কোনও কিছুতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভাববেন। শত্রুতার অবসান হবে। গুরুজনদের কথা মানা দরকার। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সুফল ... বিশদ
রাজ্যগুলি সার্বভৌম
‘কোঅপারেটিভ ফেডারালিজম’ বলতে কী বোঝায়? এই ফ্রেজ এটাই নিশ্চিত করে যে ভারত হল একটি ফেডারাল স্টেট বা যুক্তরাষ্ট্র। একটি কেন্দ্রীয় সরকার আছে এবং কিছু রাজ্য সরকার আছে। প্রত্যেক সরকারের জন্যই সংরক্ষিত নিজস্ব সাংবিধানিক পরিধি (এরিয়াস অফ লেজিসলেশন) আছে। রাজ্য সরকারের জন্য সংরক্ষিত ক্ষেত্র কেন্দ্রীয় সরকার (সংসদের মাধ্যমে) বেদখল করতে পারে না, তেমনি রাজ্য সরকারও (বিধানসভার মাধ্যমে) কেন্দ্রের জন্য সংরিক্ষত ক্ষেত্র বেদখল করতে পারে না। আবার কিছু ক্ষেত্র আছে যেখানে উভয় সরকারই আইনপ্রণয়ন করার অধিকারী। আইনপ্রণয়ণের ক্ষেত্রগুলির (লেজিসলেটিভ ফিল্ডস) বিভাজনই হল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর সার। সাংবিধানিক ব্যবস্থার (কনস্টিটিউশনাল স্কিম) প্রতি শ্রদ্ধাটিই হল সহযোগিতামূলক মৈত্রীতন্ত্র (কোঅপারেটিভ ফেডারালিজম)।
তা সত্ত্বেও, ভারতের সংবিধানে কিছু ব্যতিক্রমী ব্যবস্থাও আছে—যে-কোনও অনির্ণীত বিষয়ে আইনপ্রণয়নের জন্য সংসদকে অনুমতি দিতে (সংবিধানের ২৪৮ ধারা); রাজ্য তালিকাভুক্ত যে-কোনও বিষয় একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ‘জাতীয় স্বার্থে প্রয়োজনীয় অথবা উপযুক্ত’ গণ্য হলে (সংবিধানের ২৪৯ ধারা); যখন দেশে জরুরি অবস্থা চলছে তখন
যে-কোনও বিষয়ের ক্ষেত্রে (সংবিধানের
২৫০ ধারা)।
সংবিধানের ২৫৮(২) ধারাটি একটি ‘ইন্টারেস্টিং’ ব্যবস্থা। সংসদে প্রণীত একটি আইন যা রাজ্যকে বা তার অফিসারদের উপর কিছু ক্ষমতা এবং দায়িত্ব অর্পণ করতে পারে, কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী কেন্দ্রকে এই বাবদ রাজ্যকে অর্থ দিতে হবে। এই ব্যবস্থাটিতে রাজ্যগুলির সার্বভৌম, অধিকার এবং ক্ষমতার প্রতি জোরালো সমর্থন রয়েছে।
বিলগুলি পিছন দিয়ে আনা হচ্ছে
বিজেপি সরকারটি ব্যতিক্রম: এটা না রাজ্যগুলির অধিকারকে মর্যাদা দেয়, না খেয়াল করে সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা বা সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্যগুলি।
ফেডারালিজমের প্রতি বিজেপি সরকারের দায়বদ্ধতা কতখানি, রাজ্যসভায় তাদের বিল পাস করিয়ে নেওয়ার রকম দেখেই তা পরিমাপ করা যায়। লোকসভা যেখানে জনগণের কক্ষ (হাউস অফ দ্য পিপল) সেখানে রাজ্যসভা হল রাজ্যগুলির একটি পর্ষদ (কাউন্সিল অফ স্টেটস)। ২ আগস্ট চলতি অধিবেশনে লোকসভা ২৮টি বিল পাস করে দিল এবং রাজ্যসভা পাস করে দিল ২৬টি বিল। সেগুলির একটিও ‘রিপিট’ হল না, ‘একটি বিলও’ বিরোধী দলগুলির সঙ্গে আলোচনার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়া হল না। বিস্তারিত ‘স্ক্রুটিনি’র জন্য একটিও বিলকে স্ট্যান্ডিং কমিটি কিংবা সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানো হল না। কোনও বিলের জন্য রাজ্য সরকারগুলির মতামত নেওয়া হল না, এমকী সেই বিলগুলিকেও নেওয়া হল না যেগুলি সংবিধানের যুগ্মতালিকাভুক্ত (তালিকা ৩) এবং এর ফলে রাজ্যগুলির অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করা হল। বিরোধীদের পক্ষ থেকে আনা একটিও সংশোধনী প্রস্তাব সরকার গ্রহণ করেনি।
কয়েকটি দৃষ্টান্তই যথেষ্ট। ‘জাস্টিস পুত্তাস্বামী’তে সংবিধানের ১১০ ধারার পরিধি সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্ট তার ব্যাখ্যা দিয়ে দিয়েছে এবং সরকারের পক্ষে এই রায় অবশ্যপালনীয়। রাজ্যসভা একটি অর্থবিল (মানি বিল) সংশোধন করতে পারে না বা বিলটি বাতিল করতে পারে না; রাজ্যসভা কিছু পরামর্শ দিতে পারে মাত্র এবং বিলটি লোকসভায় ফেরত পাঠাতে পারে, পরামর্শগুলি লোকসভা গ্রহণ করতেও পারে, না-ও পারে। রাষ্ট্রপতি অর্থবিলের জন্য তাঁর সম্মতি ঝুলিয়ে রাখতে পারেন না কিংবা পুনর্বিবেচনার জন্য সেটি সংসদে ফেরতও পাঠাতে পারেন না। এই
সকল সীমাবদ্ধতার সুযোগ নিয়ে, ১১০ ধারা নির্লজ্জের মতন লঙ্ঘন করে, সরকার অর্থবিলের [ফিনান্স (নং ২) বিল] মাধ্যমে অন্তত দশটি নন-ফিনান্সিয়াল আইন সংশোধন করে নিয়েছে এবং এইভাবে এড়িয়ে গিয়েছে রাজ্যসভার স্ক্রুটিনি অথবা একটি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির পুনর্বিবেচনার নির্দেশ।
তথ্যের অধিকার আইন, ২০০৫ সর্বত্র ‘সেমিফাইনাল লেজিসলেশন’ হিসেবে অভিনন্দিত হয়েছে। এই আইনের ১৫ নম্বর ধারা রাজ্য তথ্য কমিশন গঠনের জন্য রাজ্য সরকারকে ক্ষমতা দিয়েছে। রাজ্য তথ্য কমিশনার বাছাই এবং নিয়োগ রাজ্যগুলিই করবে। এই অফিসের প্রাথমিক মেয়াদ ছিল পাঁচ বছর। এই পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বেতন, ভাতা এবং অন্যসকল শর্ত নির্ধারণের ক্ষমতা এযাবৎ রাজ্যগুলির উপর ন্যস্ত ছিল (ধারা ১৬)। এখন প্রাথমিক শর্ত এবং বেতন, ভাতা ও অন্য শর্তাবলি নির্ধারণের ওই ক্ষমতাটি কেন্দ্র নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছে! আমরা জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কেন? কোনও জবাব মেলেনি।
‘ন্যাশনাল মেডিকেল কমিশন বিল’ নামে যেটি আনা হয়েছে সেটি রাজ্যগুলিকে চূড়ান্ত অপমান। মেডিকেল শিক্ষার ব্যবস্থা করা এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য রাজ্য সরকারগুলির হাতে যে ক্ষমতা আছে সেগুলির সবই কেড়ে নেওয়া হয়েছে এবং পড়ে রইল মাত্র প্রতিটি রাজ্যকে কমিশনের চার বছর মেয়াদের মধ্যে দু’বছরের সদস্যপদ দেওয়ার ব্যবস্থাটি! এটা মেডিকেল শিক্ষাকে তালিকা ৩ থেকে তালিকা ১-এ সরিয়ে দেওয়ারই শামিল। তবুও রাজ্যগুলির পর্ষদ এটাকে অনুমোদন দিয়ে দিল রাজ্যগুলির কোনোরকম আপত্তি ছাড়াই।
ঝুলিতে প্রতিটি চাতুরি
রাজ্যসভায় বিলগুলির উপর ভোটাভুটি সরকার কী করে ‘ম্যানেজ’ করে? মুসলিম নারী (বিবাহ অধিকার সুরক্ষা) বিল বা তিন তালাক বিল নামে পরিচিত বিলটির কথাই ধরা যাক। সরকার ৯৯-৮৪ ভোটে জিতে গেল, কারণ ভোটাভুটির সময় ৪৬ জন বিরোধী সদস্য অনুপস্থিত ছিলেন! বহুজন সমাজ পার্টির (বিএসপি) একজনও উপস্থিত ছিলেন না। সমাজবাদী পার্টির (এসপি) ছ’জন সদস্য গরহাজির ছিলেন। এনসিপির চারজন সদস্যের মধ্যে অনুপস্থিত ছিলেন দু’জন। একেবারে ভোটাভুটির দিনেই একজন কংগ্রেস সদস্য ইস্তফা দিলেন (এবং পরদিন বিজেপিতে যোগ দিলেন)। কংগ্রেসের চারজন সদস্য অনুপস্থিতও ছিলেন। এআইএডিএমকে, জেডি(ইউ), টিআরএস এবং পিডিপি সদস্যরা বিলের বিরুদ্ধে ভাষণ দিলেন বটে ভোটাভুটির সময় তাঁরা উধাও হয়ে গেলেন!
বিভাজন, ফুসলানি, চোখরাঙানি, শাসানি, অথবা ‘ক্লোজ ডিল’—ঝুলিতে যতরকম চাতুরি কৌশল আছে, আইন পাস করানোর জন্য, তার সবগুলিই ব্যবহার করেছে বিজেপি—এর ফলে যে জিনিসটি হতে চলেছে তা হল—রাজ্যগুলি পুরপ্রশাসনের স্তরে নেমে আসবে এবং ওইসঙ্গে যোগ হবে ‘ওয়াননেস’-এর অশুভ আইডিয়া—সবকিছুর জন্য একটিই সরকার।