বিদ্যার্থীরা মাঝে মধ্যে মানসিক উদ্বেগের জন্য শিক্ষায় অমনোযোগী হয়ে পড়বে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে নানা সুযোগ আসবে। ... বিশদ
উপরের এই যে কথা গুলো বলা হল তার মধ্যে কোন পয়েন্টটা অসম্ভব এক অবাস্তব চিত্র? একটিও নয়। তাহলে আমরা এর একটাও কেন পেলাম না এখনও? কারণ, রাষ্ট্র এসব নিয়ে ভাবেই না। কেন ভাবে না? কারণ, রাষ্ট্র আমাদের গুরুত্ব দেয় না। আমাদের চাওয়া পাওয়ার অঙ্কটা তারা জানে না। জানার চেষ্টাও করে না। কারণ,এই ক্ষুদ্র মাঝারি জীবনগুলো তারা যাপন করে না। একটা কথা বুঝতে বোধহয় এখনও অনেকের অসুবিধা হচ্ছে। সেটা হল, বর্তমান রাষ্ট্র পরিচালকরা মানুষের নিত্যদিনের সমস্যা, দুর্ভোগ, জীবিকার সঙ্কট, একটু স্বস্তিকর জীবন, আর একটু আয় বৃদ্ধির আশা, সাধারণ মানুষের ছেলেমেয়ের চাকরি, পেশা, চিকিৎসার সুরাহা ইত্যাদি নিয়ে সামান্যতম চিন্তিত নয়। কারণ রাষ্ট্র দেখেছে এসব চরম সঙ্কটে একটা গোটা জীবন কাটিয়ে দিলেও সাধারণত আমরা এসব নিয়ে কোনও আপত্তি করি না, আলাপ আলোচনা করি না, ভোটের ইস্যু হয় না এবং সিরিয়াসলিই নিই না। তাই আজকাল দেখা যাবে সরকারের ঘোষিত কোনও বিরাট প্রকল্প আমাদের কোনও উপকারে লাগছে না। আমাদের জীবনযাপনের বিশেষ উন্নতি ঘটছে না।
আমাদের যে বিষয়গুলিতে উপকার হবে, সেগুলো নিয়ে প্রকৃত অভিজ্ঞতা কী? ঠিক উল্টো। পেট্রপণ্য, রান্নার গ্যাসের দাম বেড়েছে, ব্যাঙ্কে ফিক্সড ডিপোজিট ও স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পে সুদের হার কমেছে, ওষুধের দাম বেড়েছে, খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। হাসপাতালের খরচ বেড়েছে, চাকরির সুযোগ কমে গিয়েছে। অথচ আমাদের ট্যাক্স বেড়েছে। জিএসটি বেড়েছে। আমরা এতবড় একটা কোভিড সংক্রমণ চলার পরও আজও আমরা দেখছি না যে, দিকে দিকে হাসপাতাল, ডায়াগনসিস ক্লিনিক গড়ে উঠছে। এসবের বদলে আমাদের চোখের সামনে, রীতিমতো আস্ফালন করে এবং জয়ঢাকের প্রচার বাজিয়ে কী কী বিষয়ের উপর সবথেকে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে? কোনও দরকার না থাকা সত্ত্বেও আচমকা বাজারে চালু দুটি নোট বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। কাশ্মীর, অযোধ্যা, এনআরসি, সিএএ নিয়ে যুদ্ধ করা হয়েছে জনগণের সঙ্গে। অথচ আমাদের সামান্যতম জীবনে প্রত্যক্ষ উপকার হবে এরকম একটিও কাজ করা হয়নি। রাষ্ট্রকে আমরা ট্যাক্স দেব, বিনিময়ে কিছুই পাব না।
বর্তমান রাষ্ট্র পরিচালক বুঝে গিয়েছে যে, সোশ্যাল মিডিয়া আসার পর থেকে ভারতবর্ষ থেকে একটি জিনিস আশ্চর্যজনকভাবে উধাও হয়ে গিয়েছে। সেটি হল আন্দোলন। ভারতে এখন আর সাংগঠনিকভাবে কোনও শ্রমিক আন্দোলন হয় না। কারণ কোনও রাজনৈতিক দলেরই শক্তিশালী শ্রমিক সংগঠন বা শাখা নেই। ভারতবর্ষে কোনও কৃষক আন্দোলনকে রাজনৈতিক দল সংগঠিত করতে পারে না। যারা করতে পারে, তারা একবার দু’বার একটি দুটি পদযাত্রা করে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি প্রচার করে এবং স্তিমিত হয়ে যায়। এই যে গত বছর থেকে দিল্লির সীমান্তের কৃষকদের আন্দোলন চলছে, সেখানে বৃহত্তর রাজনৈতিক দলগুলির ভূমিকা শূন্য। তারা এই আন্দোলনকে দিশা দেখাতে ব্যর্থ। এমনকী এখন আর রাজনীতির কোনও দল মাথাও ঘামাচ্ছে না যে মাসের পর মাস ধরে কৃষক অবস্থান চলছে। যা কেন্দ্রীয় সরকারকে অনেক সুবিধা করে দিয়েছে। সাধারণ মানুষ ও বিরোধী রাজনীতির এই যে একটি ইস্যুতে বেশিদিন ধরে জড়িয়ে থাকতে না পারার অস্থিরমতি মনোভাব, এটা রাষ্ট্রকে সবথেকে আনন্দ দিয়েছে। রাষ্ট্র বুঝতে পেরেছে, প্রতিটি প্রতিবাদ, ক্ষোভ, বিক্ষোভ সাময়িক। সেটাকে চরম পর্যায়ে নিয়ে যেতে কেউ সক্ষম নয়। এখন আর কোনও আর্থ সামাজিক রাজনৈতিক আন্দোলন করে না কোনও রাজনৈতিক দল। এই বদলে যাওয়া সময়ে সরকার বিরোধী আন্দোলন ঠিক কীভাবে করতে হয়, সেই রূপরেখাটিই স্পষ্ট নয়। কোনও প্রতিবাদ আন্দোলনকেই চরম রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করতে ব্যর্থ হচ্ছে বিরোধী দল। কংগ্রেস এখন একটি দিশাহীন দল। জাতীয় স্তরে এই কাঠামো নিয়ে এই দলের কোনওরকম ঘুরে দাঁড়ানোর আশা প্রায় নেইই।
সুতরাং প্রধান বিরোধী দলটি যে নিষ্কর্মা, সেটা আজকের রাষ্ট্র ও শাসক দল সম্পূর্ণ বুঝে গিয়েছে। সাংবাদিক সম্মেলন ও ট্যুইটার। এই দুটি ছাড়া তাদের অস্তিত্ব নেই। তাই সাধারণ মানুষের নিত্যদিনের সমস্যাকে দূর করার পরিবর্তে আরও বেশি জনগণের উপর চাপ দিতে কোনও সংকোচ করছে না রাষ্ট্র। আজ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর মুখে আমরা শুনিনি পেট্রল ডিজেল, রান্নার গ্যাস, সর্ষের তেল, ডাল, কর্মসংস্থান, ওষুধ, হাসপাতাল, পরিবহণ, ব্যাঙ্ক ডাকঘরের সুদ নিয়ে সামান্য উদ্বেগ প্রকাশ করতে। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মরিয়া কোনও আশ্বাস বা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হল না যে, আমরা এসব নিয়ন্ত্রণ করবোই। প্রতিজ্ঞা করছি। কেন বলছে না সরকার?
কারণ, একটি সূক্ষ্ম কৌশল নিয়েছে আজকের রাষ্ট্র। তারা মানুষের মনের মধ্যে প্রোথিত করে দিতে চাইছে, এই যে নিত্যদিনের জীবনযাপনের দায়, মূল্যবৃদ্ধি, এসব তোমাদের ব্যক্তিগত সমস্যা। একক দায়িত্ব। এর সঙ্গে লড়াই করতে হবে তোমাকে। পারলে টিকবে। নয়তো একটু সামাজিকভাবে নীচে নেমে যাবে। রাষ্ট্র বলতে চাইছে, সরকারের এসব নিয়ে ভাবনার কোনও দায় নেই। আমরা রামমন্দির গড়ে দেব, আমরা অত্যাধুনিক ক্রুজ মিসাইল এনে দেব আর্মিকে, আমরা অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রতিশ্রুতি দেব, আমরা পাকিস্তান ও চীনকে হুমকি হুঁশিয়ারি দেব তোমাদের মধ্যে ন্যাশনালিস্ট মনোভাবকে উস্কে দেওয়ার জন্য। আমরা বলব, এই দেখো কাশ্মীরে আর ৩৭০ নেই, আমরা তোমাদের প্রত্যেকের জাতিধর্মসম্প্রদায়ের আইডেন্টিটির ইগোকে সর্বদা জাগ্রত রাখব, আমরা ডিজিট্যাল ইন্ডিয়ায় ফাইভ জি আনার ঘোষণা করব। এসবকেই একদিন তোমরা সরকারের চরম সাফল্য, দেশের গর্ব, রাষ্ট্রের উত্থান হিসেবে মনে করবে। আমাদের প্রধান চালিকাশক্তি হবে অদৃশ্য এক বিভাগ। যা নেই, কিন্তু আছে। মিনিস্ট্রি অফ প্রোপাগান্ডা! রান্নার গ্যাস, ব্যাঙ্কের সুদ আর চাকরি না পাওয়ার হাহাকারকে ছাপিয়ে একদিন এই তোমরাই সকলে বলে উঠবে, জয়তু রাষ্ট্র!