বিদ্যার্থীরা মাঝে মধ্যে মানসিক উদ্বেগের জন্য শিক্ষায় অমনোযোগী হয়ে পড়বে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে নানা সুযোগ আসবে। ... বিশদ
১৯৯১ সালে এটাই ছিল ভারতের অর্থনীতি। রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি, মনোপলি অথবা রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের আধিপত্য, আমদানি নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের নির্দিষ্ট হার, লাইসেন্সিং, বাজার সম্পর্কে সন্দেহের মনোভাব প্রভৃতি বিষয়ে একটা রাজনৈতিক সহমত কাজ করত। এই ব্যাপারে কোনও রাজনৈতিক দল ব্যতিক্রম ছিল না। অতি বাম মনোভাবাপন্নরাই ভিন্নমত পোষণ করতেন।
প্রত্যাদিষ্ট বাছাই
১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত লোকসভার ভোটে কোনও দলের কাছে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের প্রত্যাশা ছিল না। ২৩২ আসন জিতে কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের কাছাকাছি পৌঁছেছিল। অর্থনৈতিক সঙ্কটের অতল থেকে ভারতকে সফলভাবে টেনে তোলার জন্য কেউ সরকারকে যৎসামান্য সুযোগও দেয়নি। ক্যাবিনেট মন্ত্রিপদে যাঁর একেবারে গতানুগতিক একটা কেরিয়ার ছিল, সেই পি ভি নরসিমা রাও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজেকে রাজনীতির জাদুকর প্রতিপন্ন করলেন! তাঁর তরফে অর্থমন্ত্রী পদে মনমোহন সিংকে বেছে নেওয়াটা ছিল প্রত্যাদিষ্টের মতো। বাণিজ্যমন্ত্রী পদে আমাকে নিয়োগের কারণটা, অনুমান করি, আমার এমবিএ ডিগ্রির সৌজন্যে।
মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে, ক্যাবিনেট সচিব নরেশ চন্দ্রের উদ্দেশে নরসিমা রাওয়ের স্মরণীয় মন্তব্য ছিল, ‘নরেশ, মন্ত্রীদের জন্য ঘোড়া এবং গাড়ি খুঁজে পেয়েছেন তো?’ আস্থা ভোটে (সংখ্যালঘু) সরকারের হেরে যাওয়ার ভয় নিয়ে প্রথম দশটা দিন কেটেছিল ভীষণ মন্থর ও ম্যাড়মেড়ে ভাবে। সময় ও নদীর স্রোত কারও জন্য, এমনকী, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর জন্যও অপেক্ষা করে না। ভারতের বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয় ফুরিয়ে আসছিল, খেলাপি হয়ে যাওয়ার ভয় পেয়ে বসেছিল, (বেসরকারিভাবে) মার্কিন ডলারের বিনিময় মূল্য চড়চড় করে বাড়ছিল, আমদানি ও রপ্তানি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়েছিলেন, দেশটা যেন সুদীর্ঘ একটা সুড়ঙ্গের ভিতরে ঢুকে গিয়েছিল যার কোত্থাও আলোর সন্ধান নেই। আরও বেশি সমাজতন্ত্রের দাবিতে চিলচিৎকার জুড়েছিলেন বামেরা। মুক্ত অর্থনীতির পক্ষে সওয়ালকারী কোনও রাজনীতিকের দেখা মেলেনি।
ছ’জন পুরুষ (কারণ সেটা ছিল লিঙ্গবৈষম্যের যুগ) একটা পাথরের মতো এমনভাবে উঠে দাঁড়ালেন যেন তার উপর ভগবান রামচন্দ্রের শ্রীচরণ যুগল এসে পড়ার প্রতীক্ষায় আছে: নরেশ চন্দ্র, এ এন ভার্মা, মন্টেক আলুওয়ালিয়া, রাকেশ মোহন, এস ভেঙ্কিটারামানন এবং ডঃ সি রঙ্গরাজন। দশম লোকসভা নির্বাচনের সময় তাঁরা একটা পরিকল্পনা করেছিলেন। প্রথম পদক্ষেপটা ছিল ভিতরে ভিতরে বিস্ফোরক: অবমূল্যায়ন। ১ জুলাই ডঃ মনমোহন সিং ৯ শতাংশ অবমূল্যায়নের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মহলের প্রতিক্রিয়া যাচাই করে নিলেন। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ‘ফ্রিজ’ করে দেওয়ার পক্ষে। মনমোহন সুকৌশলে সেই নিদান এড়িয়ে গিয়ে ৩ জুলাই তাঁর দ্বিতীয় পদক্ষেপে ১০ শতাংশ অবমূল্যায়ন করেন।
শিকল ছিঁড়ে বেরনো
ডঃ সিং চাপসৃষ্টি করলেন আমার এবং আলুওয়ালিয়ার উপর। বাণিজ্য নীতি পরিবর্তনের ব্যাপারে আমরা ১৩ দফার একটা প্যাকেজ আনলাম। ৪ জুলাই, আমি সেটা ঘোষণা করলাম এক সাংবাদিক সম্মেলনে। বাণিজ্য নীতির ঘোষণা বাণিজ্য মন্ত্রকের এক্তিয়ারের বাইরে চলে গিয়েছিল। ফিসকাল (রাজকোষ) এবং শিল্প নীতি, বৈদেশিক পুঁজি, আমদানির ধারা রোধ, বেশিরভাগ আমদানির লাইসেন্স বিলোপ এবং ভারতীয় মুদ্রাকে বাণিজ্য হিসেবে রূপান্তরের (কনভার্টিবিলিটি অফ দ্য রুপি অন দ্য ট্রেড অ্যাকাউন্ট) মধ্যে আমি সমন্বয় পদক্ষেপের উপর জোর দিয়েছিলাম! আমি এও বলেছিলাম যে, প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী এই ‘ব্যবস্থা গ্রহণের পক্ষে পূর্ণ সহায়’ ছিলেন। অর্থমন্ত্রক তার এই অভিযানে নতুন প্রেরণা পেল। নতুন বাণিজ্য নীতি প্রস্তাব গ্রহণে বাধ্য করল বাণিজ্য মন্ত্রক। ২৪ জুলাই পেশ করা হল যুগান্তকারী এক বাজেট।
আড়াই সদস্যের শক্তিসম্পন্ন সংস্কারবাদী রাজনৈতিক ব্রিগেড সংসদে প্রবল বিরোধীদের মোকাবিলা করল। সমালোচনায় সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন চন্দ্রশেখর। বিরোধী আক্রমণের ধার ভোঁতা করে দিতে আমি ফাইলপত্র নিয়ে গিয়েছিলাম, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকের উদার বাণিজ্য নীতি প্রস্তাবগুলিতে যেখানে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর অনুমোদন ছিল, কিন্তু সেটার রূপায়ণ হয়নি। ‘নোটিংস’ একনজর দেখে নিয়ে, নিছক ‘প্রস্তাব’ জ্ঞানে তিনি খারিজ করে দিলেন, যেগুলো কোনওদিনই রূপায়িত হওয়ার জন্য নয়!
আমূল পরিবর্তন আনার জন্য আমি ঝাঁপিয়েছিলাম। আমদানি-রপ্তানির প্রধান নিয়ন্ত্রকের দপ্তর আমরা তুলে দিয়েছিলাম। ‘ইন্ডিয়ান ট্রেড সার্ভিস’ গুটিয়ে দিয়েছিলাম আমরা। বিদায় দিলাম ‘রেড বুক’-কে—একটা সফল বণিক জাতিকে, ইয়া বড়া বইটা ৪০ বছর যাবৎ শ্বাসরোধ করে রেখেছিল। ওই বছরের শেষদিকে, ডঃ সিং আমার অগোচরে আলুওয়ালিয়াকে আমার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। তাঁকে দেখে আমার খারাপ লেগেছিল এবং ডঃ ওয়াই ভি রেড্ডি চলে গিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রকে। এ ভি গণেশনকে পেয়ে আমি খুশি হয়েছিলাম, কিন্তু অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রী মাধবরাও সিন্ধিয়া আমার উপর বেজায় চটে গিয়েছিলেন তাঁর সচিবকে তুলে নেওয়ার কারণে!
নতুন বৈদেশিক বাণিজ্য নীতি
একটা নতুন বৈদেশিক বাণিজ্য নীতি রচনার জন্য আমি অন্তর থেকে প্রস্তুত হয়ে ছিলাম। আমার নির্দেশাবলি ছিল স্পষ্ট: (১) লিখতে হবে ১০০ পাতার মধ্যে, তার থেকে একপাতাও বেশি নয়। (২) লিখতে হবে সহজ সরল ইংরেজিতে। পরিভাষা-কণ্টকিত বা দুর্বোধ্য গুরুগম্ভীর কিছু হলে চলবে না। কিন্তু এই নীতি এবং কার্যপ্রণালীর হ্যান্ডবুক কে লিখবেন? পুরো মন্ত্রকে এই দায়িত্ব গ্রহণে ইচ্ছুক বা সক্ষম একজনও ছিলেন না। হতাশ হইনি। এক রবিবার, আমি বাণিজ্য নীতির প্রথম অধ্যায়ের জন্য ‘ডিকটেশন’ দেওয়া শুরু করলাম। প্রতিটা অধ্যায় শেষ হতেই মিস্টার গণেশন তার সঙ্গে সমন্বয় করে কার্যপ্রণালীর হ্যান্ডবুকের অধ্যায় লিখতে লাগলেন। আমরা কাজটা যথাসময়ে শেষ করে ফেললাম এবং ১৯৯২ সালের ৩১ মার্চ নতুন বাণিজ্য নীতি প্রকাশ করলাম।
ওই নয়টি মাস, বড় সুখের সময় কেটেছিল। বিপুল পরিমাণে প্রবাহিত হয়েছিল অ্যাড্রিনাল গ্রন্থিরস। আমরা আবিষ্কার করলাম যে সবসময়ই আমাদের ডানা আছে, কিন্তু আমরা উড়তে ভুলে গিয়েছি। তিরিশ বছর আগে, এই সপ্তাহে, আমরা আকাশে যাত্রা করেছিলাম।