বিদ্যার্থীরা মাঝে মধ্যে মানসিক উদ্বেগের জন্য শিক্ষায় অমনোযোগী হয়ে পড়বে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে নানা সুযোগ আসবে। ... বিশদ
শুরু হল রাস্তায় নেমে আন্দোলন। ৩ জুলাই চারজন বিধায়ক গ্রেপ্তার হলেন। তাঁদের অন্যতম জ্যোতি বসু। এদিকে মুখ্যমন্ত্রীর আগে থেকেই ৫ জুলাইয়ের টিকিট কাটা ইওরোপে যাওয়ার। এই সুযোগটি পূর্ণ উদ্যমে নিল কমিউনিস্ট নেতারা। অক্টারলোনী মনুমেন্টের নীচে জমায়েত, ট্রামে আগুন লাগানো, ট্রেন আটকে দেওয়া—সবই শুরু হল। হাল ছেড়ে দিয়ে, ভারপ্রাপ্ত মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল চন্দ্র সেন বিধানবাবুকে ফোন করে বললেন, আপনি ফিরে আসুন। আর সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। বিধানবাবু তখন সুইজারল্যান্ড। চোখের অপারেশন না করেই ফিরে এলেন। এসেই একটি কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নিলেন। আগস্ট মাসে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে এল।
১৯৫৮। বিধানসভার প্রশ্নোত্তরকালে বিরোধী দলনেতা জ্যোতি বসু স্পিকারকে প্রশ্ন করলেন, সরকারের আইনমন্ত্রী কোথায়? তাঁকে দেখা যাচ্ছে না কেন? জানা গেল, আইনমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন কিছুদিন আগেই। তাঁর নাম সিদ্ধার্থশংকর রায়। তিনি লম্বা এক চিঠি লিখে মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়ে দিয়েছেন, এই সরকারের সঙ্গে তাঁর নীতি ও আদর্শের নানাবিধ মতান্তর হচ্ছে। তাই তাঁর পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। এই পদত্যাগের কথা মুখ্যমন্ত্রী গোপন করে রেখেছিলেন। তাঁর আশা ছিল বুঝিয়ে সুঝিয়ে সিদ্ধার্থবাবুকে আবার ফেরানো সম্ভব হবে। কিন্তু সেটা হয়নি। বরং বিধানসভায় সিদ্ধার্থবাবু সরকারের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ এনে বিধানবাবুকে বিদ্ধ করলেন। সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়েছিল। যদিও প্রবল গোলযোগে সেই অনাস্থা প্রস্তাব একপ্রকার ভণ্ডুল হয়ে যায়। হট্টগোলে ধ্বনিভোটে জয়ী হয় সরকার। কিন্তু বিরোধীরা বড়সড় ইস্যু পেয়ে গেল। ওটাই লাভ হল তাদের।
দার্জিলিং-এ মন্ত্রিসভার বৈঠক হচ্ছে। ১৯৫৯। খবর পাওয়া গেল যে, হাওড়া কংগ্রেস কমিটি থেকে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে একটি নোট এসেছে। বলা হয়েছে, বাজার থেকে কিন্তু চাল উধাও হয়ে যাচ্ছে। সরকার সতর্ক হোক! খাদ্য সঙ্কটের সেই প্রথম পূর্বাভাস। এরপর চরম আন্দোলনে কলকাতা ও জেলা কেঁপে উঠল। ডাঃ রায়কে সবথেকে বেশি তিনটি সঙ্কট আর বিরোধীদের বিক্ষোভ সামলাতে নাজেহাল হতে হয়েছিল। একাধিক অনাস্থা, খাদ্য সমস্যা এবং উদ্বাস্তুদের আন্দোলন। ড. প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ ও সুরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রজা সোশ্যালিস্ট পার্টি এবং কমিউনিস্টদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ইউসিআরসি, এই দুই সংগঠন প্রায় একে অন্যকে টেক্কা দিয়ে আন্দোলন শুরু করেছিল উদ্বাস্তুদের নিয়ে। ৫০ হাজার উদ্বাস্তু শিবিরের লক্ষ লক্ষ বাসিন্দাকে নিয়ে এই আন্দোলন সংঘটিত করে এই দুই সংগঠন। পাশাপাশি তৈরি হয়েছিল ‘দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটি’। যার অন্যতম নেতা ছিলেন হেমন্তকুমার বসু।
সত্তরের দশকে নকশাল আন্দোলনের সময় মহাজাতি সদনের প্রথম তলে একটি ঘরে একপ্রকার গোপনে থাকতেন দুই যুবক। রান্না করতেন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। আর তাঁর সঙ্গী ছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। পরবর্তীকালে এই দুই যুবক কংগ্রেসের তরুণ প্রজন্মের আইকন হয়ে দাঁড়ান। সত্তরের দশকে শব্দবন্ধটি ছিল, প্রিয়-সুব্রত! তখন রাজনৈতিক আন্দোলন, বিক্ষোভের মাধ্যমে তুমুল জনপ্রিয়তা পান এই জুটি।
১৯৮৪ সালে যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মতো এক হেভিওয়েট নেতাকে পরাস্ত করার পর যে ২৯ বছরের অগ্নিকন্যাটির সংসদীয় যাত্রাপথ শুরু হয়েছিল, সেটি আজও এক বিস্ময়। ভোটের পর ভোটে যেখানে বামফ্রন্ট জয়ী হয়ে চলেছে, সেখানে কীভাবে মাত্র একজনের আহ্বানে ধর্মতলা থেকে চমকাইতলায় লক্ষ মানুষের সমাবেশ হয়েছে গোটা নব্বই দশক ধরে, সেটা প্রায় রাজনৈতিক রূপকথা। একটাই লক্ষ্য ছিল। সিপিএম হটাও। সেই লক্ষ্য থেকে তিনি কোনওদিন বিচ্যুত হননি। পাখির চোখটি কখনও ফোকাস থেকে সরে যায়নি। তার পরিণতি ২০১১। ক্ষমতা থেকে সিপিএমকে সরিয়ে দেওয়া। এবং ২০২১। বিধানসভা থেকে সিপিএমকে সরিয়ে দেওয়া। সবথেকে আশ্চর্য ছিল, তাঁর দল যখন ভোটে জিতছে না, তখনও কিন্তু তিনিই ছিলেন বাংলার সবথেকে আলোচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। এভাবেই কেটেছে ১৯৯০ থেকে ২০১০ সাল। এবং আজও আরও বিস্ময়কর হল, তিনি ১০ বছরের পুরনো মুখ্যমন্ত্রী। অথচ তিনিই রাজ্যে সবথেকে আলোচিত নেত্রী। অর্থাৎ বিরোধী হিসেবে তিনি ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে প্রচার ও চর্চার ভরকেন্দ্র হয়েছিলেন। ক্ষমতাসীন হওয়ার পরও ১০ বছর ধরে একই চিত্র। আধুনিক সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে তাঁকে ঘিরেই হয় মিম, তাঁকে নিয়ে হয় হাসিঠাট্টা, বন্দনা, সমর্থন, সমালোচনা। তাবৎ চর্চার ভরকেন্দ্র তিনিই।
অতীতের এতসব স্মৃতি রোমন্থনের উদ্দেশ্য এটাই যে, বিরোধীদের এতটা দৈন্যদশা স্বাধীনতার পর পশ্চিমবঙ্গে দেখেনি। দুটি ঐতিহাসিক দল শূন্য হয়ে গিয়েছে। আর যারা নতুন শক্তিশালী বিরোধী হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছে, তারা সকলেই সম্পূর্ণ দিশাহীন। এই মুহূর্তে বিরোধী দলগুলির কাছে সবথেকে বড় সঙ্কট হল ইস্যুহীনতা। বিরোধী হিসেবে তাদের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে, সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হবে, সমালোচনা করতে হবে, আক্রমণ করতে হবে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু জনমনে প্রতিষ্ঠা পাবে তাদের আন্দোলন অথবা আক্রমণ, আলোচনা হবে সেসব নিয়ে, এরকম একটিও ইস্যু নেই। হয় নেই অথবা তারা খুঁজে পাচ্ছে না কিংবা চিহ্নিতও করতে ব্যর্থ। বিরোধী দলগুলির বিবৃতি, মন্তব্য, সমালোচনার ভাষা ইত্যাদি দেখেই স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে, তাদের অবস্থাটির এক কথায় প্রকাশ হল, কিংকর্তব্যবিমূঢ়! বিজেপি কতটা আত্মবিশ্বাসহীন হলে রাজ্যপালকে পথে নামতে হয় সরকার বিরোধিতায়!
সারদা, নারদা, সিন্ডিকেট, ভাইপো ইত্যাদি তাবৎ এক্সপেরিমেন্ট জনগণের দরবারে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। আগের থেকেও বেশি আসনে জয়ী হয়েছে তৃণমূল। এমতাবস্থায় এখন বিরোধীদের ঠিক কী করণীয় সেটাই তাদের কাছে সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ। অর্থাৎ ঠিক কোন ইস্যুতে সরকারের সমালোচনা করা যায় অথবা জনমত সংঘটিত করা সম্ভব, এটা তারা ধরতেই পারছে না। এটা ঠিক যে, বাংলার রাজনীতির অতীতে বিরোধী দলগুলির সক্রিয়তা ও সাফল্যের সঙ্গে কোনওরকম তুলনা করা যায় না আজকের পরিস্থিতির। কারণ, যুগ পাল্টেছে, ইস্যু বদলেছে, মানুষের চাওয়া পাওয়ার দাবি ও চাহিদার পরিবর্তন ঘটেছে। সমাজ বদলে গিয়েছে। বদলেছে রাগের চরিত্রও। এখন এমন একটি সময় এসেছে যে, আন্দোলনের নামে বাস ট্রাম জ্বালালে মানুষ মোটেই সমর্থন করবে না। আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে। আজকাল বন্ধ ডাকলেই দেখা যায় যে, সেটা ফ্লপ করেছে। সুতরাং মহাসঙ্কট বিরোধীদের কাছে। বাংলার তিনটি বিরোধী দল সম্পূর্ণ দিশাহারা যে, কী করণীয়? কোন পদক্ষেপ বিশ্বাসযোগ্য হবে? মানুষ কোন ইস্যুতে সরকারের বিরোধিতা চায়? বিরোধীরা বুঝতে পারছে না।
নাকি সরকারের বিরুদ্ধে এখন বিশেষ কোনও ইস্যুতে তীব্র কোনও ক্ষোভ আদতে নেইই? এর দুটি কারণ হতে পারে। প্রথমত, যে সমস্যাগুলি আছে সেগুলি ধীরে ধীরে এই সরকার মেটানোর আন্তরিক চেষ্টা করছে বলে মানুষের মধ্যে একটা আস্থা তৈরি হয়েছে। আবার দ্বিতীয় কারণ হল, সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ থাকলেও, বিরোধীরা এই সরকার অথবা মুখ্যমন্ত্রীর থেকে বেশি ভালো কিছু করতে পারে, এই বিশ্বাস মানুষের মধ্যে আসেনি। বিরোধীরা লাগাতার প্রয়াস করে চলেছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কতটা খারাপ সেটা প্রমাণ করতে। সেটা রাজনীতিতে প্রত্যাশিত। কিন্তু সেই কৌশল লাগাতার ব্যর্থ হয়েছে। শুধুই একবগ্গা মমতা বিরোধিতা মানুষ পছন্দই করেনি। তাহলে? এখন পরিবর্তিত স্ট্র্যাটেজি কী হওয়া উচিত? ওটাই তো সবথেকে কঠিন। এবার বুদ্ধি, রাজনীতি, সমাজবোধ ও মানুষকে বোঝার পরীক্ষা এসেছে বিরোধীদের কাছে। শুধু রাজনীতি নয়। জীবনের ক্ষেত্রেও, অন্যকে সমালোচনা করা সহজ। নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার অনুশীলন কঠিন। বিরোধীরা সহজ পথ নিয়েছে।
এসব ছাপিয়ে সর্বোচ্চ প্রশ্নটি কী? সোশ্যাল মিডিয়ার এই প্রচার বিস্ফোরণ, অসংখ্য মিডিয়ার উপস্থিতি, মুখ দেখানো, কথা শোনানোর এত সুযোগ সত্ত্বেও একজন জ্যোতিবাবু, একটি প্রিয়-সুব্রত জুটি, একজনও সুভাষ চক্রবর্তী, কোনও নতুন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন উঠে আসছেন না বাংলার বিরোধী রাজনীতির আকাশে? এর থেকে বড় ব্যর্থতা আর আছে নাকি?