বিদ্যার্থীরা মাঝে মধ্যে মানসিক উদ্বেগের জন্য শিক্ষায় অমনোযোগী হয়ে পড়বে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে নানা সুযোগ আসবে। ... বিশদ
আসলে গত ১ জুলাই মাও সেতুংয়ের হাতে গড়া চীনা কমিউনিস্ট পার্টির শতবর্ষের আবহে দেশটার বদলে যাওয়া এই ধনতান্ত্রিক চেহারাটাই এখন প্রধান আলোচ্য। ব্যক্তিগত পুঁজির জন্য দরজাটা হাট করে না খুললে আখেরে দেশের অগ্রগতিই আটকে যাবে, হবে না উন্নয়নও। এই উপলব্ধিই চীনা কমিউনিস্ট পার্টিকে একশো বছর পরও অক্লেশে বাঁচিয়ে রেখেছে। গোটা বিষয়টাই ধনতন্ত্রের আবাহনের কথা শুনলেই এখনও উল্টো দিকে হাঁটা দেওয়া আমাদের দেশীয় কমরেডদের কাছে শিক্ষারও বইকি। যদি চীনের উন্নয়ন ও সময়ের সঙ্গে নিজেকে বদলে ফেলার বার্তাটা বাংলার কমরেডদের কানে ঠিক সময়ে পৌঁছত, তাহলে বিধানসভা নির্বাচনে মাত্র সাড়ে তিন শতাংশ ভোটে তাদের থমকে যেতে হতো না।
চীনা লাল পার্টির জন্ম ১৯২১এ। আর স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের যাত্রা শুরু ১৯৪৯ সালে। আর ২৮ বছর পর দেশটার শতবর্ষ। মাও বেঁচে ছিলেন ১৯৭৬ পর্যন্ত। সত্তরের দশকে এই বাংলাতেও ‘চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’ পোস্টার দেখেছি আমরা। মাওয়ের চলে যাওয়ার পর কেটে গিয়েছে সাড়ে চার দশক। তার চেয়েও বড় কথা, ঠিক ৩০ বছর আগে তাল কেটে গিয়েছে রুশ কমিউনিস্ট পার্টির। সেই থেকে আজ পর্যন্ত রুশ পার্টির সেই ভাঙা বাঁশিতে আর সেভাবে সুর বাঁধা হয়নি। সেই দিক দিয়ে বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির এই উজ্জ্বল উপস্থিতি যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ ও নিঃসন্দেহে গবেষণার বিষয়। আসলে নিজেকে বারবার বদলে ভেঙেচুরে দিব্যি রয়ে গিয়েছে লাল পার্টির কর্তৃত্ব। মাওয়ের পর পার্টির রাশ যেমন আলগা হয়নি, তেমনি শুধু দলের একগুঁয়ে নীতিতে আটকে থেকে অপ্রাসঙ্গিক হতে চাননি নেতারাও। মাওয়ের দুই উত্তরসূরি প্রথমে দেং জিয়াও পিং এবং তারপর থেকে আজ পর্যন্ত জি জিনপিং দু’জনেই এই কাজটা করে গিয়েছেন অত্যন্ত সফলভাবে। সমাজতন্ত্র, কমিউনিস্ট আদর্শ সবকিছুকে পিছনে ফেলে তাই শাসক দল ও দেশটা আবাহন করেছে উন্নয়নকে। ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখার কোনও প্রভাব পড়েনি সেখানে। একদিন কমিউনিস্টরা সর্বহারাদের একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল, আর এখন একনায়কতন্ত্র বহাল রয়েছে অন্য মোড়কে। কিন্তু সর্বহারার নেতৃত্ব আর নেই। সবার পাখির চোখ একটাই। উন্নয়ন, প্রসার ও সারা বিশ্বের প্রথম সারির প্রযুক্তিকে আত্মস্থ করে নিজের মতো পাল্টা কিছু নিয়ে আসা। আমেরিকা ও পশ্চিমী দুনিয়াকে মুখের উপর জবাব দেওয়ার এই ঝোঁকই চীনের সবাইকে টপকে যাওয়ার মূল অস্ত্র। সেই সঙ্গে একটা জেদ, দেখিয়ে দাও আমরাও পারি। নিমেষে পশ্চিমের উন্নত প্রযুক্তিকে কপি করে ফেলার আশ্চর্য চীনা ক্ষমতা আজ বারে বারে পৃথিবীকে চমকে দেয়। দ্রুত বদলে যাওয়া বিশ্ব প্রযুক্তির দুনিয়ায় তাই চীনকে ছাড়া কারও আজ গতি নেই। সব বিরোধ দূরে সরিয়ে রেখে দেশটার অসম্ভব উদ্ভাবনী শক্তিকে তাই বারে বারে কুর্নিশ করতেই হয়।
কমিউনিস্ট দেশে ধনতন্ত্রের এই আবাহন থেকেই বেজিংয়ের রাস্তায় এখন মার্সিডিজ বেঞ্জ, বিএমডব্লিউ গাড়ির ছড়াছড়ি। অনেক আগে দেখা যেত সাইকেল আর সাইকেল। সেসবই আজ ব্রাত্য। যে-দিকেই তাকান বিশাল বিশাল চওড়া রাস্তা। ফ্লাইওভার, ব্রিজ। ঝাঁ চকচকে বিমানবন্দর, বুলেট ট্রেন। তাক লাগানো যোগাযোগ ব্যবস্থা। প্রাসাদোপম অট্টালিকা। কী নেই! নিশ্চিতভাবে এর পাশেই গড়ে উঠেছে আকণ্ঠ ভোগী নাইটক্লাবের উদ্দাম সমাজ। সর্বগ্রাসী পুঁজি বৃদ্ধি ও তার উপর নির্ভরতা বৃদ্ধির যা অনিবার্য পরিণতি। সেই সঙ্গে রাস্তাঘাটে ঢালাও বিদেশি পণ্যের ছড়াছড়ি। বড় বড় হোর্ডিংয়ে নতুন আইফোন, বহুমূল্য সুইস ঘড়ি, পশ্চিমী সুগন্ধী। আরও দুশো প্রলোভন। আর্থিক লেনদেন আজ যে সত্যি ঈর্ষণীয় তা বেশ বোঝা যায় দেশি-বিদেশি ব্যাঙ্কের ছড়াছড়ি দেখে। শুধু দেশেই নয়, চীনাদের এই অগ্রগতি আজ অপ্রতিরোধ্য গতিতে চলছে আমেরিকাতেও। বলা হয়, নিউ ইয়র্কের রাস্তায় প্রতি ছ’জনের মধ্যে আড়াই থেকে তিনজনই নাকি চীনা! ওদের একঘরে করবে কে? আর আমরা গলওয়ান হামলার জবাব দিতে একের পর এক চীনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করে সত্যি কি ধাক্কা দিতে পেরেছি? আজও এদেশের যে-কোনও শহরে একটা মোবাইল কিনতে গেলে অ্যাপল আর স্যামসাং বাদ দিয়ে দোকানি আর যে-সব মডেল হাজির করে তার সবই চীনের তৈরি! তাই মোদিজির আত্মনির্ভরতা অর্জনের লড়াইটা একটু দেরিতে শুরু হল নাকি? সতর্ক হওয়া উচিত ছিল আরও আগে। এখন দেওয়ালির আলো থেকে ঘুড়ির মাঞ্জা সর্বত্রই চীনা কথাটা জুড়ে গিয়েছে যে!
অথচ এই দেশটাই একটা দীর্ঘসময় নিজেকে গুটিয়ে রেখেছিল। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় যোগ দেয় মাত্র ২০ বছর আগে, ২০০১ সালে। ততদিন আদানপ্রদানের রাস্তা বন্ধই ছিল। আর আজ বিশ্বের সর্বত্র চীনের পণ্য ছড়িয়ে পড়েছে উল্কার গতিতে। অনেক চেষ্টা করে, ফতোয়া দিয়েও চীনাপণ্যের উপর বহির্বিশ্বের নির্ভরতা ঘুচিয়ে দেওয়া সহজে সম্ভব নয়। ৪৫ বছর আগে মাওয়ের মৃত্যুর পরেই দল ঘোষণা করে দেয়, সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ছুটি। নতুন মন্ত্র হল, শুধু এগিয়ে যাও। হাল ধরেই দেং জিয়াও পিংও একটুও দেরি করেননি। বেছে নেন সেই উন্নয়নের পথই। আর সেই অভীষ্ট উন্নয়ন অর্জন করতে চাই প্রতিযোগিতা। আমেরিকার কাছ থেকে চীনারা একটা জিনিস শিখেছে, প্রতিযোগিতার সার্বভৌমত্ব। চীনারা অত্যন্ত চতুর। আমেরিকার যেসব শিল্প মজুরির ভারে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সেই সব কারখানার মালিকরা চীনে কারখানা তুলে নিয়ে এসে ফের তা চালু করেছিলেন। সবার একটা কথা জানা, এশিয়ার দেশগুলি হচ্ছে সস্তা শ্রমের দেশ। ব্যক্তি মালিকানা স্বীকার করে নেওয়ায় চীনেও বহু উদ্যোক্তা আত্মপ্রকাশ করেন। দেং পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় এমন একটা রকেট গতি সঞ্চার করে দেন যে লাল চীনে একের পর এক কোটি-কোটিপতিদের আত্মপ্রকাশ শুরু হয়। ক্রমে শুধু এশিয়া মহাদেশেই নয়, গোটা দুনিয়ার পরাক্রমশালী এক রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে চীন।
নতুন স্মার্টফোন কেমন হবে, কীভাবে অ্যাপল আর স্যামসাংকে টপকে বাজারে সেরার আসনে বসবে, ক্রমাগত চেষ্টা চলছে সেই লক্ষ্যকে পাখির চোখ করেই। কিন্তু শুধু উন্নয়ন আর আর্থিক প্রগতিই যে শেষ কথা বলে না, তা ধুরন্ধর জি জিনপিংয়ের চীনের অজানা নয়। তাই পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সেনা বাহিনী গড়ে তোলার কাজেও এখন বেজিং অক্লান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পার্টির শতবর্ষের ভাষণেও দেশের মানুষের সঙ্গে গোটা বিশ্বকে সেকথা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন জিনপিং। আর পৃথিবী সমীহ করে বলেই গোটা বিশ্ব কোভিডের আঁতুড়ঘর হিসেবে উহানের ল্যাবরেটরিকে চিহ্নিত করলেও জরিমানা, ভর্ৎসনা তো দূর অস্ত, এখনও মুখের উপর কিছু বলতেই পারেনি কোনও রাষ্ট্র। চুপ করে আছে আমেরিকাও। শুধু চীনের দিকে আঙুল তুলে করোনার একের পর এক ঢেউ পার করা ছাড়া রাশিয়া ও আমেরিকার সামনেও আর কোনও বিকল্প নেই। আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘ম্যান মেড’ বিপর্যয়ের দায়ও এভাবেই ঝেড়ে ফেলেছেন চীনা কর্তারা। কিন্তু চীনের এই অগ্রগতির সঙ্গে একটু অন্ধকারও উঁকি মারছে। আজ থেকে পাঁচবছর আগে জিনপিং রীতিমতো প্রস্তাব পাশ করেই আমৃত্যু নিজেকে চীনের সর্বেসর্বা ঘোষণা করেছেন। সেই জন্যই এখনও ঘোষণা করেননি কোনও উত্তরাধিকারীকেও। তাহলে চীনে কমিউনিস্ট পার্টির এই সাফল্য কি বেজিংয়ে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দিকেই এগচ্ছে? ষোলো আনা ব্যক্তি মালিকানার বুর্জোয়া চীনের জঠরে কমিউনিস্ট আদর্শ কতদিন বেঁচে থাকবে তা ভবিষ্যৎই বলবে।