বিশ্বজিৎ দাস, কলকাতা: ক্লেবসিয়েলা নিউমোনি! নামটাই দেশ তথা বিশ্বজুড়ে তাবড় তাবড় ক্রিটিক্যাল কেয়ারের বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগে ফেলার জন্য যথেষ্ট। জার্মান মাইক্রোবায়োলজিস্ট এডউইন ক্লেবস-এর নামাঙ্কিত এই অত্যন্ত বিপজ্জনক ব্যাকটেরিয়া ফি বছর বিশ্বে ৬ থেকে ৮ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর কারণ। নিউমোনিয়া, প্রস্রাবে সংক্রমণ (ইউটিআই), পিত্তনালির ইনফেকশন, ক্ষতস্থানে ও রক্তে সংক্রমণের মতো প্রাণঘাতী অসংখ্য বিপদের কারণ এটি। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ক্লেবিসিয়েলা নিউমোনির কারণে নিউমোনিয়া হলে প্রতি ২ জনের মধ্যে ১ জনের মৃত্যু হয়! আসলে সংক্রমণের জায়গায় দলবেঁধে ‘বায়োফিল্ম’ নামে এক ধরনের জৈব পদার্থ তৈরি করে ক্লেবসিয়েল্লা। প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট, নিউক্লিক অ্যাসিড প্রভৃতি দিয়ে তৈরি এই বায়োফিল্মে কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণই বেশি। আর এই বায়োফিল্মই অ্যান্টিবায়োটিক রুখতে গড়ে তোলে দুর্ভেদ্য প্রাচীর। এভাবে কালে কালে ড্রাগ রেজিস্টেন্ট হয়ে প্রায় ‘অপরাজেয়’ রূপ নিয়েছে সে। অতিসম্প্রতি এক উৎসেচক আবিষ্কার করে এমন বিপজ্জনক ব্যাকটেরিয়াটির বায়োফিল্মের দুর্গ ভাঙার পথ বের করে ফেললেন দুই বাঙালি বিজ্ঞানী এবং তাঁদের কয়েকজন ছাত্রছাত্রী। বিজ্ঞান গবেষণায় দেশের অগ্রগণ্য প্রতিষ্ঠান বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স-এর এই দুই বিজ্ঞানী হলেন সেখানকার সহযোগী ডিন বিখ্যাত মাইক্রোবায়োলজিস্ট ডঃ দীপশিখা চক্রবর্তী এবং ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রির সহকারী অধ্যাপক ডঃ দেবাশিস দাস। নেচার জার্নাল গোষ্ঠীর ‘বায়োফিল্ম অ্যান্ড মাইক্রোবায়োমস’ শীর্ষক বিজ্ঞান পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে গবেষণাটি। বিশেষ ধরনের উৎসেচক আবিষ্কারের জন্য ইতিমধ্যেই পেটেন্ট পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। সুগারের রোগীদের ফুট আলসার নিয়ে এইবার শুরু হতে চলেছে তাঁদের হিউম্যান ট্রায়াল। সেখানে ক্লেবসিয়েল্লা সংক্রামিত ডায়াবেটিক রোগীদের পায়ের ক্ষতস্থানে প্রয়োগ করা হবে নতুন উৎসেচকটি।
ডঃ চক্রবর্তী জানিয়েছেন, তৃণভোজী প্রাণীদের ঘাস, লতা-পাতা এবং অন্যান্য শাকসব্জি হজম করবার জন্য পাকস্থলীতে এক বিশেষ উৎসেচক বা এনজাইম থাকে। বিশেষ ধরনের ব্যাকটেরিয়া সেই এনজাইম তৈরি করে। সেই এনজাইমের গঠনতন্ত্র দেখতে গিয়ে তাঁরা লক্ষ্য করেন, এনজাইমটি কার্বোহাইড্রেট ভেঙে ফেলতে পারছে। তখনই তাঁদের মাথায় কাজ করে ক্লেবসিয়েলার মতো প্রাণঘাতী ব্যাকটেরিয়ার ‘দুর্গ’ হিসেবে কাজ করা বায়োফিল্মেও তো কার্বোহাইড্রেটেরই প্রাধান্য। দেখাই যাক না, সেটির ক্ষেত্রে কেমন কাজ করে সেই এনজাইম?
তৃণভোজী প্রাণীদের পাকস্থলীতে থাকা ব্যাকটেরিয়ার জিন আলাদা করে সেটি ল্যাবরেটরির ই কোলাইয়ের শরীরে প্রবেশ করান বিজ্ঞানীরা। জিনগত পরিবর্তন হওয়া সেই ই কোলাই বিশেষ উৎসেচকটি তৈরি করতে থাকে। সেটি ক্লেবসিয়েলায় প্রয়োগ করতেই দেখা যায়, দ্বিতীয়, তৃতীয় প্রজন্মের কড়া কড়া অ্যান্টিবায়োটিক যে বায়োফিল্মকে ভেঙে ব্যাকটেরিয়াটিকে ঘায়েল করতে পারছে না, বিশেষ উৎসেচকটি সেটি ভেঙে ফেলছে। ফলে অ্যান্টিবায়োটিকের পক্ষে এরপর থেকে ক্লেবসিয়েলা নিধন জলভাত হবে। এমন আশার আলো দেখছেন তাঁরা। এই বিষয়ে পিজি হাসপাতালে ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিশেষজ্ঞ ডাঃ সুগত দাশগুপ্ত বলেন, ভারতে গত পাঁচ বছরে প্রায় ১ লক্ষ মানুষ ক্লেবসিয়েলা সংক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন। আশা করছি, বিজ্ঞানীদের গবেষণার প্রত্যক্ষ সুফল মানুষ শীঘ্রই পাবে।