বিদ্যার্থীরা মাঝে মধ্যে মানসিক উদ্বেগের জন্য শিক্ষায় অমনোযোগী হয়ে পড়বে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে নানা সুযোগ আসবে। ... বিশদ
তারপর চারবছর পেরনোর আগেই শুরু হয়ে গিয়েছে নতুন মুখের সন্ধান। সেই কাঙ্ক্ষিত মুখটা কি অরবিন্দকুমার শর্মা (৫৮)? ২০০১ সালে নরেন্দ্র মোদি যখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী, দক্ষ আমলা হিসেবে এ কে শর্মা তাঁর খুব আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। প্রধানমন্ত্রী মোদির কাছে এই আইএএসের কদর কতটা অক্ষুণ্ণ রয়েছে, তা বোঝা গেল এবছর গোড়ার দিকে তিনি চাকরি থেকে আগাম অবসর নিতেই। চাকরি ছাড়ার পরদিন, ১৪ জানুয়ারি শর্মা উত্তরপ্রদেশ রাজ্য বিজেপিতে যোগদান করেন, দলের রাজ্য সভাপতি স্বতন্ত্রদেব সিংয়ের উপস্থিতিতে। অমনি ব্যাপারটা দারুণ এক চর্চার বিষয় হয়ে ওঠে। ১৯৮৮ ব্যাচের আইএএস শর্মাকে মুখ্যমন্ত্রী মোদি তাঁর সচিব হিসেবে বেছে নেন। ২০১৪-য় মোদি রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে এই শর্মাকেই পিএমও-র যুগ্ম-সচিব পদে তুলে আনা হয়। পরে করা হয় প্রধান সচিব। লোপ্রোফাইল অফিসারটি মোদির খাস ‘ইয়েস ম্যান’ হিসেবে পরিচিত। ২০০৮-এ সিঙ্গুর থেকে সানন্দে টাটার ন্যানো কারখানা নিয়ে যাওয়ার নেপথ্যেও তাঁর ভূমিকা ছিল। বিদেশ থেকে লগ্নি আনার ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গসহ বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে যখন চূড়ান্ত কমপিটিশন চলছে তখন ‘ভাইব্রান্ট গুজরাত’-এর কো-অর্ডিনেটর হিসেবে শর্মা গেরুয়া শিবিরের নয়নমণি। গুজরাতে পুঁজি টানতে বিদেশেও মোদির সফরসঙ্গী হয়েছেন তিনি।
মহামারীতে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পক্ষেত্রের নাম এমএসএমই। গতবছর মে মাসে এমএসএমই পুনরুজ্জীবনের গুরুদায়িত্ব মোদি তাঁকেই দেন। আবার চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার দেড় বছর আগেই ভিআরএস নেন শর্মা। যোগ দেন বিজেপিতে। পর্দার আড়াল থেকে সোজা উঠে এসেছেন রাজনীতির কঠিন মঞ্চে। আমলা হিসেবে প্রায় দু’দশক মোদির সঙ্গ ও আস্থা অর্জনের মধ্য দিয়ে এ কে শর্মা রাষ্ট্রক্ষমতার অলিন্দে ‘মোদির লোক’ হিসেবেই পরিচিত হয়ে উঠেছেন। তাঁর প্রতি মোদির পূর্ণ আস্থার প্রমাণ পাওয়া গেল, দ্রুত এমএলসি মনোনীত করার মধ্য দিয়ে। ২০২২-এর প্রথমার্ধে বিধানসভার ভোট। তার আগে দলের ও সরকারের এক সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে শর্মার অন্তর্ভুক্তি বড় কোনও ইঙ্গিত বহন করছে না কি? লখনউতে শর্মাকে যেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে বিজেপিতে স্বাগত জানানো হল সেদিন ‘সম্মানিত’ ব্যক্তিটি আপাত নিরীহ অথচ বেশ তাৎপর্যপূর্ণ একটি মন্তব্য করেন, ‘দেশে অনেক রাজনৈতিক দল আছে। আমার কোনও পলিটিকাল কানেকশন নেই। কিন্তু এইরকম একটা সিদ্ধান্ত শুধু মোদিজির মতো নেতা এবং বিজেপির মতো একটা দলের পক্ষেই নেওয়া সম্ভব।’ সেদিন থেকেই জোর গুঞ্জন, মোদি আর যোগীর প্রতি মোটেই প্রসন্ন নন। আপাতত যোগীর উপর শ্যেনদৃষ্টি রাখাই হবে শর্মার ডিউটি। সময় হলে যোগীর আসন উপহার দেওয়া হবে শর্মাকেই। রাজনীতি এবং দিল্লির আমলা মহলে এটাই বলাবলি হচ্ছে যে, লখনউতে পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী পদে শর্মাই মোদির এক ও একমাত্র পছন্দ। এটা তাঁর ‘পেট প্রজেক্ট’। তবে, শর্ত একটাই—২০২২-এ বিজেপিকে ক্ষমতায় ফেরানোর গুরুদায়িত্ব শর্মাকেই নিতে হবে। সামান্য এমএলসি’তেই যে তাঁর নয়া দৌড় থামছে না তাও বুঝিয়ে দিয়েছে মোদির ইচ্ছা।
২০ জুন রাজ্য বিজেপির সহ সভাপতি পদে অভিষেক হয়েছে এ কে শর্মার। নতুন পদে বসেই তিনি শুনিয়ে দিয়েছেন সেই আশার বাণী যা মোদি শুনতে ভালোবাসেন, ‘২০১৩-১৪ সালে উত্তরপ্রদেশের জনতা নরেন্দ্র মোদিকে যতটা ভালোবাসত, এখনও তারা ততটাই ভালোবাসে তাঁকে। বিধানসভার পরবর্তী ভোটে বিজেপির জয়ের জন্য এই মহান জননায়কের নাম ও পৃষ্ঠপোষণাই যথেষ্ট।’ শর্মা কথাগুলি দলের রাজ্য সভাপতিকে একটি চিঠিতে লেখেন। তাতে তিনি এই আশাও ব্যক্ত করেন যে, বিজেপি গতবারের চেয়ে বেশি আসনেই জিতবে। চিঠিটি এমন একদিন (পরদিন) সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয়, যেদিন বি এল সন্তোষ এবং রাধামোহন সিং সমেত কেন্দ্রীয় বিজেপির একটি টিম আরএসএস কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করতে উত্তরপ্রদেশে। দুই নেতা তার কিছুদিন আগেই যোগী সরকারের মন্ত্রীদের সঙ্গে দেখা করে ভোটপূর্ব ‘ফিডব্যাক’ নেন। যোগীর নাকের ডগায় বসে তাঁরাই আগামী ভোটের ঘুঁটি সাজাচ্ছেন! এই অস্বস্তি কোথায় রাখবেন মুখ্যমন্ত্রী?
এই প্রসঙ্গে আরও বলা দরকার যে, সেকেন্ড ওয়েভ মারাত্মক আকার নিতেই এ কে শর্মাকে বারাণসীতে পাঠানো হয় মোদির নির্বাচন কেন্দ্রের কোভিড পরিস্থিতি ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব দিয়ে। তিনি অভিহিত হন ‘কোভিড প্রভারী’ নামে। সেখানে ডিআরডিও-র একটি হাসপাতাল তৈরির দেখভালের দায়িত্বও তাঁর। জেলা পুলিসের সঙ্গেও মিটিং করার ক্ষমতা তাঁকে দিয়েছেন মোদি। উচ্ছ্বসিত শর্মা তাঁর এই ‘ঐতিহাসিক যাত্রা’ শুরু হওয়ার জন্য ‘বিকাশ পুরুষ’ মোদির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ২০১৯-এ মোদি যে বারাণসী থেকে প্রার্থী হলেন এবং জিতলেন, তার পিছনেও শর্মার কৃতিত্ব ছিল। বিশেষ বার্তাসহ শর্মার উপস্থিতি এবং তাঁর ক্ষমতার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি থেকে উত্তরপ্রদেশের মানুষের কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে যে, মোদি আর টানতে পারছেন না যোগীকে। যোগীর চারবছরের শাসনে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে ধর্ষণ, খুন, পুলিসি এনকাউন্টার এবং সংখ্যালঘু ও দলিত নির্যাতনে এই ‘রামরাজ্যের’ যে দুর্নাম হয়েছে তা কহতব্য নয়। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কৃষকদের ক্ষোভ এবং করোনা নিয়ে লেজেগোবরে অবস্থা। গঙ্গাবক্ষে লাশের মিছিল সারা পৃথিবীর কাছে ভারতের মাথা হেঁট করে দিয়েছে। কিছুদিন আগেই বিজেপির গ্রামীণ ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে পঞ্চায়েত ভোট।
কিন্তু বিশ্বস্ত আমলাকে দিয়ে পোড়-খাওয়া রাজনীতিকের অসাধ্য কাজ কতটা সমাধা হবে? এই প্রশ্ন এখনই উঠে গিয়েছে। প্রথম কথা হল, ছোট ও মাঝারি শিল্পের (এমএসএমই) হাল ফেরাতে পেরেছেন কি শর্মা? অর্থনীতি এবং শিল্প-বাণিজ্য মহল তাঁকে পাশ মার্কটাও দেবে বলে মনে হয় না। মানুষটিকে আমলা মহল ‘অজাতশত্রু’ সার্টিফিকেট দিলেও, রাজনীতির ময়দান যে জিলিপির চেয়েও প্যাঁচালো! ইতিমধ্যেই কথা উঠেছে, উচ্চবর্ণের মানুষটি মোটেই মিশুকে নন। তৃণমূল স্তরের বিজেপি কর্মীদের নাকি আপন করে নিতে পারছেন না। তারপর আছে গোবলয়ের জাতপাতের রাজনীতির ক্রনিক ব্যাধি। যোগী এবং তাঁর ক্যাম্পের নেতা-কর্মীরা এই মওকা ছেড়ে দেবেন বলে মনে হয় না। তাঁরা বেগ দেবেনই। মোদি বনাম যোগীর লড়াইয়ের ফায়দা অখিলেশ যাদব সহ বিরোধীরা নিতে চাইবেনই। ‘দিদি’র গুণমুগ্ধ অখিলেশরা ইতিমধ্যেই হুঙ্কার শোনাচ্ছেন ‘খেলা হোই’! সেক্ষেত্রে মোদিকে ভরসা জোগাতে পর্দার পিছনে রেডি থাকতে পারেন মায়াবতী এবং আসাদউদ্দিন ওয়াইসি। কিন্তু, এত করেও যে মোদি নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না, সেটা বোঝা যাচ্ছে রামমন্দির ইস্যুকে ফের ম্যাজিকের আকারে তুলে ধরা দেখে। সম্প্রতি (শনিবার) অনুষ্ঠিত হল অযোধ্যা ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানের বৈঠক। প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন, রামমন্দির ঘিরে অযোধ্যাকে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতীক রূপে গড়ে তোলা। যেখানে ঐতিহ্য ও উন্নয়নের মেলবন্ধন ঘটবে। তিনি ঘোষণা করেছেন, এমন অযোধ্যা নির্মাণ করা হবে যেখানে জীবদ্দশায় অন্তত একটিবার ঘুরে আসার বাসনা থাকবে সবারই। কিন্তু বিতর্ক কিছুতেই রামমন্দির এবং অযোধ্যার পিছু ছাড়ে না। একদিকে আছে জমি-দুর্নীতির অভিযোগ, অন্যদিকে আছে নব অযোধ্যা নির্মাণের কৃতিত্বের ভাগ নিয়ে মোদি-যোগী দ্বন্দ্ব। দুর্নীতির অভিযোগ ট্রাস্ট নস্যাৎ করলেও মানুষ কতটা বিশ্বাস করছে তা মানুষই জানে। কিন্তু সরযূর তীরে তাঁর দুই পরম ভক্ত। শ্রীরামচন্দ্রের এখন মোদি রাখি না যোগী রাখি দশা! কাকে তুষ্ট করবেন তিনি? মাঝখান থেকে কোনও নেপোয় দইয়ের হাঁড়িটা নিয়ে পালাবে না তো? দু’বছর যাবৎ বিজেপির ভোটভাগ্য মোটে ভালো যাচ্ছে না যে। এটা আর সামান্য দীর্ঘায়িত হলেই সর্বনাশ। সংক্রমণটা ২০২৪-এর আগে প্রতিরোধ করার ভ্যাকসিন খুঁজে পাবে কি গেরুয়া শিবির? তখন শর্মাজির ঠাঁই কোথায় হবে? মোদি সবসময় চমক সন্ধানী, ফল যা-ই হোক। এটাই তাঁর রাজনীতির বৈশিষ্ট্য।