বিদ্যার্থীরা মাঝে মধ্যে মানসিক উদ্বেগের জন্য শিক্ষায় অমনোযোগী হয়ে পড়বে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে নানা সুযোগ আসবে। ... বিশদ
বাবা কিরীট বিক্রম কিশোর মাণিক্য ত্রিপুরা রাজবংশের ১৮৫তম এবং শেষ রাজা। সেই সিলসিলায় প্রদ্যোত বংশের ১৮৬তম প্রধান। শত শত বছরের জীবন্ত ইতিহাস রয়েছে এই রাজবংশের।
এক সময় খাসিয়া পাহাড় থেকে উত্তর আরাকান পর্যন্ত ছিল তাদের প্রভাব। তিপ্রা জনগোষ্ঠীর সেই স্মৃতির প্রতীক প্রদ্যোত। সেই সূত্রেই তিনি এই জনগোষ্ঠীর সর্বশেষ মহারাজ। তবে এই মহারাজা গতানুগতিক নন, আমলাতান্ত্রিকও নন। ত্রিপুরার প্রান্তিক অঞ্চল পর্যন্ত ট্রাইবালদের সঙ্গে তাঁর যোগসূত্র রয়েছে। বোঝা যায়, পরিবারের সামন্ততান্ত্রিক খোলস ছেড়ে রাজনীতি করা তাঁর বিশেষ লক্ষ্য। শুধু স্মৃতির মাঝে আটকে থাকতে চান না। নিজেকে ‘রাজনীতিবিদ’ও বলতে নারাজ। ‘অ্যাকটিভিস্ট’ বললেই নাকি খুশি হন বেশি।
এহেন প্রদ্যোতকে ২০১৯-এ প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি করেছিলেন রাহুল গান্ধী। এর আগে ছাত্র-রাজনীতি করেছেন তিনি। সাংবাদিকতাও করেছেন। দ্য নর্থইস্ট টুডে নামে তাঁর একটা সংবাদমাধ্যম ছিল। প্রদ্যোতের বাবার আমল থেকে এই পরিবার কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত। প্রাসাদের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আমআদমির সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন তাঁর বাবা-মা। নেমেছিলেন রাজনীতিতে। প্রদ্যোতের বাবা মহারাজ কিরীট বিক্রম এবং মা বিভু কুমারী দেবী, দু’জনেই কংগ্রেস রাজনীতি করেছেন। ১৯৬৭ সালে মহারাজা কিরীট বিক্রম লোকসভা নির্বাচনে হারিয়েছিলেন বামপন্থী নেতা দশরথ দেবকে। এর পর ’৭৭ ও ’৮৯ সালেও কিরীট বিক্রম লোকসভা ভোটে জয়ী হন। প্রদ্যোতের মা মহারানি বিভু কুমারী দেবী ১৯৮৩ এবং ’৮৮-র বিধানসভা নির্বাচনে যথাক্রমে মাতাবাড়ি ও আগরতলা কেন্দ্র থেকে কংগ্রেসের টিকিটে জয়ী হন। আগরতলায় তিনি সিপিএমের মানিক সরকারের বিরুদ্ধে জয়ী হয়েছিলেন মাত্র ৮১ ভোটের ব্যবধানে। প্রদ্যোতের বোন ‘রাজকুমারী’ প্রজ্ঞা গত লোকসভা ভোটেও লড়াই করেছেন কংগ্রেসের টিকিটে। কিন্তু প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি হওয়ার বছরই প্রদ্যোত দলত্যাগ করেন। প্রদ্যোত চান ত্রিপুরার মতো প্রান্তিক অঞ্চলের ক্ষমতায়ন। বিশেষ করে আদিবাসীদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব।
উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলো বাম এবং কংগ্রেসের নিরাপদ এলাকা ছিল বহুকাল। সেটা ভাঙতেই এনআরসি-কার্ড নিয়ে আসে বিজেপি। এসব এলাকার আদিবাসীরা তাতে সহমত প্রকাশ করে। কিন্তু বিজেপি যখন এনআরসির পাশাপাশি নতুন নাগরিকত্ব আইনে হিন্দুদেরও সেইসব অঞ্চলে নাগরিকত্ব দিতে চেয়েছে, তখন এনআরসির বিরোধিতায় নামে স্থানীয় ওই সমর্থকরাই।
কংগ্রেস জাতীয়ভাবে এনআরসির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। এতে প্রদ্যোত দেববর্মার সায় ছিল না। কারণ, তাতে তিপ্রা সমাজে তাঁর অবস্থান বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তিনি নিজেও চান উত্তর-পূর্ব ভারতে এনআরসি হোক। কিন্তু তাতে বেছে বেছে হিন্দুদের গুরুত্ব দেওয়া চলবে না। গত ফেব্রুয়ারিতে ইন্ডিজিনিয়াস প্রোগ্রেসিভ রিজিওনাল অ্যালায়েন্স (টিআইপিআরএ বা তিপ্রা) নামে একটা দল গড়েন প্রদ্যোত। স্থানীয়রা যাকে ‘তিপ্রা মথা’ বলে ডাকে। মথা অর্থ ‘ঐক্য’। তিপ্রা-মথা নামের ব্যঞ্জনা ত্রিপুরার ট্রাইবাল সমাজে ইতিমধ্যে ইতিবাচক আবেদন তুলেছে। লক্ষ্য ত্রিপুরার আদিবাসীদের নিয়ে ‘গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড’ গড়া। যার ভরকেন্দ্র হবে ত্রিপুরার এখনকার স্বশাসিত ‘এডিসি এলাকা’।
প্রদ্যোত কংগ্রেস ছাড়ায় বিজেপি উল্লসিত ছিল। কিন্তু প্রদ্যোত-ঝড়ে প্রথমেই সর্বনাশ হয় তাদের। রাজ্যে ট্রাইবালদের স্বশাসিত যে কাউন্সিল রয়েছে, স্থানীয়ভাবে যাকে বলা হয় ‘এডিসি এলাকা’, তার নির্বাচনে প্রদ্যোতের দল তিপ্রা-মথা ২৮টি আসনের ১৮টিতেই জিতে যায়। ‘ত্রিপুরা ট্রাইবাল এরিয়াস অটোনোমাস ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলে’র ওই নির্বাচনে বিজেপির প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল তিপ্রা-মথা। ত্রিপুরায় এখন বিজেপিই ক্ষমতায়। কিন্তু তিপ্রা-মথার সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি গেরুয়া শিবির। মাত্র ৯টি আসন পেয়েছে। সব আসন মিলিয়ে তারা ১৯ শতাংশ ভোট পেয়েছে। আর তিপ্রা-মথা একাই ৩৭ শতাংশ ভোট। স্বশাসিত ট্রাইবাল কাউন্সিল ত্রিপুরার প্রায় ৬৮ ভাগ ভূমি নিয়ে গঠিত। পরিচয় ভিত্তিক রাজনীতির হাওয়ায় এই পাহাড়ি জনপদ মহারাজা প্রদ্যোতের অধীনে। সেই হাওয়ায় উড়ে গিয়েছে বামেরাও। তবে তিপ্রারা সমগ্র ত্রিপুরার জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ মাত্র। প্রদ্যোতের লক্ষ্য এখন ট্রাইবাল কাউন্সিলের বাইরের তিপ্রাদের দিকে। তাঁর কথায়, ‘আমি প্রত্যেক তিপ্রাকে সঙ্গে চাই’।
তিপ্রা জাতীয়তাবাদের জোয়ার তুলে প্রদ্যোত আসলে বিজেপির ট্রাইবাল মিত্রদের রাজনীতিই ছিনতাই করেছেন। তিপ্রাল্যান্ড দাবিটি এত দিন বিজেপির ভোটসঙ্গী ‘ইন্ডিজিনাস পিপলস ফ্রন্ট অব ত্রিপুরা’ বা আইপিএফটিরই মূল অ্যাজেন্ডা ছিল। ত্রিপুরার পাহাড়ে পাহাড়ে বামেদের নিশ্চিহ্ন করতে বিজেপি আইপিএফটিএফকে দিয়ে সেখানে পৃথক রাজ্যের প্রত্যাশা ছড়ায়। কিন্তু তাতে আগরতলাকেন্দ্রিক বাংলাভাষীদের ভোট হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। তাই পৃথক রাজ্যের ব্যাপারে বিজেপি এখন মুখে কুলুপ আটকেছে। প্রদ্যোত চাইছেন সেই শূন্যতা দ্রুত পূরণ করতে। সম্প্রতি কারাভান ম্যাগাজিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তাঁর মন্তব্য, ‘আমরা তিপ্রাদের উপর সংগঠিত পুরনো অন্যায়ের ভারসাম্য খুঁজছি মাত্র।’ জাতীয় দলগুলোকে ভোট না দিলে এলাকায় উন্নয়ন হয় না— এই প্রশাসনিক সংস্কৃতিরও বিরুদ্ধে তিনি। তাঁর ভাষায়, ‘জাতীয় অর্থ’ নিতে গিয়ে আমরা জাতির পরিচয় ও ভূমি ছেড়ে দিয়েছি। এভাবেই কখন যেন উত্তর-পূর্বাঞ্চল বদলে গিয়েছে।
প্রদ্যোত চারদিকে বার্তা দিচ্ছেন, তিনি ত্রিপুরার রাজনীতিকে দিল্লি ও আগরতলার আধিপত্য মুক্ত করতে চান। তাঁর এই কথায় আকৃষ্ট হচ্ছেন তিপ্রা তরুণরা। যারা ৮০-৯০ ভাগই রাজনৈতিক জগতের বাইরের মানুষ। শুনলে অবাক হবেন, তিপ্রা-মথার হয়ে ট্রাইবাল কাউন্সিলে যে ১৮ জন জিতেছেন, তাঁদের মধ্যে ৪২ বছর বয়সি প্রদ্যোতই বয়োজ্যেষ্ঠ। এই দলের শক্তি ও দুর্বলতা উভয়ই প্রদ্যোত। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনও তথ্য নেই। জঙ্গি ভাবমূর্তিও নেই। উপরন্তু তিনি গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে ট্রাইবালদের স্বশাসনের কথা বলছেন। ফলে প্রদ্যোতকে মোকাবিলায় এই মুহূর্তে বিজেপি কিংবা বামফ্রন্ট—কারও হাতে বিশেষ কোনও অস্ত্র নেই।
বাংলার সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সাতবার অতিথি করেছিল মাণিক্য রাজবংশ। আগরতলায় তাদের প্রাসাদের নামও রবীন্দ্রনাথেরই দেওয়া। মাণিক্যদের রাজ্যে তিপ্রাদের সঙ্গে বাংলাভাষীদের ঐতিহাসিক বন্ধনের সাক্ষী এসব। মাণিক্য বংশের শেষ রাজারাই রাজ্যের ধান আবাদ বাড়াতে বাংলাভাষীদের ত্রিপুরায় আসতে উৎসাহিত করেছিলেন। প্রদ্যোত সচেতনভাবে এখন এই তথ্য আড়াল করেন। রাজনীতির স্বার্থেই।
ছোট রাজ্য হলেও রাজনৈতিক হিংসায় ত্রিপুরার কুখ্যাতি কম নয়। প্রদ্যোত উত্তপ্ত ঐতিহ্যে নতুন ধারার সূত্রপাত ঘটিয়েছেন। তিনি সচরাচর কংগ্রেস, সিপিএম কিংবা বিজেপি— কারও বিরুদ্ধে তেমন কিছু বলেন না। বরং তাঁর দল কী করতে চায় সেদিকেই জোর দেন। তাঁর ভাষায়, এভাবে নতুন ধারার এক ‘পজিটিভ রাজনীতি’র চেষ্টায় আছেন তিনি। এ যেন এক গবেষণাগার। তবে জনজীবনের আর্থসামাজিক সমস্যার মোকাবিলায় প্রদ্যোত ঠিক কী করতে চান, সেসব বিস্তারিত কোনও কর্মসূচি আকারে নেই তাঁর কাছে। তাঁর তিপ্রাল্যান্ডেরও কোনও বাস্তব চেহারা তিনি এখনও স্পষ্ট করেননি। পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতির প্রধান সুবিধা এটাই। জনগণকে বিশেষ আবেগের মোহে সঙ্গে রাখা যায়। বাস্তব কোনও কর্মসূচি না নিলেও চলে। প্রদ্যোত অবশ্য জানিয়ে রেখেছেন, তিপ্রাল্যান্ড পেলে তিনি আর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকবেন না। তাঁর এই ঘোষণাতেও মিশে আছে পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতির গভীর ভাবাবেগ। এখন ট্রাইবাল সমাজে তাঁর আবেদন সর্বগ্রাসী। পুরনো তিপ্রা রাজনীতিবিদরাও ধীরে ধীরে যুক্ত হচ্ছেন নতুন দলে।
ত্রিপুরায় সবার চোখ ২০২৩-এর দিকে। বিধানসভা নির্বাচন। কংগ্রেস, বামফ্রন্ট এবং বিজেপির ত্রিমুখী গণিতের অনেক হিসাব এখন আর মিলছে না প্রদ্যোতের আবির্ভাবে। মহারাজকে ঘিরে ভবিষ্যতে ট্রাইবাল দলগুলোর একটা জোট হবে বলেই অনুমান। এর বিপরীতে থাকবে কংগ্রেস। বর্তমান শাসক দল বিজেপি এবং অতীতের শাসক বামেরাও পৃথক পৃথক অবস্থান থেকে প্রদ্যোতকে মোকাবিলার কৌশল খুঁজছে। পাহাড়ি তল্লাটে নতুন করে নজর বাড়াচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেসও। এই রকম সমীকরণে প্রদ্যোত হয়তো কেন্দ্রের সঙ্গে এবং পাশাপাশি রাজ্যের বাঙালি নেতাদের সঙ্গে দর-কষাকষি করে বিধানসভায় তিপ্রাদের জন্য বাড়তি সংরক্ষণ আদায় করতে চাইবেন। ৬০ সদস্যের বিধানসভায় প্রায় অর্ধেক আসনে ট্রাইবালদের প্রভাব। তার মধ্যে ২০টি তাদের জন্যই সংরক্ষিত। পাহাড়ি দলগুলোকে এক ছাতার নীচে আনতে পারলে প্রদ্যোতের পক্ষে রাজনীতিতে বাংলাভাষী নেতাদের কোণঠাসা করা কঠিন হবে না। তারই প্রস্তুতি হিসেবে ট্রাইবালদের স্বশাসিত কাউন্সিলে ভোটে জিতেও প্রদ্যোত এডিসি প্রধানের পদে বসেননি। সেখানে দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন দলের নেতা পূর্ণচন্দ্র জমাতিয়ার হাতে। বোঝাই যাচ্ছে, মহারাজা দু’বছর পরের অধ্যায় নিয়ে ভাবছেন। তবে ২০২৩-এ ত্রিপুরার বিধানসভা ভোটের আগে আরও ৯ রাজ্যে নির্বাচন। তত দিনে ত্রিপুরায় ভোটের রসায়ন কী দাঁড়াবে, সেই দিকে তাকিয়ে ফুটবল ভক্ত মহারাজ প্রদ্যোত মাণিক্য।