মানতেই হবে, ইস্যু তৈরিতে বিজেপির ধারেকাছে কেউ নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ধরাশায়ী করার একের পর এক ইস্যু ফেল করলেও হাল ছাড়ছে না। কারণ বিজেপি জানে, আক্রমণই আত্মরক্ষার শ্রেষ্ঠ উপায়। তাই থলিতে বিষ না থাকলেও ছোবল মারার প্রয়াস রয়েছে অব্যাহত। এবার ইস্যু ‘ভোট পরবর্তী সন্ত্রাস’। তবে, তিলকে তাল করা কাকে বলে, তা দেখিয়ে দিচ্ছেন ‘ট্যুইটারবাবু’। হইচই দেখে মনে হচ্ছে, দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গেই প্রথম রাজনৈতিক সংঘর্ষ ও ঘরছাড়ার ঘটনা ঘটল। অথচ এই বিজেপি ত্রিপুরায় সিপিএম কর্মীদের খুন করে, পার্টি অফিস পুড়িয়ে, বুলডোজার দিয়ে লেনিনের মূর্তি গুঁড়িয়ে দেশবাসীকে চমকে দিয়েছিল। চমকে ধমকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পঞ্চায়েত দখলের বিশ্ব রেকর্ড তাদেরই কব্জায়। লোকসভা ভোটে ১৮টি আসন পেতেই বঙ্গে বিজেপি হাতে মাথা কাটতে নেমে পড়েছিল। পিটিয়ে ঘরছাড়া করা থেকে জরিমানা আদায়, বাদ যায়নি কিছুই। সেই বিজেপির গলায় সন্ত্রাসের অভিযোগ! একেই বলে, ‘চোরের মায়ের বড় গলা।’
পবিত্র গিরি। পেশায় প্রাথমিক শিক্ষক। বাড়ি, পূর্ব মেদিনীপুর জেলার ভগবানপুরে। অর্জুননগর পঞ্চায়েতের এই তৃণমূল সদস্য বিজেপির তাণ্ডবে ঘরছাড়া হয়েছিলেন। তিনি একা নন, পঞ্চায়েতের আট সদস্য, ১৩ জন বুথ সভাপতি সহ সংখ্যাটা ৩৭। তারিখটা ছিল ৩ ডিসেম্বর। তখনও রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নির্বাচন কমিশনের হাতে যায়নি। বহু চেষ্টা করেও তাঁরা বাড়ি ফিরতে পারেননি। পাননি পুলিসের সহযোগিতা। কারণ ‘ইসবার দোশো পার’-এর স্লোগানে দিশেহারা পুলিস তখন বিজেপির সঙ্গে সম্পর্কের সেতুবন্ধনে ব্যস্ত। অর্জুননগরের বিজেপি নেতাদের হাতে জরিমানা আদায়ের লম্বা লিস্ট। 
যিনি যত বড় তৃণমূল নেতা, তাঁর জরিমানা তত বেশি। পবিত্রবাবুর জন্য তাঁর বাবাকে জরিমানা দিতে হয়েছিল দেড় লক্ষ টাকা। 
পবিত্রবাবু বাড়ি ফিরেছেন। ফিরে পেয়েছেন জরিমানার টাকাও। গ্রামের ছবিটা একেবারে উল্টে গিয়েছে। একদিন গেরুয়া শিবিরের যে নেতাদের হাতে ছিল জরিমানা আদায়ের তালিকা, এখন তাঁদের পকেটে ঘরে ফেরানোর দরখাস্ত। কারণ ২ মে’র পর তাঁরা ‘ঘরছাড়া’।
শঙ্কর ভুঁইয়া। ইটভাটা শ্রমিক। বাড়ি, নন্দীগ্রামের জালপাই তৃতীয়খণ্ড। ভোটের আগের দিন বিজেপি শাসিয়ে ছিল, ভোট দিতে যাওয়া চলবে না। কারণ তাদের চোখে, শঙ্কর ‘সন্দেহভাজন’। শঙ্কর শোনেননি সেকথা। অন্যদের সঙ্গে তিনিও দাঁড়িয়েছিলেন ভোটের লাইনে। তাঁর সেই ‘বেয়াদপি’ সহ্য হয়নি গেরুয়া বাহিনীর। পরের দিনই তাঁর বাড়িতে চালানো হয়েছিল হামলা। তারপর আর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে বাড়িতে রাখার সাহস পাননি শঙ্কর। শ্বশুরবাড়ি পালিয়ে ছিলেন। নির্বাচনের ফল বেরনোর আগে শঙ্কিত শঙ্কর বলেছিলেন, ‘তৃণমূল জিতলে বাড়ি ফিরব। তা না হলে হয়তো বাকি জীবনটা বাইরেই কেটে যাবে।’ শঙ্কর বাড়ি ফিরেছেন।
পবিত্রবাবু রাজনীতির মানুষ হলেও শঙ্করের কোনও ‘পলিটিক্যাল আইডেনটিটি’ ছিল না। সাধারণ ইটভাটার শ্রমিক হয়েই হয়তো বাকি জীবনটা কেটে যেত। কিন্তু সেটা আর হল না। শঙ্কর বলেন, ‘আমি কোনও দিন রাজনীতি করিনি। বিজেপির বারণ শুনেই মাথায় ভোট দেওয়ার জেদ চেপেছিল। ওদের কথা না শোনায় বাড়ি ভাঙচুর করল। বিজেপিই আমাদের তৃণমূল বানিয়ে দিল।’ হয়তো এভাবেই এরাজ্যে রাজনৈতিক দলগুলি তাদের নিজেদের অজান্তেই ‘প্রতিপক্ষ’ তৈরি করে। কথা না শোনা মানেই সে বিরোধী, এই ভাবনা মারাত্মক ক্ষতিকর। 
বঙ্গ রাজনীতিতে মারামারি, খুনোখুনি, ঘরছাড়া করার শিকড় অনেক গভীরে বিস্তৃত। কেউ বলেন, রাজ্যের মানুষ অত্যধিক রাজনৈতিক সচেতন। তাই অন্যায় করলেই হয় প্রতিবাদ। তারই পরিণতি সংঘর্ষ। আবার কেউ বলেন, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি হল ‘করে খাওয়ার’ জায়গা। তাই ক্ষমতা দখলের এতো নেশা। কারণ যাই হোক না কেন, অনেকের মতে, যুক্তফ্রন্টের আমল থেকেই রক্তাক্ত হতে শুরু করেছিল বঙ্গের রাজনীতি। বারবার সরকারের পতনে বেড়েছিল অস্থিরতা। মানুষ ভেবেছিল, নৈরাজ্য, অশান্তি থেকে মুক্তির একটাই পথ, স্থায়ী সরকার। কংগ্রেসের সরকার স্থায়ী হয়েছিল। কিন্তু, শান্তি ফেরেনি।
রাজ্যের মানুষকে ’৭২ থেকে ’৭৭ সালের কংগ্রেসি সন্ত্রাসের গল্প শুনিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল সিপিএম। শাসকের আসন মজবুত করতে চালু করেছিল পঞ্চায়েতিরাজ। বামশিবিরে দুর্নীতির অনুপ্রবেশ ঘটেছিল সেই পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার হাত ধরেই। পঞ্চায়েতবাবুদের সীমাহীন পক্ষপাতিত্ব ভূমি সংস্কারের মতো মহান উদ্যোগকেও করেছিল কালিমালিপ্ত। বেছে বেছে বিরোধীদের জমিতে ঝান্ডা পুঁতে কায়েম করেছিল ‘লাল সন্ত্রাস’। তার প্রতিবাদ করলেই পিটিয়ে ঘরছাড়া। তারপর মোটা অঙ্কের জরিমানা দিয়ে গ্রামে ফেরা। থানা পুলিস করলেই হাতের সঙ্গে ভাতে মারার ব্যবস্থা। ‘খেতমজুর বয়কট’-এর ফতোয়া। গ্রামাঞ্চলে বিরোধীদের শিরদাঁড়া গুড়িয়ে দেওয়ার এটাই ছিল সিপিএমের মোক্ষম অস্ত্র। তবে, ‘ঘরছাড়া’ হওয়ার ইতিহাস তৈরি হয়েছিল কেশপুর-গড়বেতা পর্বে। রাজশক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সেই শুরু। সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ইতিহাস গড়েছিল গড়বেতা। তারপর বিদ্রোহের সেই আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল কেশপুর, পিংলা, জয়পুর, কোতুলপুর, গোঘাট, আরামবাগ, খানাকুলের বিস্তীর্ণ এলাকায়। 
তবে সে লড়াই বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। পুলিস আর জনযুদ্ধের সাহায্যে দু’বছরের মধ্যেই এলাকার দখল নিয়েছিল সিপিএম। বিরোধীরা কাতারে কাতারে ঘর ছেড়েছিল। মাসের পর মাস কেটেছিল ত্রাণশিবিরে। চাষবাস বন্ধ। খড়ের অভাবে বিক্রি করে দিতে হয়েছে ঘরের দুধেল গাই। যাঁদের দুয়ারে ধানের বস্তার লাট লেগে থাকত, একমুঠো ভাতের জন্য তাঁদের কেউ হলেন রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে, কেউ ফেরিওয়ালা। বদলে গেল পেশা।
নির্বাচনোত্তর ‘তৃণমূলের সন্ত্রাস’ ইস্যুতে বিজেপির সুরে কথা বলছেন সিপিএম নেতারাও। অথচ বাম জমানায় প্রতিটি নির্বাচনের আগে ও পরে বিরোধীদের ঘরছাড়া করাটা ছিল রুটিন ব্যাপারে। তবে, তা নিয়ে হইচই পছন্দ ছিল না সিপিএমের। ২০১১ সালের ৩১ জানুয়ারির ঘটনায় তা স্পষ্ট। 
রাজ্যে তখন পরিবর্তনের হাওয়া উঠে গিয়েছে। সিপিএমও ক্ষমতায় টিকে থাকতে মরিয়া। দিকে দিকে তৈরি হচ্ছে হার্মাদ ক্যাম্প। হার্মাদদের অত্যাচারে ঘরছাড়া বহু তৃণমূল কর্মী। তাঁদের অনেকেই মেদিনীপুর শহরের ‘রাজীব গান্ধী পুর নিলয়মে’ আশ্রয় নিয়েছেন। সেই ঘরছাড়াদের ‘বিষ দাঁত’ উপড়ে ফেলতে লাঠিচার্জ করে ত্রাণ শিবির ভেঙে 
দিল পুলিস। প্রতিবাদের ঝড় বয়ে গিয়েছিল। 
সেই রাতেই মেদিনীপুর পৌঁছেছিলেন মমতা। বিরোধীদের প্রতি সিপিএমের সহনশীলতা কত মারাত্মক ছিল, তা এই ঘটনাতেই স্পষ্ট। নেতাইয়ের ঘটনা আর নাই বা বললাম!
এখানে একটা কথা খুব স্পষ্ট করে বলা দরকার, পুলিস এবং তৃণমূল নেতারা বহু বিজেপি কর্মীকে ঘরে ফেরালেও এখনও অনেকে ‘ঘরছাড়া’ রয়েছেন। নির্বাচনোত্তর রাজনৈতিক সংঘর্ষের ঘটনার তুলনায় ঘরছাড়ার সংখ্যা অনেকটাই বেশি। কিন্তু এর কারণ কী? প্রথমত, দিল্লির এবং রাজ্য বিজেপির কিছু নেতার আস্ফালনে তাঁদের কর্মী সমর্থকরা ভেবেছিলেন, মমতা-সরকারের পতন নিশ্চিত। 
তাই দিকে দিকে তৃণমূল নেতা কর্মীদের ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকিও দিয়েছিলেন। নির্বাচনের ফল উল্টো হতেই তাঁরা বুঝে যান, নেতাদের কথায় দম খেয়ে মারাত্মক ভুল করেছেন! তাঁরা কাউন্টিং হল থেকে বাড়ি ফেরার সাহস পাননি।
দ্বিতীয়ত, লোকসভা ভোটে বিজেপি ১৮টি আসন পাওয়ার পর বহু জায়গায় তৃণমূলের নেতারা কুঁকড়ে গিয়েছিলেন। সেই সুযোগে বিজেপির ভুঁইফোড় নেতারা মোটা টাকা জরিমানা আদায় করেছিল। পঞ্চায়েতের পদাধিকারী থেকে শুরু করে ১০০ দিনের সুপার ভাইজার, কাউকে ছাড়েনি। সেই টাকা সুদে আসলে তৃণমূল উসুল করবে, এই আশঙ্কায় অনেকেই এলাকায় ফিরতে চাইছেন না। এমনকী, পুলিস নিরাপত্তা দিতে চাইলেও বাইরে থাকাই ভালো মনে করছেন। পূর্ব বর্ধমান জেলার প্রশাসনকে দেওয়া বিজেপির ঘরছাড়াদের তালিকা বেশ লম্বা। তাঁদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, বেশিরভাগই আতঙ্কে ঘর ছেড়েছিলেন। কারণ রাজ্যে ক্ষমতা নিশ্চিত বুঝে অনেকেই নির্বাচনে ‘ডু অর ডাই’ পলিসি নিয়েছিলেন। এখন তাঁদের আফশোস,‘নেতাদের কথায় দম খেয়ে মস্ত ভুল করেছি।’ 
অতীতের দৃষ্টান্ত তুলে কোনও খারাপ ঘটনাকে সমর্থন করা শুধু অন্যায় নয়, অপরাধও। তাই বাম জমানার ‘ঘরছাড়া’র ট্র্যাডিশন তৃণমূলের রাজত্বেও চলবে, এমনটা বলার কোনও জায়গা নেই। বহু ক্ষেত্রেই ঘরছাড়া করার পিছনে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব কাজ করে। অনেকের কাছে এটা টাকা কামানোর রাস্তা। এই জঘন্য রাজনীতির অবসান দরকার। পরিবারের আপনজন থেকে দূরে থাকার যন্ত্রণা একমাত্র ঘরছাড়ারাই জানেন। পবিত্র গিরির কথায় ফুটে উঠেছে সেই যন্ত্রণার অভিব্যক্তি, ‘পাঁচ মাস বাইরে ছিলাম। ঘরছাড়াদের যন্ত্রণা বুঝেছি। সেই উপলব্ধি থেকে বলছি, বন্ধ হোক ঘরছাড়া করার রাজনীতি।’