বিদ্যার্থীরা মাঝে মধ্যে মানসিক উদ্বেগের জন্য শিক্ষায় অমনোযোগী হয়ে পড়বে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে নানা সুযোগ আসবে। ... বিশদ
আফগানিস্তান থেকে আমেরিকা সেনা সরালে শান্তি ফিরুক না-ই বা ফিরুক, তালিবান শাসন যে আরও জাঁকিয়ে বসবে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। আর সেই সঙ্গে জলাঞ্জলি দিতে হবে নারী-স্বাধীনতা। সিঁদুরে মেঘ দেখছেন লায়লারা। তাঁদের আশঙ্কা, মার্কিন সেনা সরলেই তালিবান আসল চেহারা দেখাবে। তালিবানি জমানায় মেয়েদের অবস্থাটা ঠিক কেমন ছিল মনে করলেই শিউরে ওঠেন ওরা। চোখের সামনে স্কুলে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল তালিবান জঙ্গিরা। সেই আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে গিয়েছিল কত মেয়ের স্বপ্ন। সেই আতঙ্ক আবার ফিরে আসছে আফগান ভূমিতে।
‘আফগানিস্তানে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা হবেই।’ স্বমূর্তি ধারণ করে দু’একবার হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে তালিবান। আমেরিকা ও কাবুলের গণতান্ত্রিক সরকারের সঙ্গে আলোচনার ‘নাটক’ করলেও শরিয়ত আইন প্রতিষ্ঠা করাই যে তাদের উদ্দেশ্য তা স্পষ্ট করে দিয়েছে জঙ্গিগোষ্ঠীটি। বিশ্লেষকদের মতে, আফগানিস্তান থেকে মার্কিন বাহিনী চলে গেলে কাবুলে আশরাফ গনি সরকারের পতন সময়ের অপেক্ষা মাত্র। আর ফের ক্ষমতা হাতে পেলে নয়ের দশকের তালিবানি অরাজকতা ফিরবে সে দেশে। শরিয়ত আইন চালু করার নামে ফের মহিলাদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হবে। বামিয়ান বুদ্ধের মতো আরও ভাস্কর্য ধংসের মুখে পড়বে। ইসলামের নামে প্রকাশ্যে কাটা হবে মাথা! সত্যিই কি তাই?
কথা রাখেনি আমেরিকা
পাক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল হামিদ গুল আজ বেঁচে নেই। হামিদ গর্বের সঙ্গে বলতেন, যখন আফগানিস্তানের ইতিহাস লেখা হবে, তখন এ কথাও নথিভুক্ত থাকবে যে, আইএসআই আমেরিকার সাহায্য নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নকে পরাজিত করেছিল।
এরপরই নাকি তিনি ব্যঙ্গ করে বলতেন, পরবর্তী সময়ে ইতিহাসবিদরা এটাও লিখে রাখবেন যে, একদিন এই আইএসআই আমেরিকার মদত নিয়ে আমেরিকাকেই হারিয়েছিল।
আফগানিস্তানের মাটিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের লাল বাহিনীকে গুটিয়ে নেওয়ার পুরো প্রক্রিয়ায় আইএসআইয়ের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল বলে হামিদ গুল যে দাবি করতেন, তা সম্পূর্ণ সঠিক। এবং পাকিস্তান একই জঙ্গিদের কাজে লাগিয়ে আফগানিস্তানে একটি মুজাহিদিন গোষ্ঠী তৈরি করে। সেই মুজাহিদিন গোষ্ঠীই হচ্ছে তালিবান। যারা খুব দ্রুত আফগানিস্তান দখল করে এবং আইএসআইয়ের সহযোগী শক্তি হিসেবে গোটা আফগানিস্তান শাসন করতে শুরু করে। তবে হামিদ গুল ও তাঁর বাহিনীর সেই সুখের অনুভূতি বেশি দিন টেকেনি। কারণ, ততদিনে তালিবানের নতুন ‘ইসলামি’ সাম্রাজ্যে গেড়ে বসে ওসামা বিন লাদেন এবং আমেরিকায় নাইন–ইলেভেনের হামলার নির্দেশ দেয়। পরে আমেরিকার তীব্র সামরিক অভিযানে তালিবানের পতন হয় এবং ওসামা বিন লাদেন গা ঢাকা দেয় পাকিস্তানে। অ্যাবোটাবাদে সেই লাদেনকে শনাক্ত করে আমেরিকা এবং ২০১১ সালে মার্কিন বিশেষ বাহিনী তাঁকে হত্যা করে। একইসঙ্গে আফগানিস্তানে চলতে থাকে সংঘর্ষ।
কিন্তু যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমেরিকা এই যুদ্ধ শুরু করেছিল, গত ২০ বছরে তারা কোনও সাফল্য পায়নি। এই সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে তারা না পেরেছে সেখানকার সন্ত্রাসবাদীদের নিকেশ করতে, না পেরেছে তালিবানকে ধ্বংস করতে। এত প্রাণহানি, এত সম্পদ ক্ষয় ও এত সামাজিক বিপর্যয়ের মূল্য হিসেবে শেষ পর্যন্ত তালিবান ও সন্ত্রাসবাদীদেরই আফগানিস্তানের পূর্ণ ক্ষমতায় আসার আশঙ্কা জোরালো হয়েছে। আর প্রায় দু’দশক ধরে আফগানিস্তানের মাটিতে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চালিয়ে ক্লান্ত আমেরিকা এবার নিজেকে সরিয়ে নিতে ব্যস্ত। চলতি বছরের ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সেখান থেকে তারা সব সেনা গুটিয়ে নেবে বলে ঘোষণা করেছে। আমেরিকান বাহিনী ফিরে গেলে আফগান প্রেসিডেন্ট আশরফ গনির সম্মুখে সুবিপুল দায়িত্ব উপস্থিত হবে—জঙ্গিদের বিরুদ্ধে একা লড়বার দায়িত্ব। আশঙ্কার মেঘ ঘনিয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায়, ভারতেও। জঙ্গিরা ক্ষমতাবৃদ্ধি করলে ভূ-রাজনীতি পাল্টাবে। নয়াদিল্লির আশঙ্কা, আমেরিকা ও ন্যাটোর সেনা ফিরে গেলে পাকিস্তানের আইএসআই-নিয়ন্ত্রণাধীন হাক্কানি গোষ্ঠী শূন্যস্থান পূরণে উদ্যোগী হতে পারে। মাথাচাড়া দিতে পারে ভারতবিরোধী সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলিও। জঙ্গি সংগঠনগুলিকে ভিতর থেকে মদত দেবে তালিবান এবং বাইরে থেকে পাকিস্তান। ফলে তারাই হয়ে উঠবে আফগানিস্তানের ভাগ্যবিধাতা—এমনই মনে করছে সাউথ ব্লক। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আফগান নীতি স্বস্তি দিচ্ছে না ভারতকে।
আইএসআইয়ের সঙ্গে গাঁটছড়া বেধে তালিবান গোষ্ঠী একাধিক বার ভারতের নিরাপত্তাকে চ্যালেঞ্জ করেছে অতীতে। আমেরিকার সেনা সরিয়ে নেওয়ার পর আফগানিস্তানের রাজনীতি এবং বাস্তবতায় ভারতের ভূমিকাও কিছুটা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রভাব বাড়বে রাওয়ালপিন্ডির। তবে পাকিস্তানও খুব ভালো করেই জানে, যেকোনও সময় ফ্রাঙ্কেনস্টাইন হয়ে উঠবে সেই তালিবান জঙ্গিরাই।
দিন গুনছে তালিবান জঙ্গিরা
আফগানিস্তানের দক্ষিণের বেশিরভাগ অঞ্চলই এখন তালিবানের হাতের মুঠোয়। উত্তরেও একের পর এক এলাকা দখলে তৎপর। তাজিকিস্তান সীমান্ত এলাকায় ক্ষমতা বাড়ানোর কয়েক দিনের মধ্যে সেখানে অবস্থিত শির খান বন্দরের দখল নিয়েছে তারা। আফগানিস্তানের ৩৯৮টি জেলার মধ্যে ১০৫টি ইতিমধ্যেই তালিবানের দখলে।
তালিবান আগ্রাসনের সামনে রীতিমতো হার মানছে আফগান বাহিনী। তাজিকিস্তানের সঙ্গে দেশের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যপথ কুন্দুজ শহর। যার দখল আগেই নিয়েছে তালিবান। সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে আশপাশের গ্রামীণ অঞ্চলেও। বন্দর এলাকা দখলের কথা স্বীকার করে নিয়েছেন তালিবানের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ। কিছু কিছু জায়গায় প্রায় বিনা প্রতিরোধেই ঘাঁটি গেড়েছে তালিবান বাহিনী। যেমনটা হয়েছে উত্তর আফগানিস্তানের সীমান্ত জেলা ইমাম সাহিবে। কূটনৈতিক ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ দোশি জেলাও এখন তালিবানের দখলে। উত্তর আফগানিস্তানের সঙ্গে রাজধানী কাবুলের সংযোগকারী একমাত্র রাস্তাটি গিয়েছে এই জেলার মধ্যে দিয়েই। যে কারণে আতঙ্কিত আফগান সরকার এবার স্থানীয় ‘স্বেচ্ছাসৈনিকদের’ হাতে অস্ত্র তুলে দিতে ‘বাধ্য’ হয়েছে। প্রতি মুহূর্তে আতঙ্ক বাড়িয়েছে তালিবানের ছোড়া রকেট এবং স্বয়ংক্রিয় বন্দুকের আওয়াজ। তা হলে কি ফের অশান্ত সময়ই ফিরছে আফগানিস্তানে? এখনই জবাব না-মিললেও জল মাপছে সব পক্ষই।
মার্কিন সেনা ফিরে যাবে আর তালিবান নিরাপদে কাবুলের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবে, আইএসআই এটাই আশা করে আছে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। পাক গোয়েন্দা সংস্থা মনে করতে পারে, কাবুলে সাফল্যের কারণে তাদের যাবতীয় অপরাধ ক্ষমা করে দেবে পাকিস্তানি তালিবান। তাহলেই তো শান্তি ফিরে আসবে। অর্থাৎ, আফগানিস্তান আইএসআইয়ের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে আর পাকিস্তানি তালিবানও পাক সেনাবাহিনীর ওপর হামলা বন্ধ করে দেবে। তারাও আইএসআইয়ের সঙ্গে যোগ দেবে ‘প্রকৃত শত্রু’ ভারতের বিরুদ্ধে লড়াই তীব্রতর করতে। কে না জানে, বেশির ভাগ তালিবান নেতার পরিবার থাকে পাকিস্তানে। ইসলামাবাদ বরাবরই তালিবানের সঙ্গে দর কষাকষির প্রশ্নে এই বিষয়টিকে কাজে লাগায়।
তালিবানের দিকে তাকিয়ে সাউথ ব্লক
নিজেদের বিদেশনীতি বদলে আফগানিস্তানে তালিবানের সঙ্গে গোপনে আলোচনার দরজা খুলেছে ভারত। কূটনীতিকদের মতে, এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে সাহসী। তবে এতে নির্দিষ্ট কিছু লাভের সম্ভাবনা যেমন আছে, তেমনই ঝুঁকিও কম নয়। নয়াদিল্লি বরাবরই কাবুলকে দেখে ইসলামাবাদের কথা মাথায় রেখে। সাউথ ব্লকের দিক থেকে চেষ্টা করা হয়, যাতে আফগানিস্তানের জাতীয়তাবাদী অংশ মজবুত হয়। যারা পাকিস্তানের নাক গলানো বরদাস্ত করবে না। প্রশ্ন হল, এই পরিপ্রেক্ষিতে সরাসরি তালিবানের সঙ্গে আলোচনা কতটা যুক্তিযুক্ত?
তালিবানদের একটা বড় অংশই কাবুলে ভারতের উপস্থিতি এবং কাজকে স্বীকৃতি দেয়। তারা প্রাথমিক ভাবে চাইবে না ভারতকে হটাতে। পাশাপাশি এটাও ধর্তব্যের মধ্যে রাখা হচ্ছে যে, আফগানিস্তান থেকে ভারত-বিরোধী জঙ্গিদের উচ্ছেদ করতে তালিবান হয়তো বিশেষ সক্রিয়তা দেখাবে না। কিন্তু তালিবানের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে গেলে তারা অন্তত এই জঙ্গিদের সাহায্য করা থেকে বিরত থাকতে পারে।
তবে এর ঝুঁকিও রয়েছে। পাকিস্তানের ইন্ধনে যে কোনও মুহূর্তে পিছিয়ে যেতে পারেন তালিব নেতারা। নিশানা করতে পারেন ভারতীয় স্বার্থকে। তালিবানের তরফে যাঁরা আলোচনা চালাচ্ছেন, তাঁদের সরিয়ে দিয়ে ক্ষমতা তুলে দেওয়া হতে পারে পাকিস্তানের মদত পাওয়া হাক্কানি গোষ্ঠীর মতো কট্টরপন্থীদের হাতে।
ভারতীয় সূত্রের বক্তব্য, তালিবানের সঙ্গে নয়াদিল্লি কথা বলুক বা না-বলুক, এমনিতেও তাদের সঙ্গে পাক মদত পাওয়া জঙ্গি গোষ্ঠীগুলির যোগাযোগ রয়েছে। ভারত বরাবরই এ নিয়ে উদ্বেগে থাকে। কিন্তু তালিবান-অক্ষ থেকে নিজেদের পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে ফেললে অন্য বিপদ রয়েছে। পরে তারা ক্ষমতায় এলে ভারতের উদ্বেগ আরও বাড়বে।
মিত্র দেশ আফগানিস্তানে পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে কতটা বদলাবে সম্পর্কের সমীকরণ— সেই দিকেই তাকিয়ে সাউথ ব্লক।