বিদ্যার্থীরা মাঝে মধ্যে মানসিক উদ্বেগের জন্য শিক্ষায় অমনোযোগী হয়ে পড়বে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে নানা সুযোগ আসবে। ... বিশদ
রাজনীতিতে অঙ্ক একটা বড় ফ্যাক্টর। সেই অঙ্ক মিলতে পারে, আবার নাও পারে। তবুও অঙ্ক কষা চলতেই থাকে। মোদিজির মন্ত্রিসভা রদবদলের পিছনেও কিছু অঙ্ক রয়েছে। মন্ত্রিসভার সদস্য সংখ্যা এক ধাক্কায় ৫৩ থেকে বাড়িয়ে ৭৮ করে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, গদি খোয়ানোর ভূত তাঁর ঘাড়ে বেশ শক্তপোক্তভাবেই চেপে বসেছে। অথচ এই মোদিই বলেছিলেন,‘মিনিমাম গভর্নমেন্ট, ম্যাক্সিমাম গভর্নন্যান্স।’
রোগীকে সুস্থ করার জন্য অভিজ্ঞ চিকিৎসকের দু’চারটে ওষুধই যথেষ্ট। আর হাতুড়েরা লেখেন গুচ্ছের ওষুধ। মোদিজিরও সেই ‘হাতুড়ের হাল’ হয়েছে। দলের রোগ সারাতে মন্ত্রীর সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছেন। কিন্তু, বেশি ওষুধের মতো বড় মন্ত্রিসভার ‘পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া’ কখনও কখনও মারাত্মক হয়। অনেকে বলছেন, মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণের দিনেই বিজেপি সাংসদ সৌমিত্র খাঁয়ের নজিরবিহীন আক্রমণ সেই ‘সাইড এফেক্টে’র লক্ষণ।
গেরুয়া রাজনীতিতে বিভাজন এবং জাতপাত সবসময় বিশেষ গুরুত্ব পায়। এরাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনেও বিভাজনের রাজনীতি করে ও ‘দলিত তাস’ খেলে বাজিমাত করতে চেয়েছিল বিজেপি। কিন্তু, বাংলার মানুষ সেই ফাঁদে পা দেয়নি। এবারও বাংলা থেকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নির্বাচনের সময় নেতাদের মাথায় মতুয়া, রাজবংশী ও আদিবাসী ‘ফ্যাক্টর’ কাজ করেছে। তবে, সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে দলের ভাঙন প্রতিরোধ। নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহ খুব ভালো করেই জানেন, এরাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের মুখে তৃণমূলের ভাঙন তীব্র হলেও চিড় ধরানোর আসল কাজটা করেছিলেন মুকুল রায়। স্বীকৃতিস্বরূপ লোকসভা নির্বাচনে তাঁর ঘনিষ্ঠ বেশিরভাগ নেতা টিকিট পেয়েছিলেন। অনেকে জয়ীও হয়েছিলেন। মুকুলবাবুই তাঁদের ‘রাজনৈতিক মেন্টর’। তিনি তৃণমূলে যেতেই বিজেপির নেতারা সিঁদুরে মেঘ দেখার পাশাপাশি আগুনের আঁচও পাচ্ছিলেন। তাই বাংলায় ‘হাফ মন্ত্রী’র সংখ্যা দ্বিগুণ করে দিয়েছেন।
শান্তনু ঠাকুরকে মন্ত্রী করার পিছনে মতুয়া সমাজকে সন্তুষ্ট করার কথা বলা হলেও আসল কারণটি অন্য। তাঁকে বিজেপিতে ধরে রাখা। শান্তনুবাবু ঠাকুর পরিবারের সদস্য হলেও তিনি মতুয়াদের মধ্যে ভীষণ জনপ্রিয়, এমনটা এলাকার লোকজন মানতে চান না। তাঁদের দাবি, ‘বড়মা’ বীণাপাণিদেবী মারা যাওয়ার পর মতুয়াদের উপর ঠাকুরবাড়ির নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই খর্ব হয়েছে। উল্টে ঠাকুরবাড়ির নাম ‘রাজনৈতিক স্বার্থে’ ব্যবহার করায় মতুয়াদের একটা বড় অংশ প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। তা সত্ত্বেও ভোটে বিজেপি জয়লাভ করছে। তারজন্য শাসক দলের একাংশের দুর্নীতি এবং নেতৃত্বের ব্যর্থতাই দায়ী।
শান্তনু ঠাকুরের সঙ্গে মুকুল রায়ের ঘনিষ্ঠতার কথা সকলেই জানেন। মুকুলবাবুই ঠাকুরনগরের ঠাকুরবাড়ি থেকে তাঁকে রাজনীতিতে এনেছিলেন। কৈলাস বিজয় বর্গীয় আর মুকুলবাবুর কথোপকথনের অডিও ক্লিপিংসেও রয়েছে তার প্রমাণ। বিজেপির অন্দরের খবর, সিএএ ইস্যুতে শান্তনু ঠাকুর ‘বেসুরো’ হলেও আসল কারণ ছিল অন্য। নাগরিকত্ব ইস্যুতে প্রকাশ্যে ক্ষোভটা ছিল নেতৃত্বের উপর চাপ সৃষ্টি করে দাবি আদায়ের কৌশল। দিনের পর দিন তোপ দাগায় তাঁকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল দলবদলের জল্পনাও। কিন্তু সুব্রত ঠাকুরের টিকিট নিশ্চিত হতেই শান্তনুবাবুর ‘বিদ্রোহে’ পুর্নচ্ছেদ। শান্তনুবাবু জানেন, শিশু না কাঁদলে মা-ও দুধ দেয় না।
বিজেপি নেতৃত্ব শান্তনু ঠাকুরের ‘মান’ ভাঙানোর দায়িত্ব মুকুল রায়কেই দিয়েছিল। কারণ দিল্লির নেতারা দু’জনের সম্পর্কের ‘রসায়ন’টা খুব ভালো করেই জানতেন। এহেন মুকুলবাবু তৃণমূলে যেতেই বনগাঁর সাংসদকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল ধোঁয়াশা। নির্বাচনের পর দিলীপ ঘোষের বনগাঁর বৈঠকে ঠাকুরবাড়ির দুই জনপ্রতিনিধির অনুপস্থিতিতে গেরুয়া শিবিরের দুশ্চিন্তা সপ্তমে চড়েছিল। তারপর আর জল বেশি দূর গড়াতে দেওয়ার সাহস পায়নি বিজেপি নেতৃত্ব। তাই তাঁর পায়ে পরিয়েছে ‘মন্ত্রিত্বের বেড়ি’!
কোচবিহারের বিজেপি সাংসদ নিশীথ প্রামাণিককে মন্ত্রী করার পিছনেও একই অঙ্ক কাজ করছে। তৃণমূলের মাদার-যুবর লড়াইয়ের জেরে মুকুলবাবুর হাত ধরে ২০১৯ সালে বিজেপিতে যোগদান। পেয়েছিলেন লোকসভার টিকিট। তাঁকে টিকিট দেওয়ায় বিজেপিতে তৈরি হয়েছিল প্রবল বিক্ষোভ। কারণ তৃণমূলের জেলা যুব সভাপতি নিশীথবাবুর দাপটেই কোচবিহারে বিজেপির নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড় হয়েছিল। তা সত্ত্বেও তিনিই জিতেছিলেন। তার দু’বছরের মাথায় স্বরাষ্ট্র দপ্তরের মতো গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী। তৃণমূলের উপ-প্রধান থেকে কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী হতে সময় লেগেছে মাত্র আট বছর। রকেট গতিতে উত্থান বললেও একে কম বলা হয়।
রাজবংশী ভোটের কথা মাথায় রেখে এবং বিধানসভা ভোটে সাফল্যের জন্যই নাকি নিশীথবাবুকে মন্ত্রী করা হয়েছে। এই দাবির পিছনে যুক্তির চেয়েও বেশি রয়েছে কৌশল। প্রথমত, এবারের ভোটে কোচবিহার জেলায় হিন্দু-মুসলিম ফ্যাক্টর কাজ করেছে। লোকসভা নির্বাচনের সময় থেকে এই জেলায় রাজনৈতিক অশান্তি লেগেই ছিল। সেই সূত্রেই হয়েছে মেরুকরণের ভোট। দ্বিতীয়ত, নিশীথ প্রামাণিক বিধানসভা ভোটে জিতলেও মার্জিন ছিল মাত্র ৫৭। এই সংখ্যাটা কিছুতেই একজন রানিং এমপির ‘জনপ্রিয়তা’র প্রমাণ হতে পারে না। তাই তাঁর মন্ত্রিত্ব লাভের পিছনেও ‘মুকুল-ঘনিষ্ঠতা‘ এক্স-ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে।
তবে, এই মন্ত্রিত্ব নিশীথবাবুকে অগ্নিপরীক্ষার মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। রাজ্য তথা দেশের সীমান্ত জেলা থেকে নির্বাচিত হয়ে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের দায়িত্ব পাওয়ায় তাঁকে ঘিরে মানুষের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। তিনিই এখন সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হত্তা-কত্তা-বিধাতা। তাই গোরু পাচার, চোরাচালান থেকে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের উপর কতটা রাশ তিনি টানতে পারেন, সেটা মানুষ পর্যবেক্ষণ করবে।
পাশাপাশি দুই কেন্দ্র থেকে দু’জনকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী করার নজির খুব একটা নেই। এবার সেটাই হয়েছে। কোচবিহার-আলিপুরদুয়ার। তার কারণ কি আদিবাসী ভোট? চা বাগানে মজবুত সংগঠন? কিছুতেই না। জন বারলার মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্তির প্রধান কারণ, বিজেপির বাংলা ভাগের এজেন্ডাকে উত্তরবঙ্গের মানুষের মধ্যে জিইয়ে রাখা।
মন্ত্রিসভায় বাংলা থেকে চারজনকে নেওয়ার প্রথম কারণ বিজেপির ভাঙন ঠেকানো। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য, বিধানসভা ভোটের নিরিখে এগিয়ে থাকা এলাকায় লোকসভা ভোটে জয় হাসিল করা। বাঁকুড়া জেলার দু’টি এবং পুরুলিয়ার আসনে প্রভাব ধরে রাখা জন্যই সুভাষ সরকারকে মন্ত্রী করা হয়েছে বলে অনেকের বিশ্বাস। তবে, তাঁকে নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই। শিক্ষা থেকে নিষ্ঠা, সব ক্ষেত্রেই তিনি বাকি তিনজনের চেয়ে অনেক এগিয়ে। বাঁকুড়া জেলায় বিজেপিকে প্রতিষ্ঠিত করার পিছনে তাঁর পরিশ্রম এবং অবদান প্রায় সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেন। তাছাড়া চারজনের মধ্যে একমাত্র তিনিই রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ থেকে উঠে এসেছেন। তাই তাঁকে ঘিরে নেই আদি-নব্যের লড়াইও।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ থেকে আরও একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে, মোদি-অমিত শাহ জুটির উপর সঙ্ঘের নিয়ন্ত্রণ ক্রমশই আলগা হচ্ছে। নীতির চেয়েও ক্ষমতায় টিকে থাকার বিষয়টি বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। তাই দেবশ্রী রায়চৌধুরীর মতো সঙ্ঘ-ঘনিষ্ঠদের ছেঁটে ‘প্রভাবশালী’ দলবদলুদের জায়গা দেওয়া হয়েছে। সঙ্ঘ থেকে উঠে আসা সাংসদদের চোখের সামনে দিয়ে ‘দু’দিনের যোগী’রা ড্যাং ড্যাং করে মন্ত্রী হয়ে যাচ্ছেন। ইমেজ বা শিক্ষা নয়, ভোটে জেতানোর ‘ক্ষমতা’ই নেতাদের কাছে স্বীকৃতি পাচ্ছে। লোকসভা নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে এই প্রবণতা ততই বাড়বে। তবে, এই মুহূর্তে আদি-নব্যের খেলায় দলবদলুরা ৩-১ গোলে এগিয়ে।
বঙ্গ বিজেপির অন্দরে লড়াই যে তীব্র হচ্ছে এবং তার পরিণতি ভালো হবে না বলে ফেসবুক লাইভে জানিয়ে দিয়েছেন বিষ্ণুপুরের সাংসদ। সৌমিত্র খাঁ যুব মোর্চার সভাপতি থেকে পদত্যাগ করে পিছিয়ে এলেও ‘মনের ঝাল’ তিনি মিটিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু, দিলীপ ঘোষ সেটাও পারছেন না। হাজার উপেক্ষা, বঞ্চনা সত্ত্বেও তিনি ‘স্পিকটি নট’। একেই বোধহয় বলে, বুক ফাটে, তবুও মুখ ফোটে না!