প্রীতেশ বসু, মধুপুর (ঝাড়খণ্ড): চিত্তরঞ্জন ও জসিডির মাঝে মধুপুর জংশন। এই লাইন দিয়ে চলা প্রায় সব ট্রেন এখানে থামে বলে রাতভর জমজমাট থাকে স্টেশন চত্বর। তখন রাত প্রায় সাড়ে ১২টা। পার্কিং এরিয়ায় টোটো নিয়ে যাত্রীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন মনোজ পাঠান। ফোনে ‘রিলস’ দেখছিলেন। মোবাইলের স্ক্রিনে পর পর ভেসে উঠছে ঝাড়খণ্ডের নির্বাচন নিয়ে নেতাদের বক্তৃতা। মোবাইল থেকে চোখ না সরিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধু টোটোচালকের উদ্দেশে মনোজের মন্তব্য, ‘যতই কাঁটে কি টক্কর বলে হাওয়া তোলা হোক না কেন, জিতবে কিন্তু হেমন্ত-কল্পনা।’ কেন এমন মনে হচ্ছে ? মনোজের জবাব, ‘শহর দিয়ে বিচার করলে চলবে না। গ্রামে গিয়ে দেখলেই বুঝবেন, বিগত পাঁচ বছরে আদিবাসী সহ সমস্ত শ্রেণির মানুষ কী কী পরিষেবা পেয়েছে।’
কী রয়েছে সেই তালিকায়? মনোজ ও ইরফান, দু’জনেই বেশ কয়েকটি প্রকল্পের কথা বললেন, যা গ্রাম-শহর নির্বিশেষে মানুষের উপকারে এসেছে। যেমন, মহিয়া সম্মান যোজনার মাধ্যমে রাজ্যের প্রত্যেক মহিলাকে মাসে ১০০০ টাকা সহায়তা, ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত বকেয়া বিদ্যুৎ বিল মকুব, ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিলে ছাড়, প্রবীণদের পেনসন ইত্যাদি। তাঁদের দাবি, এই কাজগুলির সুফল নিশ্চিতভাবেই ভোটবাক্সে পাবে হেমন্ত-কল্পনার জেএমএম তথা ‘মহাগটবন্ধন’। তাহলে কীসের ভিত্তিতে ‘সেয়ানে সেয়ানে লড়াই’-এর প্রচার চালাচ্ছে গেরুয়া শিবির? মনোজদের মতো তরুণরা কি একপেশে দাবি করছেন? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এবার সুদেশ মাহাতর অল ঝাড়খণ্ড স্টুডেন্টস ইউনিয়নের (আজসু) সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভোটে লড়ছে বিজেপি। তাছাড়া, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা বর্ষীয়ান জেএমএম নেতা চম্পাই সরেন, লবিন হেমব্রম, মণ্ডল মুর্মুদের দলে টানার পর বিজেপির আশা, জেএমএমের আদিবাসী ভোটব্যাঙ্কে থাবা বসানো যাবে। তার সঙ্গে রয়েছে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ নিয়ে সুড়সুড়ি। সব মিলিয়ে নিজেদের আগের থেকে শক্তিশালী মনে করছে গেরুয়া শিবির। তবে লুইস মারান্ডির মতো একাধিক নেতা আবার বিজেপি ছেড়ে যোগ দিয়েছেন জেএমএমে। ফলে বিজেপির ‘জোর টক্কর’-এর তত্ত্ব আদতে ভোট টানার লক্ষ্যে বলে মনে করছে স্থানীয় রাজনৈতিক মহল। মধুপুর জংশনের বাইরে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক হোটেল মালিকেরও একই বক্তব্য। মধুপুরের পাশাপাশি রাঁচি, সরাইকেলা, গিরিডি, গান্ডের মতো জায়গাগুলিতেও সাধারণ মানুষের মনোভাব কমবেশি এক।
কল্যাণমূলক প্রকল্প যে ঝাড়খণ্ডের ভোটে অন্যতম ইস্যু, তা বুঝতে পেরে বিজেপি ঢালাও প্রতিশ্রুতি বিলোচ্ছে। কিন্তু এক্ষেত্রেও ‘মহাগটবন্ধন’ তাদের ছাপিয়ে গিয়েছে। বিজেপি যেখানে ‘গোগো দিদি যোজনা’র মাধ্যমে প্রত্যেক মাসের ১১ তারিখে প্রত্যেক মহিলাকে ২১০০ টাকা দেওয়ার কথা বলছে, সেখানে মহিয়া সম্মান যোজনার ভাতা বাড়িয়ে ২৫০০ টাকা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে জেএমএম। জেএমএমের আবুয়া আবাস যোজনার পাল্টা হিসেবে পিএম আবাসের অধীনে ২১ লক্ষ বাড়ি তৈরির টাকা দেওয়ার পাশাপাশি করমুক্ত বালি সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিজেপি। আগামী পাঁচ বছরে প্রায় আট লক্ষ যুবক-যুবতীকে স্বনির্ভর করা ও সরকারি চাকরি দেওয়ার কথা বলেছে তারা। সেই জায়গায় ‘মহাগটবন্ধন’ সরকার হলে ১০ লক্ষ চাকরি নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। মহিলাদের জন্য সরকারি চাকরিতে ৩৩ শতাংশ সংরক্ষণ, জমির খতিয়ানের গ্যারান্টি, সারনা ধর্ম কোড চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে শিবু সোরেনের দল। উভয় পক্ষই গতবারের তুলনায় আরও ভালো ফলের ব্যাপারে আশাবাদী। এই আবহে আজ, বুধবার ঝাড়খণ্ডে প্রথম পর্যায়ের ভোট গ্রহণ। ৮১টির মধ্যে ৪৩টি আসনে ৬৮৩ জন প্রার্থীর ভাগ্য নির্ধারণ করবেন ১.৩৭ কোটি মানুষ।
ভোটের নিরাপত্তায় মোতায়েন জওয়ানকে আদিবাসী নৃত্যের মাধ্যমে স্বাগত জানাচ্ছেন মহিলারা। মঙ্গলবার রাঁচিতে পিটিআইয়ের তোলা ছবি।