বিদ্যার্থীরা মাঝে মধ্যে মানসিক উদ্বেগের জন্য শিক্ষায় অমনোযোগী হয়ে পড়বে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে নানা সুযোগ আসবে। ... বিশদ
কোভিড মোকাবিলার দায়িত্ব ছিল পুরোদস্তুর এক ডাক্তারের কাঁধে। ডঃ হর্ষ বর্ধন। রাজধানী দিল্লিতে পড়াশোনা। চিকিৎসা বিজ্ঞানে স্নাতক গণেশ শঙ্কর বিদ্যার্থী মেমোরিয়াল মেডিক্যাল কলেজ থেকে। ঘাড় গলার জটিল অপারেশনেও প্রচুর নামডাক। তবু মন্ত্রকের ব্যর্থতা আজ সরকারের মাথাব্যথার কারণ। এপ্রিল মাস থেকে টানা দেড় মাস অক্সিজেন, ওষুধ আর হাসপাতালে শয্যা না পেয়ে মাথা কুটতে হয়েছে জনগণকে। অ্যাম্বুলেন্সে করোনা আক্রান্তকে চাপিয়ে ঘুরতে হয়েছে এ হাসপাতাল থেকে অন্যত্র। মৃতদেহের পাহাড় জমেছে। সৎকার করতে না পেরে গঙ্গা দিয়ে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে বেওয়ারিশ লাশ। কোনও একটা রাজ্য নয়, গত এপ্রিল ও মে মাস জুড়ে গোটা দেশের এটাই ছিল সরকারি ব্যর্থতার গড় চিত্র। অকালে প্রিয়জনকে হারিয়ে আজ ফুঁসছে মানুষ। চোখের উপর রেমডিসিভির নিয়ে কালোবাজারি দেখেও কেউ কিচ্ছু বলেনি। ব্যবস্থা নেয়নি স্বাস্থ্যমন্ত্রকও। এখন বিপাকে পড়ে ব্যর্থতার বদনাম ঘোচাতে হর্ষ বর্ধনকে সরিয়ে ঘটা করে দায়িত্ব দেওয়া হল গুজরাতের কৃষক পরিবার থেকে উঠে আসা মনসুখ মাণ্ডব্যর হাতে। মাণ্ডব্য চিকিৎসক নন। পড়াশোনা পশু বিজ্ঞান নিয়ে। পরবর্তীকালে অবশ্য পোস্টগ্রাজুয়েট করেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে। এরকম পাঁচমেশালি বায়োডাটার মাঝারি মেধার লোক সামলাবেন তৃতীয় ঢেউ! এত বড় দেশে দ্রুত টিকা ছড়িয়ে দিতে পারবেন তো রাজ্যে রাজ্যে? মোদিবাবুর ইচ্ছা মেনেই হর্ষ বর্ধন যে ব্যর্থ, এই বার্তা ক্রমে রটে গিয়েছে সারা দেশে। নতুন চকচকে আলো জ্বেলে দেওয়াও হয়েছে। এসেছে নতুন মুখ। তবে তৃতীয় ঢেউ সামলাতে না পারলে, মোদির ছবিতে আর এক বিন্দুও কাদা লাগলে উত্তরপ্রদেশ সহ পাঁচ রাজ্যের ভোটের আগে তাঁকেও একইভাবে বলির পাঁঠা করবে সরকার। এটাই নিশ্চিত ভবিতব্য। কারণ ধামাকাদার নেতা জানেন, নিজের ব্যর্থতা থেকে দৃষ্টি ঘোরাতে মাঝে মাঝে মুখোশ বদলই সেরা দাওয়াই।
অথচ দেশবাসী এতদিনে জেনে গিয়েছে, হর্ষ বর্ধন কিংবা মনসুখ কেউই স্বাস্থ্যের কলকাঠি নাড়ার নায়ক কিংবা খলনায়ক কোনওটাই নন। টিকা নীতি, লকডাউনে কী হবে সব ঠিক করেন মোদিজি ও পিএমও’র কর্তারা। চমক দেওয়ার কিছু থাকলে, হাততালি কিংবা থালাবাটি বাজাতে বলার মতো ‘ঐতিহাসিক’ কোনও ঘোষণা করার থাকলে ব্যাটন তুলে নেন প্রধানমন্ত্রীই। হর্ষ বর্ধনরা তখন ব্রাত্য। আর জাতির উদ্দেশে ভাষণ? গত দু’বছরে করোনা কালে এর কোনও অন্যথা হয়নি। সম্ভবত সবচেয়ে বেশিবার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার রেকর্ডও মোদিজির ঝুলিতেই। সাফল্য এলে ষোলো আনাই উশুল করে ছেড়েছেন, ভবিষ্যতেও ছাড়বেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু ব্যর্থ ছেলের বাবা কে হতে চায়? তাই পান থেকে চুন খসলেই বিদায় করো হর্ষ বর্ধন, রবিশঙ্কর, জাভরেকরদের। ময়দান মে উতরো নয়া খিলাড়ি! ভোট যে রাজনীতিকের সবচেয়ে বড় বালাই!
দেশের প্রধানমন্ত্রীর বয়সের চেয়ে পেট্রল-ডিজেলের দাম প্রায় দেড়গুণ বেশি। এই পরিস্থিতি স্বাধীন ভারতে খুব একটা দেখা গিয়েছে কি? যার অনিবার্য পরিণতি আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি। আয় কমছে, ব্যয় বাড়ছে। সাধারণ মানুষ তলিয়ে যাচ্ছে দেনায়। কিন্তু বেচারা মন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধানের এতে কী করার আছে। ‘ধর্মেন্দ্র’ গিয়ে ‘সলমন’ এলেও পরিস্থিতির কি খুব ইতরবিশেষ হবে? পেট্রল কি আবার ৭০ টাকা হবে? অন্তত যতক্ষণ মাথার উপর মোদি, অমিত শাহ, রাজনাথরা রয়েছেন। গত সাত বছরে তেলে ট্যাক্স বেড়েছে কতগুণ, তার হিসেব কি সরকার বাহাদুরের অজানা! নীতি ঠিক করে তো প্রধানমন্ত্রীর অফিস। নীতি এক রেখে শুধু মুখে রং মাখলে লাভ কী হবে? একনায়কের মন্ত্রিসভায় মন্ত্রীরা তো আজ শুধু চিড়েতন, হরতন, ইস্কাবন ছাড়া কিছুই নয়! সনাতন ছন্দে নেচে যাওয়াটাই একমাত্র কাজ। নাহলে বাংলার ভোটপর্বে দীর্ঘ সময় তেলের দাম বৃদ্ধিতে ছেদ পড়েছিল কেমন করে। পর্দার পিছন থেকে খেলাচ্ছে কে? আবার ২ মে বাংলায় বিজেপির ভরাডুবির খবর বেরতেই দাম বাড়ানোর পুরনো খেলা শুরু হল কার নির্দেশে?
মোদি সাহেবের যত্নের তাসের দেশে রোজ বিকেলে রাজার জয়গানে বসতেন বিহারের ভূমিপুত্র। রবিশঙ্কর প্রসাদ। আর মোদিজির মাস্টার স্ট্রোকের ফিরিস্তি দিতেন সাংবাদিকদের সামনে। অরুণ জেটলির মৃত্যুর পর ভেবেছিলেন তাঁর আর চিন্তার কী আছে? দলে আইন জানা ইংরেজি বলতে পারা আর তেমন কোনও প্রতিযোগীই নেই। এ কাজে তাঁর জুড়ি সহজে খুঁজে পাবেন না মোদি। চাকরি পাকা। তাই আরও জোরে ঢাক বাজাতেন। সেই ঢাক ফেঁসে গেল গত ৭ জুলাই। শিবসেনার সঞ্জয় রাউত ঠিকই বলেছেন, শেষ মাস্টার স্ট্রোকের শেলটা রবিশঙ্করের বুকেই লেগেছে। আপাতত ছাঁটাই হয়ে তাই তিনি নীরব! রবিশঙ্কর গত একশো ঘণ্টায় নির্ঘাত বুঝেছেন রাজার চেয়ে বড় রাজভক্ত হলে বিনাশ নিশ্চিত!
প্রাক্তন আইএএস ও আইআইটির কৃতী অশ্বিনী বৈষ্ণবকে রেল ও তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রী করে একসঙ্গে দু’জনের ডানা ছেঁটে দেওয়া হয়েছে। পীযূষ গোয়েল ও রবিশঙ্কর। দু’জনেই বিজেপির অত্যন্ত পরিশ্রমী ও প্রতিভাবান নেতা। অশ্বিনী মার্কিন মুলুকের হোয়ার্টন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করেছেন। নিঃসন্দেহে মেধাবী উজ্জ্বল মুখ। তার চেয়েও বড় কথা ওড়িশার এই ভূমিপুত্র গত দু’বছর ধরে নবীন পট্টনায়েকের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। তাই রাজ্যসভার নির্বাচনে তাঁকে বিজেপি ওড়িশা থেকে দাঁড় করালে পাল্টা কোনও প্রার্থীও দেয়নি নবীনবাবুর দল। তাই অশ্বিনীকে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি দপ্তর দিয়ে বিজেপি এক ঢিলে দুই পাখি মারারই ছক কষেছে। কারণ ট্যুইটার সহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মকে যেভাবে রবিশঙ্কর প্রসাদ খেপিয়ে তুলেছিলেন, তাতে বিদেশি গণমাধ্যমে সরকারের সমালোচনা বাড়ছিল। একটা জিনিস লক্ষ করার মতো, যত দিন যাচ্ছে সরকারে প্রাক্তন আমলাদের প্রভাব বাড়ছে। জয়শঙ্কর, হরদীপ সিং পুরীর পর অশ্বিনী বৈষ্ণব, আর কে সিং, অর্জুন মেঘাওয়াল, রামচন্দ্র প্রসাদ সিং। তালিকাটা কিন্তু দীর্ঘ হচ্ছে। তাহলে বিজেপিতে লেখাপড়া জানা কাবিল নেতার সংখ্যা কি ক্রমেই বাড়ন্ত যে বাইরে থেকে আমলা ধার করতে হচ্ছে?
বিষ যাতে মাথায় চড়ে না বসে তা নিশ্চিত করতেই আবারও সশব্দ ধামাকার পথ বেছে নিলেন মোদিজি। হল মন্ত্রিসভার মেগা রদবদল। সরকারের ভাবমূর্তি ফেরাতে স্রেফ একটা ঝাঁকুনি। অনেকটাই ৫৮ বছর আগের কামরাজ প্ল্যানের আদলে। সব দায় অধস্তন মন্ত্রীদের ঘাড়ে চাপিয়ে খুঁজলেন পরিত্রাণের সহজ উপায়। জনগণেশ যে তাঁর কাজে ক্ষুব্ধ তার ইঙ্গিত মিলতে শুরু করেছে অনেক আগেই। কৃষক, শ্রমিক থেকে শুরু করে কোটিপতি ব্যবসায়ী সবাই হাত কামড়াচ্ছেন। ব্যবসা লাটে। জুন মাসের জিএসটি আদায় আবার ১ লক্ষ কোটি টাকারও নীচে নেমে গিয়েছে। তবু পোশাক বদলে রং মেখে সং সেজে ভোটে তো জিততে হবে। তাই উত্তরপ্রদেশ থেকে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির একঝাঁক মন্ত্রী। সব মিলিয়ে ৭ জন। আর মহারাষ্ট্র থেকে ৪জন। আর সম্প্রদায় ও নির্দিষ্ট এলাকার ভোটব্যাঙ্ক বিচার করে বাংলা থেকে চার। মানুষের উপকার নয়, আপাতত চব্বিশের সাধারণ নির্বাচন যে কোনও মূল্যে উতরে দেওয়াই নরেন্দ্র মোদির কাছে চ্যালেঞ্জ। কিন্তু এত কিছু করেও স্পর্শ করা হল না সরকারের সবচেয়ে কলঙ্কিত মন্ত্রককে। একটা শিশুও জানে মোদি সরকারের সবচেয়ে ব্যর্থ দপ্তরের নাম অর্থমন্ত্রক। তাহলে একের পর এক মন্ত্রীকে সরানো হলেও নির্মলা সীতারামন নট আউট থাকেন কী করে? সরকার ও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের উদ্বেগের শেষ নেই। প্যাকেজের নামে শুধু মৃতপ্রায়কেও ঋণের নাগপাশে জড়িয়ে দেওয়ার ফন্দি। ক্রেডিট স্টিমুলেশন যে এই মুহূর্তে অর্থনীতির সঙ্কটমোচন করতে পারবে না তা জেনেও সরকার নাচার। চাহিদা না বাড়লে, বাজারে টাকার লেনদেন কমে গেলে অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানো কষ্টকল্পিত স্বপ্ন হয়েই থেকে যাবে। সেক্ষেত্রে মারাত্মক প্রাণঘাতী রোগটার সঠিক চিকিৎসা না করে আঙুলের ফোঁড়াটাকে শুধু কেটে বাদ দিলে সামগ্রিক রোগমুক্তি কি সম্ভব? অসুখ চেপে শুধু খোলস বদল আর ধামাকা দিয়ে ফল কী হয়, সেটাই এখন দেখার।