বিদ্যার্থীরা মাঝে মধ্যে মানসিক উদ্বেগের জন্য শিক্ষায় অমনোযোগী হয়ে পড়বে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে নানা সুযোগ আসবে। ... বিশদ
সেও একটা সময় ছিল... সদ্য জন্ম নেওয়া গণতন্ত্র... হামাগুড়ি দেওয়া অর্থনীতি... মানুষ এগিয়ে না এলে নিজের পায়ে তাকে দাঁড় করানো যেত না। জওহরলাল নেহরু তাই শামিল হয়েছিলেন বিপ্লবে... মানুষ যাতে সরকারি প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখে। যার যেমন সামর্থ্য... সেই টাকা কাজে লাগবে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায়। ভারতের পরিকাঠামো উন্নয়নে।
এও একটা সময়... ভাবগতিক বলছে, স্বল্প সঞ্চয় যেন ভারত সরকারের গলার কাঁটা হয়ে বসে গিয়েছে। যেভাবে হোক উপড়ে ফেলতেই হবে। তাই সুদের হার কমছে। আগে হিসেব ছিল বছরের। মোদি জমানায় ঠিক হয়েছে, তিন মাস অন্তর স্বল্প সঞ্চয়ের সুদের হার নির্ধারণ হবে। এ যেন টাইম বোমা... তিন মাসের মেয়াদ যত ফুরিয়ে আসে, ততই ধুকপুকুনি বাড়তে থাকে মধ্যবিত্তের। এবার কি তাহলে রেট অব ইন্টারেস্ট আরও কমবে? চাটুজ্জে মশাইয়ের বয়স প্রায় ৭৫। সুদের হিসেব নিয়েই আছেন। বলছিলেন, ‘এই সেদিনও তো এমআইএসে ৬০ হাজার টাকা রাখলে মাসে ৪০০ টাকা সুদ পাওয়া যেত। আর এখন! ৩৩০ টাকা। চালের দাম কি কমেছে? সর্ষের তেল? মুসুর ডাল? সবই তো লাফিয়ে বেড়েছে। তাহলে মান্থলি ইনকাম স্কিমের সুদ কমবে কেন?’
চাটুজ্জে মশাইয়ের বাতের সমস্যা... হাঁটুতে। উঠলে বসতে পারেন না। বসলে ওঠা দায়। সংসারে স্ত্রী ছাড়া কেউ নেই। চাকরি থেকে অবসরকালে যা পিএফ-গ্র্যাচুইটি পেয়েছিলেন, সবটাই সিনিয়র সিটিজেনস সেভিংস স্কিম, আর এমআইএসে ভাগাভাগি করে রেখেছেন। তিন কুলে কেউ নেই। আছে বলতে পাড়ার প্রকাশ। মোবাইল রিচার্জের দোকান। ওকেই ম্যানেজ করে রেখেছেন। তিন মাস অন্তর ক্যালেন্ডারের ২-৩ তারিখ সে আসে। উইথড্রয়াল স্লিপে চাটুজ্জে মশাই লিখে দেন... আর প্রকাশ পোস্ট অফিসে গিয়ে টাকা তুলে আনে। সে চাটুজ্জে মশাইয়ের একমাত্র ‘মেসেঞ্জার’। এবার নরেন্দ্র মোদি সরকার সেই পায়েও কুড়ুল মেরেছে। ডাকঘরে টাকা তোলার সময় ‘মেসেঞ্জার’ আর চলবে না। তাহলে উপায়? নিজেকে যেতে হবে। লাইনে দাঁড়াতে হবে। টাকা থাকলে তুলতে হবে এবং তারপর অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়তে হবে। বিকল্প? চেকবই তুলুন। তার জন্য আলাদা টাকা দিন। খাজনা যা, তার তুলনায় বাজনা বেশি বাজান। এটাই গরিবের ভবিতব্য। এটা অর্থনীতি নয়... রাজনীতি।
চাটুজ্জে মশাই তো একা নন! এমন বহু প্রবীণ নাগরিক, প্রতিবন্ধী মানুষ রয়েছেন... যাঁদের পক্ষে নিয়মিত ডাকঘরে যাওয়া এবং লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা তোলাটা কার্যত অসম্ভব। সেই তথ্য কি মোদি সরকারের কাছে নেই? এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কোন রাজ্যে কত সিনিয়র সিটিজেনস সেভিংসের অ্যাকাউন্ট আছে, সেই তথ্য সরকারের হাতে রয়েছে। সেই গ্রাহকদের কথা মাথায় রাখা কি সরকারি কর্তব্য নয়? বোধহয় না। সরকারের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতার পরিধি সামাল দেওয়া। ভোটের অঙ্ক কষা। তাই অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের ‘ওভারসাইট’ হয়। তাঁর নজর এড়িয়েই নাকি স্বল্প সঞ্চয়ে সুদ কাটছাঁটের বিজ্ঞপ্তি জারি হয়ে যায়। ব্যাঙ্কের বেসরকারিকরণের তালিকা তৈরি হয়, লাইন লাগায় বিমা সংস্থাও। টাকা চাই। সাধারণ মানুষকে, তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সুরক্ষাকে খাদে ঠেলে দিয়ে... এটাই সরকারি কর্তব্য। আর এ আমরা মানতে শিখেও গিয়েছি। পেট্রল-ডিজেলের দাম আকাশ ছুঁলেও আমরা শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলছি। তার প্রভাব, তার প্রতিবাদ কোথাও নেই। বিরোধীরা আছেন বটে... কিন্তু ভার্চুয়ালি। পেট্রলের দাম ৭ পয়সা বৃদ্ধির জন্য ১৯৭৩ সালে জনসঙ্ঘের এক নেতা গোরুর গাড়ি চেপে সংসদে পৌঁছে গিয়েছিলেন। সেই নেতার নাম ছিল অটলবিহারী বাজপেয়ি। আর তাঁরই উত্তরসূরির আমলে ১০০ টাকা পেট্রল? বাংলায় বিজেপির নেতাদের মুখে এ নিয়ে কোনও কথাবার্তা নেই! তাঁরা ভ্যাকসিন-ট্যাকসিন নিয়ে রাস্তায় মিছিল করতে বেশি আগ্রহী... করোনা বিধির মধ্যেও। অথচ, আপনাদেরই প্রধানমন্ত্রী বলছেন, ‘দূরত্ব বজায় রাখুন।’
বড্ড সুবিধাবাদী রাজনীতি মশাই আপনাদের। শুধু মানুষের সুবিধাটুকুই চোখে পড়ে না। তেল থেকে সুদ... সর্বত্র চোখে ঠুলি, মুখে কুলুপ। আম জনতা আপনাদের জমানায় সুরাহা কিছুই পায়নি... বরং নানা তুঘলকি সিদ্ধান্তে জনজীবনের ন্যূনতম প্রয়োজনগুলোও আপনারা ঘেঁটে দিয়েছেন, দিচ্ছেন। নিশ্চিত থাকুন... ভবিষ্যতে আরও দেবেন।
কংগ্রেসের মতো জাতীয় বিরোধীরা তারপরও ভার্চুয়ালি কয়েকটা দুষ্টু-মিষ্টি কথা বলে আরাম করতে চলে যাবে। দক্ষিণের আঞ্চলিক দলগুলি হিসেব কষবে, আমরা কী পেলাম আগে দেখি, তারপর প্রতিবাদের ব্যাপারে ভাবা যাবে। শিবসেনা বলবে, মোদি সরকার তথা বিজেপির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক তো ইন্ডিয়া-পাকিস্তানের মতো নয়! বরং আমির খান-কিরণ রাওয়ের মতো।
আসলে আপনারা সবাই চলেছেন নিজ নিজ ধান্দায়। আখের গোছানোর খেলায় মেতেছে রাজনীতির দরবার। আর এই আস্ফালনে হারিয়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের হাহাকার। দুর্নীতি, কেলেঙ্কারির একের পর এক পর্দা ফাঁস হচ্ছে। আমরা দেখছি, তারপর মেনে নিচ্ছি। বিকল্প কী? মোদি সরকার বারবার প্রমাণ করছে, টাকায় টাকা আসে। তাই রাফাল নামক যুদ্ধবিমান কিনতে পুরনো চুক্তি বাতিল হচ্ছে। সেই চুক্তিতে ১২৬টি বিমান ছিল... যার মধ্যে ১৮টি ওয়ার রেডি। সেই চুক্তিতে হ্যাল ছিল। এখন আর সে সব নেই। এই চুক্তিতে ১২৬টি বিমান নেমে এসেছে ৩৬টিতে। এখন ৫৯ হাজার কোটি টাকার ডিল... হ্যালের বদলে আছে রিলায়েন্স। আর রয়েছে প্রায় ৬ লক্ষ ইউরো ঘুষের অভিযোগ। প্রস্তুতকারক সংস্থা ফ্রান্সের। আর ফরাসিরাই ভারতের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে। এই পদক্ষেপ ভারতের জন্য লজ্জার নয়? আন্তর্জাতিক মহলে এভাবে দেশের মাথা হেঁট করার দায় নরেন্দ্র মোদি কেন নেবেন না? তাঁর বোধহয় এদিকেও নজর নেই। নতুন নতুন মিসঅ্যাডভেঞ্চার খুঁজে বের করার তাগিদে ছুটে চলেছে তাঁর সরকার। ফের একবার ঘোষণা হচ্ছে ঋণনির্ভর প্যাকেজের। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এই ঋণের একটা বড় অংশ শোধ হবে না। ফলে দু’-তিন বছর পর ব্যাঙ্কের অনাদায়ী আমানতের পরিমাণ ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে। বাস্তবের মাটিতে দাঁড়ালে একটা প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবে আসে... ওই ঋণের টাকা আম জনতার একটা বড় অংশ আদৌ কি পাবে? নাকি নীরব মোদি, মেহুল চোকসি, বিজয় মালিয়াদের সংখ্যা আগামী তিন বছরে বাড়বে উল্লেখযোগ্যভাবে? সময় এর উত্তর দেবে। ততদিনে কিন্তু বিজেপির মেয়াদ শেষের পথে! ভাবগতিক দেখে একবারও কি মনে হচ্ছে, বিজেপি ফের লোকসভা ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসতে চায়? উত্তর হল হ্যাঁ, চায়। কিন্তু সরকার বা প্রশাসন চালানোর মতো যোগ্যতাই তাদের নেই। এদেশে এখনও প্রায় ৩৬ কোটি মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে। গ্রামীণ ভারতে একজনের দৈনিক আয় ৩২ টাকা হলেই তাঁকে আর গরিব ধরা হয় না। কিন্তু সরকার বাহাদুর একবারও ভেবে দেখেছেন, ৩২ টাকায় কী হয়? পেটের কোন কোণাটা ভরে?
সে খেয়াল আপনাদের নেই। একজন মধ্যবিত্ত কিন্তু তাঁর কষ্টার্জিত সঞ্চয় রাখার আগে এখনও হিসেব করেন... দেখেন, স্টেট ব্যাঙ্কে ১ লক্ষ টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করলে ১ লক্ষ ৫ হাজার টাকার একটু কম পাব। আর সেটাই পোস্ট অফিসে রাখলে ৬২৩ টাকার মতো বেশি। তাঁরা ভাবেন, এসবিআইয়ের সেভিংস অ্যাকাউন্টে সুদ পাওয়া যায় ২.৭০ শতাংশ। আর পোস্ট অফিসে ৪ শতাংশ। তাহলে নিশ্চিতভাবে ডাকঘরে সঞ্চয় এখনও একটু বেশি ভালো। সেই দরজাও আপনারা বন্ধ করে দিচ্ছেন... ধীরে ধীরে। এর শেষ কোথায়? এটাই এখন কোটি টাকার প্রশ্ন। কংগ্রেস মুক্ত ভারত ছিল আপনাদের স্লোগান। এখন মনে হচ্ছে, সেই স্লোগানে নিঃশব্দে আরও কিছু যোগ হয়ে গিয়েছে... আম আদমি মুক্ত ভারত... প্রতিবাদ মুক্ত ভারত।