প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বা অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন যে সিনিয়র সিটিজেন, তা নিয়ে কারও কোনও সংশয় নেই। তাঁদের উপার্জিত অর্থ ডাকঘরের কোনও স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পে জমা পড়ে কি না সেই তথ্য পরিষ্কার নয়। অন্যভাবে বললে, তাঁরা এখনও কর্মক্ষম থাকলেও এবং সরকারের কাছ থেকে মন্ত্রী হিসেবে বেতন বা ভাতা পেলেও তা ডাকঘরের কোনও প্রকল্পে জমা করেন কি না আমাদের মতো সাধারণ মানুষের অজানা। তবে এটা বলাই যায়, দেশের কোনও নাগরিক কোনওদিন কোনও ডাকঘরে সিনিয়র সিটিজেন প্রধানমন্ত্রী বা অর্থমন্ত্রীকে লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা জমা দিতে বা তুলতে দেখেননি। সাধারণ মানুষের মতো তাঁরা লাইনে দাঁড়িয়ে নিজের টাকা নিজে তুলবেন, আমাদের মতো দেশে এমন ভাবাটাও মূর্খামি। বরং তাঁদের হয়ে যাবতীয় কাজ করে দেওয়ার জন্য নির্দিষ্ট ব্যক্তি থাকবেন, সেটাই স্বাভাবিক। তা প্রধানমন্ত্রী যতই নিজেকে অতি সাধারণ ঘর থেকে উঠে আসা একজন মানুষ বলে দাবি করুন না কেন। তাই হয়তো তাঁর পক্ষে সিনিয়র সিটিজেনের যন্ত্রণাটা অনুভব করা সম্ভব হচ্ছে না। এতদিন দেশের প্রবীণ নাগরিকদের বাড়তি একটু সুবিধা দেওয়ার কথা ভাবা হতো। ডাকঘরে অন্যের সহযোগিতায় (মেসেঞ্জার মারফত) টাকা তোলার সুবিধা পেতেন দেশের প্রবীণ নাগরিকরা। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট প্রবীণ-প্রবীণার অনুমতিক্রমে তাঁর হয়ে অন্য কেউ স্বল্প সঞ্চয় প্রকল্পের টাকা বা সুদের টাকা তুলতে পারতেন। খুব সম্প্রতি এক কলমের খোঁচায় প্রবীণদের সেই সুযোগ বাতিল করে দিয়েছে মোদি সরকার। এর অর্থ ডাকঘরে টাকা রাখা মানুষটির বয়স ৮০ বা ৯০ হলে তা বিচার্য নয়, তিনি চলতে ফিরতে পারেন কি না বা শয্যাশায়ী কি না তাও বিচার্য নয়। এবার মাসের শুরুতেই ন্যায্য পাওনাটি পেতে হলে তাঁকে সশরীরে হাজির হতে হবে। না পারলে টাকা তাঁর সঞ্চয়ের তহবিলেই পড়ে থাকবে। এখানেই প্রশ্ন, কোনও সভ্য দেশে এমন অমানবিক নিয়ম চাপিয়ে দিতে পারে কি কোনও সরকার? এই নিয়ম নিয়ে দ্বিচারিতার প্রশ্নও উঠছে। অনেকেই বলছেন, দেশের প্রবীণ নাগরিকদের বুথে গিয়ে ভোট দেওয়ার ঝক্কি আটকাতে তাঁদের বাড়িতে গিয়ে ভোটগ্রহণের নিয়ম হয়েছে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে। অথচ এদেশেই আবার ভরণপোষণের টাকা আনতে প্রবীণদের ডাকঘরে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে! বলা বাহুল্য, টাকা তোলার স্লিপে ‘মেসেঞ্জার’ সুবিধা তুলে দেওয়ার ফরমানে বিপাকে পড়বেন রাজ্যের লক্ষাধিক অসুস্থ ও প্রবীণ নাগরিক।কেন্দ্রীয় সরকারের তুঘলকি কাণ্ডকারখানার জেরে ক্রমশই মানুষ, বিশেষ করে প্রবীণ নাগরিকরা ডাকঘরে টাকা রাখার ব্যাপারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ছেন। বহু ডাকঘরে এমনিতেই পরিষেবার হাল তলানিতে। অথচ ঘরের সামনে ডাকঘরে সারা জীবনের কষ্টার্জিত অর্থ রেখে একসময়ে অবসরপ্রাপ্ত নাগরিকরা নিশ্চিন্ত বোধ করতেন। এখন তাঁদের জন্য বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের কোনওরকম মাথাব্যথা যে নেই তা সরকার গৃহীত কিছু সিদ্ধান্তেই স্পষ্ট। মোদি সরকারের ‘সুশাসনের’ জেরে দেশের অসংখ্য বৃদ্ধবৃদ্ধার বদ্ধভূমিতে যাওয়ার উপক্রম! কর্মজীবনের শেষে সঞ্চিত অর্থের সুদের টাকায় যাঁরা বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবেন ভেবেছিলেন সরকারের বদান্যতায় তাঁদের জীবন ক্রমশই দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। স্বল্প সঞ্চয়ের সুদের হারে বারবার কোপ পড়ায় অনেকের কাছে জীবনধারণটাই কষ্টকর হয়ে উঠেছে। লক্ষণীয় যে, সামনে ভোট থাকলে সুদের হার তখন অপরিবর্তিত থাকে। নচেৎ দফায় দফায় তা কমে। স্বল্প সঞ্চয়ের সুদের হার কমিয়ে ভোট থাকায় রাতারাতি সেই হার অপরিবর্তিত রাখার সিদ্ধান্তও এই মোদি জমানাতে বিরল নয়। এদিকে রান্নার গ্যাস থেকে নিত্যপণ্য—সবকিছুই এই আমলে মহার্ঘ হয়েছে। বৃদ্ধ বয়সের চিকিৎসার খরচ সামলে ডাল-ভাত জোগাড় করতেই হিমশিম খাচ্ছেন অনেকে। এঁদের মধ্যে যাঁরা ‘ভিক্ষাসম’ ইপিএফের পেনশন পান তা দিয়ে এই দুর্মূল্যের বাজারে আধবেলা খাবার জোগাড় করাও কষ্টকর। অথচ এই সম্মাননীয় প্রবীণদের যন্ত্রণার দিকটি অনুধাবন না করে একজন সিনিয়র সিটিজেন দেশশাসকই নিত্যনতুন নির্দেশ জারি করে তাঁদের আরও দুর্গতির মুখে ঠেলে দিচ্ছেন! যা শুধু অমানবিকই নয়, অন্যায়ও বটে।গ্রাহক স্বার্থের কথা না ভেবে কেন্দ্রীয় সরকারের এমন সিদ্ধান্তের জেরে ডাকঘর থেকে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিলে তার দায় বর্তাবে সরকারেরই উপর। সরকারি নিয়মের জাঁতাকলে পড়ে ইতিমধ্যেই আয় কমেছে সেখানকার বহু এজেন্টের। গ্রাহকদের সুবিধা-অসুবিধার কথা যে ভাবা হচ্ছে না তার নবতম নজির ‘মেসেঞ্জার’ সুবিধা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তটি। অশীতিপর বৃদ্ধ বা অসুস্থ বা প্রতিবন্ধী মানুষকে সশরীরে এসে টাকা তোলার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়াতে হবে, এই নয়া নির্দেশিকার জেরে। মানুষকে অসুবিধায় ফেলে দেওয়ার পিছনে সরকারের কী উদ্দেশ্য আছে তাও স্পষ্ট নয়। অথচ, এই বয়স্ক নাগরিকদের সুখে-শান্তিতে রাখার দায়িত্ব সরকারেরই। কিন্তু মোদি সরকার সে পথে না হেঁটে যেসব নির্দেশিকা জারি করছে তা যেমন বঞ্চনার, তেমনই অসম্মানেরও। এঁদের প্রাপ্য সম্মানটুকু অন্তত দিক কেন্দ্র।