একটা রায়দান। তাতেই প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার শূন্যপদে চাকরির দরজা খুলে গেল। প্রায় ছ’বছরের মাথায় নিজেদের অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশের নির্দেশ প্রত্যাহার করে নিয়ে শুক্রবার কলকাতা হাইকোর্ট রাজ্যের উচ্চ প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের ছাড়পত্র দিল। এই রায়ে স্পষ্ট হল চাকরিপ্রার্থীদের পাশে রয়েছে আদালত। বছরের পর বছর হাপিত্যেশ করে অপেক্ষারত চাকরি প্রার্থীদের মুখে হাসি ফুটল। দীর্ঘদিনের যন্ত্রণার অবসান ঘটল। এর ফলে রাজ্যের বহু শিক্ষিত বেকার যুবক যুবতীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হল। রাজ্যে উচ্চ প্রাথমিক স্তরে শিক্ষক নিয়োগের জন্য এর আগে প্রার্থীদের নম্বরসহ মেধাতালিকা প্রকাশ করার জন্য স্কুল সার্ভিস কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। সেই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করায় সন্তুষ্ট আদালত স্থগিতাদেশ তুলে নিয়ে শিক্ষক নিয়োগের যে ছাড়পত্র দিয়েছে তাতে মামলাকারীদের বক্তব্যও শোনার ব্যবস্থা রয়েছে। মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে যে আদালত সংশ্লিষ্ট মামলাটি পর্যালোচনা করেছে তা রায়ের বক্তব্যেই স্পষ্ট। উচ্চ প্রাথমিকে নিয়োগের ব্যাপারে রাজ্য সরকার যে সত্যিই আন্তরিক তা সরকারি বক্তব্যেও বোঝা গেছে। নতুন কোনও মামলার জন্য নিয়োগ প্রক্রিয়া যাতে আটকে না যায় তা দেখার পাশাপাশি আদালতের রায়ের প্রেক্ষিতে অভিযোগ জানানোরও সুযোগ থাকছে। আদালত পরিষ্কার জানিয়েছে, এ নিয়ে কারও কোনও বক্তব্য থাকলে দু’সপ্তাহের মধ্যে কমিশনের কাছে অভিযোগ জানাতে পারবেন। রাজ্যের তরফেও বলা হয়েছে, যদি তালিকায় কোথাও কোনও ত্রুটি থাকে তাহলে তা অবশ্যই সংশোধন করে নেওয়া হবে। এমনিতেই মামলাজনিত কারণে চাকরি প্রার্থীদের মূল্যবান পাঁচ-পাঁচটি বছর কেটে গেছে। তাই সহানুভূতিশীল হয়ে পরবর্তী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যোগ দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রার্থীদের পাঁচ বছরের ছাড় দেওয়া যায় কি না সেটাও বিবেচনা করার পরামর্শ দিয়েছে আদালত। আদালতের রায় কমিশন ও রাজ্যকে যেমন স্বস্তি দিয়েছে তেমনই চাকরি প্রার্থীদেরও আশ্বস্ত করেছে। সপ্তাহের শেষ কাজের দিনে আদালতের আরও একটি খবরে স্বস্তি পেল নবান্ন। শুক্রবার ভুয়ো ভ্যাকসিন মামলায় আদালত জানিয়েছে, দেবাঞ্জন দেব কাণ্ডে কলকাতা পুলিসের তদন্তে ত্রুটি আছে বলে মনে হয় না। তাই এই মামলায় সিবিআই তদন্তের প্রয়োজন নেই। ফলে ভরসা বাড়ল পুলিসি তদন্তের উপর। উচ্চ প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া বা কলকাতা পুলিসের তদন্তে সন্তোষপ্রকাশ—সরকারের কাছে অবশ্যই তা জোড়া স্বস্তির খবর। সেইসঙ্গে দেবাঞ্জন কাণ্ডের জেরে সরকারকে নিশানা করে বিরোধীদের তোপ দাগার বিষয়টাও কিছুটা হলেও ধাক্কা খেল। যদিও দুটি ক্ষেত্রেই ফের মামলা বা সিবিআই তদন্তের দাবি ওঠার পথ বন্ধ করে দেয়নি আদালত।
সালটা ২০১৫। উচ্চ প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের জন্য টেট পরীক্ষা হয়েছিল। তার পরের বছর এর ফল প্রকাশের পর থেকেই শুরু হয় বিপত্তি। ভূরি ভূরি অভিযোগ জানিয়ে মামলা হয়। অবশেষে এসএসসিকে সেই নিয়োগের ছাড়পত্র দেওয়ায় একটা জট খুলল। তবে গোলাপে কাঁটা আছে। শুক্রবার রায় দানের দিনে সল্টলেকে এসএসসি’র অফিসে বিক্ষোভ দেখান একদল প্রার্থী। যে জ্বলন্ত সমস্যাগুলিকে তুলে ধরে তাঁরা বিক্ষোভ দেখালেন তাঁদের জন্যও অভিযোগ জানানোর সুযোগ রেখেছেন মাননীয় বিচারপতি। বলাবাহুল্য এই নিয়োগের ক্ষেত্রে এতদিন যে অচলাবস্থা চলছিল আদালতের নির্দেশে তা কাটতে চলেছে। শিক্ষক নিয়োগের মতো ভুয়ো ভ্যাকসিন মামলাতেও আপাতত রাজ্যকে স্বস্তি দিয়েছে আদালত। করোনাকালে যখন গোটা দেশসহ রাজ্য তোলপাড় তখনই ভুয়ো আইএএস দেবাঞ্জন দেবের কীর্তি এক অন্য মাত্রা জুগিয়েছে। মন্ত্রী-নেতা-প্রশাসন, সব মহলেই তার অবাধ বিচরণ ও যাবতীয় ভুয়ো কার্যকলাপের জাল কতদূর বিস্তৃত তার তদন্তে বিশেষ পুলিস টিম তৈরি করেছে লালবাজার। দেবাঞ্জন কাণ্ডে কোনও অপরাধীকে রেয়াত করা হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী তথ্য পুলিসমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফলে কার্যত আদাজল খেয়ে নেমেছে উর্দিধারীরা। প্রায় রোজই কোনও না কোনও নতুন রহস্য উন্মোচিত হচ্ছে। তদন্তের এই জেট গতিতে সন্তুষ্ট আদালত। সরকার আদালতে জানিয়েছে, আর কিছু নথি পেলেই চার্জশিট দেওয়া হবে। তাই কলকাতা পুলিসের উপর আস্থা রেখে সিবিআই তদন্তের আর্জি খারিজ করেছে আদালত। তবে, এও বলা হয়েছে, কলকাতা পুলিসের তদন্তের শেষে যদি দেখা যায় যথাযথ তদন্ত হয়নি সেক্ষেত্রে মামলাকারী বা অন্য কেউ নতুন করে সিবিআই তদন্তের আর্জি জানাতে পারেন।
নিয়োগের ক্ষেত্রেই হোক বা জালিয়াতির তদন্ত—সবক্ষেত্রেই স্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষতা বজায় রাখাটা জরুরি। তা না হলে সুবিচারের আশায় যে কেউ আদালতের দ্বারস্থ হতেই পারেন। কিন্তু কথায় কথায় মামলা ঠুকে পরিস্থিতি জটিল করে তুললে তার ফল ভুগতে হয় অনেককে। বছরের পর বছর মামলা চলায় শুধু চাকরিপ্রার্থীদেরই মূল্যবান অনেকগুলি বছর নষ্ট হয়নি স্কুলের বহু শিক্ষক পদ শূন্য থাকায় ব্যাহত হয়েছে পঠনপাঠন। এবার অন্তত আদালতের নির্দেশ পালন করে এসএসসি তার দায়িত্বটি যথাযথভাবে পালন করতে পারবে।