বিদ্যার্থীরা মাঝে মধ্যে মানসিক উদ্বেগের জন্য শিক্ষায় অমনোযোগী হয়ে পড়বে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে নানা সুযোগ আসবে। ... বিশদ
শতবর্ষ প্রাচীন কংগ্রেস দলের সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায় ছিল ’৭৫-এ জরুরি অবস্থা ঘোষণার সিদ্ধান্ত। প্রবল ক্ষমতাশালী প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধীর অঙ্গুলিহেলনে সেই বছরের ২৫ জুনের মাঝরাতে জারি হওয়া জরুরি অবস্থার মেয়াদ ছিল প্রায় দু’বছর। কেন তাঁকে জরুরি অবস্থা জারি করতে হয়েছিল তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত রয়েছে। তবে যা নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই তা হল ওই সময়কালে গণতন্ত্র, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মানুষের মৌলিক অধিকারের টুঁটি চেপে ধরে এক দমবন্ধ করা পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছিল সরকারিভাবেই। ভারত রক্ষা আইন ও মিসা-য় তখন হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও সমাজকর্মীদের আটক করা হয়েছিল। এমনকী সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকরাও ইন্দিরা সরকারের রোষের হাত থেকে রেহাই পাননি। গোটা দেশে ধিক্কৃত সেই কলঙ্কিত অধ্যায়ের ৪৬তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী মোদি কংগ্রেসকে তীব্র আক্রমণ করে বলেছেন, তখন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ পিষে মারা হয়। নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হয়। দর্শকে পরিণত করা হয় সংসদ ও আদালতকে। নিষিদ্ধ করা হয় সমস্ত প্রতিবাদ বিক্ষোভ। পরিকল্পিতভাবে সমস্ত প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা হয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, যিনি এই কথাগুলি বলছেন তাঁর মুখে কি কথাগুলি শোভা পায়?
ইতিহাস বড় নির্মম, নিষ্ঠুর। জরুরি অবস্থার কালো দিনগুলির কথা জনমানসে দগদগে ঘায়ের মতো জ্বলজ্বল করছে, যা সহজে ভোলার নয়। কিন্তু মন্ত্রিসভার বৈঠক ডেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারি ঘোষণা না হলেও মোদি জমানার সাত বছরে দেশে যে দুর্বিষহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাকে অঘোষিত জরুরি অবস্থা বলেই মনে করছেন অনেকে। দু’বছর আগে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর মোদি-শাহ যেন আরও মরিয়া। বিরোধী বক্তব্যকে তোয়াক্কা না করে, মানুষকে অবদমিত করে রেখে কার্যত স্বৈরাচারী শাসন চালিয়ে যাচ্ছেন শাহেনশা মোদি। তাঁর রাজত্বে ‘জরুরি অবস্থা’ জারি না থাকলেও দেখা যাচ্ছে সরকার বিরোধী ইতিউতি প্রতিবাদ বিক্ষোভ হলেই কপালে জুটছে দেশদ্রোহিতার তকমা। ছাত্রদেরও রেহাই নেই। সরকারি নীতির বিরোধিতা করলেই নেমে আসছে ইউএপিএ আইনে শাস্তির খাঁড়া। কখনও-বা সমাজকর্মীদের দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে শহুরে নকশাল বলে। বিভিন্ন রাজ্যে নির্বাচনে জিততে এবং কেন্দ্র বিরোধী নেতাদের টাইট দিতে ইডি, সিবিআইয়ের মতো এজেন্সিকে কাজে লাগানো হচ্ছে। খর্ব করা হচ্ছে বাক্স্বাধীনতা এবং কিছু মৌলিক অধিকার। মোদি জমানায় নির্বাচন কমিশনের মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও উঠছে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ। আদালতের উপর সরকারি প্রভাব খাটানোর চেষ্টার অভিযোগে হয়েছে বিদ্রোহ। সারা দেশ বিরোধিতা করলেও স্রেফ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে একের পর এক জনবিরোধী আইন পাশ হচ্ছে। যার অন্যতম বিতর্কিত তিন কৃষি আইন। দেশের অন্নদাতাদেরও দেগে দেওয়া হচ্ছে পাকিস্তানি চর বলে। এই সরকারের তৈরি আইন বলে সিএএ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেওয়া পড়ুয়ারা হেনস্তার শিকার। ভীমা কোরেগাঁও মামলায় সমাজকর্মীদের বন্দি করা, এমনকী সরকার বিরোধিতার খবর লিখে জেলে যেতে হয়েছে সাংবাদিকদের। এও এখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট প্রায় সমস্ত অটোনমাস প্রতিষ্ঠান বাধ্য হয়ে এখন মোদি-শাহের তাঁবেদারি করছে। সর্বস্তরে নজরদারি চালানোর ব্যবস্থা করেছে এই সরকার। এমনকী তথ্যপ্রযুক্তি আইনের নতুন বিধিতে সরকার তার ইচ্ছামতো পোর্টাল ওয়েবসাইট থেকে খবর সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা রেখেছে। বারবার এই সরকার যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আঘাত হেনেছে। জরুরি অবস্থাতেও এমন নজির খুঁজে পাওয়া ভার।
ইতিহাস বলে, চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়। জরুরি অবস্থার কলঙ্ক মাথায় নিয়ে ১৯৭৭-এর লোকসভা নির্বাচনে দোর্দণ্ডপ্রতাপ ইন্দিরাকে বিদায় নিতে হয়েছিল। তাঁর নাতি রাহুল গান্ধীকে এখন বলতে হচ্ছে, জরুরি অবস্থা জারি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন নরেন্দ্র মোদি সম্ভবত এমন অঘোষিত জরুরি অবস্থা চালিয়ে আয়নায় নিজের মুখ দেখতে পাচ্ছেন না। ইতিহাসবিদরা বলছেন, অর্থনীতি থেকে সমাজনীতি—সবক্ষেত্রে এখন জরুরি অবস্থার চেয়েও খারাপ অবস্থা চলছে। একের পর এক রাজ্য জয়ের তাড়নায় মোদি অবশ্য এসব ভাবছেন না। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, এখন থেকেই ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচন দুয়ারে কড়া নাড়ছে। ইতিহাস বড় নির্মম। কাউকে রেয়াত করে না।