর ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি চিরস্থায়ী করে। তিন তালাক নিষিদ্ধকরণের আইন এই ধরনের রাজনীতির উপর এক বিরাট আঘাত।
এই বিল ভারতের তথাকথিত উদারপন্থীদের পুরো বেআব্রু করে দিয়েছে। এই সমস্ত ‘উদারপন্থীদের’ মধ্যে যাঁরা লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে স্বঘোষিত ‘চ্যাম্পিয়ন’ তাঁরা লক্ষণীয়ভাবে নীরব অথবা যে বিলটি মুসলিম নারীদের ক্ষমতায়নের চেষ্টা করছে তার বিরোধিতার চাতুরিতে নিয়োজিত হয়েছেন। এই দ্বিচারিতা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, এই স্বঘোষিত উদারপন্থীরা মানবিক মূল্যবোধের পূজারি না-হয়ে, নিছক সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির ক্রীড়নক।
উল্লেখ করার মতো বিষয় এই যে, এই ধরনের একটি আইনপ্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা কী—এই প্রশ্ন যাঁরা তুলছেন তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন যে—২০১৭ সালের জানুয়ারিতে সুপ্রিম কোর্ট এই প্রথা বাতিল করে দেওয়ার পরেও কয়েকশো নারী তিন তালাকের শিকার হয়েছেন বলে খবর আছে। এই ঔদ্ধত্যের কারণেই একটি কঠোর আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে, যা দিয়ে অন্যায় প্রথাটি রুখে দেওয়া সম্ভব হবে। আইনটি ইসলাম-বিরুদ্ধ নয়—এটাকে সমর্থন করে পাকিস্তান, ইরান, ইরাক ও সিরিয়াসহ ১৯টি দেশ এবং তারা তাৎক্ষণিক মৌখিক বিবাহবিচ্ছেদ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।
আমাদের বোঝা দরকার যে, তিন তালাকের বিরুদ্ধে যে মহিলারা দীর্ঘ লড়াইটা করেছেন তাঁদের কারও মধ্যে কোনোরকম রাজনৈতিক অভিসন্ধি ছিল না। নিজেদের জীবনে নেমে আসা অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াইতে এই অসীম সাহসী মহিলারা ছিলেন সাধারণ। এই অন্যায় প্রথার শেষ দেখে ছাড়ার প্রতিজ্ঞা নিয়েছিলেন তাঁরা এবং শেষমেশ দেশের সর্বোচ্চ আদালতে জয়লাভ করেছেন। আমাদের সরকার তিন তালাক আইন প্রণয়ন করে তাঁদের সংগ্রামের পিছনে বিধিবদ্ধ সমর্থন জোগাল। যাই হোক, আইনপ্রণেতা এবং রাজনৈতিক দলগুলির অবশ্যকর্তব্য হল এই ধরনের লড়াইকে সমর্থন জোগানো এবং সঠিক দিশা দেখানো।
শুধুমাত্র মুসলিম সমাজের জন্য প্রযোজ্য আইনপ্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিরোধী পক্ষ যে বিতর্কটি তুলেছে তা ভিত্তিহীন। অন্যসকল গোষ্ঠীর ভেতরে বদ্ধমূল অনেক প্রথার সংস্কারের লক্ষ্য নিয়েও স্বাধীন ভারত আইন তৈরি করতে দেখেছে। হিন্দু বিবাহ আইন, খ্রিস্টান বিবাহ আইন, এবং বাল্যবিবাহ ও পণপ্রথা নিষিদ্ধকরণের আইনগুলি হল সামাজিক প্রথার সংস্কারে হস্তক্ষেপের দৃষ্টান্ত।
যাঁরা সুবিধাবাদী, সংকীর্ণ রাজনীতির বিতর্কে মগ্ন তাঁরা এগুলি মানতে অস্বীকার করছেন। তিন তালাককে ফৌজদারি অপরাধ করা নিয়ে যাঁরা প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা কৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছেন আর কিছু সত্য যে—হিন্দু সমাজের অনেক প্রথাকেও ক্রিমিনাল অফেন্স বা ফৌজদারি অপরাধ গণ্য করা হয় এবং সেসবের জন্য কঠোর শাস্তির বিধানই রয়েছে।
তিন তালাক নিষিদ্ধকরণের আইন তৈরি করার জন্য নরেন্দ্র মোদির সরকারের কৃতিত্ব প্রাপ্য। এখন আমি নিশ্চিত যে মোদিজি একজন সমাজ সংস্কারক হিসেবে ইতিহাসে উজ্জ্বল স্থান করে নেবেন—তাঁর আসন নির্দিষ্ট হবে রাজা রামমোহন রায় এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পঙ্ক্তিতে, যাঁরা অসংখ্য নারীর কল্যাণে লড়েছিলেন এবং ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন।