বিদ্যা ও কর্মে উন্নতির যুগ অর্থকরি দিকটি কমবেশি শুভ। মানসিক চঞ্চলতা ও অস্থিরতা থাকবে। স্বাস্থ্যের ... বিশদ
মা কালী নিবেদিতার প্রাণপ্রতিমা। তিনি তাঁর গুরুদেব স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে যখন অমরনাথ আর কাশ্মীর ভ্রমণে গিয়েছিলেন স্বামীজি তাঁকে কালী কে ও কী তাঁর স্বরূপ, এই দেবীর রূপের রহস্য বুঝিয়েছিলেন। সেই থেকেই নিবেদিতার কালীময়তা প্রগাঢ় প্রভাব ফেলেছিল তাঁর মননে, চেতনায়।
এই বক্তৃতাদানের নেপথ্যকার স্বামীজিই। তিনি যখন বুঝলেন তাঁর শিষ্যা ত্যাগ-কর্ম-প্রেম-এ শক্তি অর্জন করেছে তখনই পরীক্ষার মুখে দাঁড় করিয়ে দিলেন। দৃপ্ত কণ্ঠে বললেন, ‘এবার তোমাকে কালীর সম্বন্ধে বলতে হবে— তোমার কালী। যেমন বুঝেছ তেমনি তাঁকে প্রকাশ কর।’
নিবেদিতার মানসিকতা এই সময়ে কেমন হয়েছিল? সুন্দর বিশ্লেষণ করেছেন তাঁর জীবনীকার লিজেল রেঁম—‘বিদেশি খ্রিস্টান হয়ে করতে হবে মা কালীর বিশ্লেষণ। তাতে আবার ধর্মান্ধ জনসাধারণের মনকে খুশি করা চাই। খুশি করা চাই উত্তরপথিক গুরু আর ব্রাহ্ম সমাজের পাণ্ডাদের। এই প্রথম এক কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে নিবেদিতাকে। মনে ভাবেন, ‘কী বলতে যাচ্ছি? মাগো, দেখো যেন একেবারে ডুবে না যাই।’
এই শঙ্কা একেবারেই অমূলক। সাময়িক এই দোলাচল অচিরেই কাটিয়ে উঠে নিবেদিতা তৈরি হলেন। অনেক প্রমাণের মধ্যে তাঁকে এটাও প্রমাণ করতে হবে শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শন বিদেশিদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। শুধু তাই নয়, তারাও শ্রীরামকৃষ্ণের মতকে প্রাধান্য দিয়ে রীতিমতো চর্চা করছে।
এসে গেল ১৩ ফেব্রুয়ারি। সোমবার। অ্যালবার্ট হল লোকারণ্য। বহু গণ্যমান্য উপস্থিত হয়েছেন। ওই তো দেখা যাচ্ছে আসনে স্থির হয়ে বসে আছেন ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মিসেস সালজার, ব্রজেন্দ্রনাথ গুপ্ত, সরলাবালা ঘোষাল, ডাঃ নিশিকান্ত চট্টোপাধ্যায়। তাঁরাও শ্রোতা হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন। এসেছেন ব্রাহ্ম সমাজের নেতারা। সূচনায় অল্প কিছু কথায় বক্তব্য পেশ করলেন আমন্ত্রিত ব্যক্তিরা। তাঁদের মধ্যে ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকারের কী হল কে জানে— হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। তিনি বেশ রেগে গেছেন। নিবেদিতার উদ্দেশে বলে উঠলেন, ‘আমরা এই সকল কুসংস্কার দেশ থেকে তাড়াবার চেষ্টা করছি, আর তোমরা বিদেশিরা আবার সেই সব প্রচার করতে উঠে পড়ে লেগেছ!’
সভায় হইচই পড়ে গেল। সত্যেন্দ্রনাথ সঙ্গে সঙ্গে ডাঃ সরকারের বক্তব্যকে সমর্থন করলেন। একজন ভক্ত শ্রোতা মহেন্দ্রলালকে an old devil বলে গালি দিয়ে বসলেন। শুরুতেই আত্মবিশ্বাসে আঘাত! শ্রীরামকৃষ্ণের চিকিৎসক মহেন্দ্রলালের নির্দয় বাক্যবাণে নিবেদিতা মর্মাহত। তবে স্বামীজির সিংহী সহজে দমবার পাত্রী নন। বীরদর্পে মঞ্চে উঠলেন। সভা শুরু হল। গুরু, ইষ্টদেবকে স্মরণ করে নিবেদিতা বলতে শুরু করলেন। তাঁর প্রাণস্পর্শী ভাষণ শ্রোতাদের মরমে ভেদ করতে লাগল। তিনি প্রশান্ত অথচ দৃঢ়তাপূর্ণভাবে বলে চলেছেন— ‘প্রাচ্যে ঈশ্বর প্রতিমায় কল্পনা এক উলঙ্গিনী নারীরূপে। তিনি আলুলায়িত কুন্তলা, ঘোর নীল গাত্রবর্ণ কৃষ্ণ কালো রূপে প্রতিভাত। তিনি চতুর্ভুজা। দুই হস্তে বরাভয়, অপর দুই হস্তে যথাক্রমে অসি ও রক্তনিঃসৃত নরমুণ্ড। কণ্ঠে নর করোটির মালা, লোলজিহ্বা। শ্বেত ও স্মবিভূষিতাঙ্গ এক পুরুষের বক্ষে তিনি নৃত্যপরা। এক অসাধারণ ভয়ঙ্করী মূর্তি! যারা তাকে জঘন্য বলে নাসিকা কুঞ্চিত করে তারা অনুকম্পাযোগ্য বলা চলে। তারা দেবালয়ের বহিরাঙ্গন থেকেই বিদায় নিয়েছে মাত্র। যেখানে মায়ের বাণী পৌঁছায় সেখানে অগ্রসর হতে সক্ষম হয়নি তারা। তা এরকম ভালোই বলতে হয়।
অধিকন্তু, সে রূপ প্রতীচ্যের নিকট যতটাই ভয়াবহ, হিন্দুর নিকট অপর সকলের চেয়ে তাই প্রিয়তম। সেই দৈবীশক্তি তাঁর ভক্তের নিকট এই একটিমাত্র রূপেই আবদ্ধ নন। শিখদের নিকট তিনি কৃপাণরূপে অবতীর্ণা। নারী, বিশেষত সকল কুমারী কন্যা তাঁরই বিগ্রহ। মহীয়সী সীতা বহুজনের নিকট মহাশক্তিরূপে প্রকটিতা।
কিন্তু এই সকলের চেয়ে কালীরূপই আমাদের অধিকতর আপন। অপর সকলের প্রতি প্রীতি আছে, কিন্তু কালী আমাদের একান্ত আপনজন। তাঁকে জানি আর নাই জানি, আমরা তাঁরই সন্তান, তাঁর কোলের কাছটিতে খেলা করি। জীবনটা তো তাঁর সঙ্গে লুকোচুরি খেলা বই আর কিছু নয়। আর যদি খেলতে খেলতে কোনওক্রমে তাঁর চরণদুটির ছোঁয়া পেয়ে যাই— তাতে তনু-মন-প্রাণে যে দিব্য শিহরন সঞ্চারিত হবে তার ইয়ত্তা কে করবে? ‘মা’ ডাকের মহা উল্লাস কে কবে বুঝতে পারে!’
মুগ্ধ শ্রোতামণ্ডলী অবাক বিস্ময়ে নিবেদিতার কালী ভাবনায় ডুবে গেছেন। অ্যালবার্ট হলে নীরব নিশ্চিত প্রশান্তি। তিনি মঞ্চ থেকে নেমে আসছেন— দেখলেন স্বামীজি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। তিনি খুব খুশি। সরলা ঘোষালের সঙ্গে কথা বলছিলেন। নিবেদিতা এগিয়ে গেলেন।
স্বামীজি বললেন, ‘চমৎকার বলেছ, মার্গট।’
এই স্বীকৃতিটুকুই যে তাঁর উত্তরণের অভিমুখ ঠিক করে দিল তা জানতে নিবেদিতার বাকি রইল না। এর ঠিক চারদিন পর তিনি জোসেফিন ম্যাকলাউডকে লিখলেন সেই অনুভূতির কথাটাই— ‘Swami was greatty pleased about the lecture…’। পরে এই প্রিয় বান্ধবী জোসেফিন ম্যাকলাউডকে জানালেন কালী নিয়ে তাঁর ভাবনা-কল্পনার কথা যা নারায়ণী দেবীর অনুপম অনুবাদে ব্যক্ত হয়েছে—‘কালী সম্বন্ধে একটা নতুন করে ভাব মনে জেগেছে। মায়ের পদতলে শায়িত শিবের ঢুলুঢুলু চোখ দুটি মায়ের দৃষ্টির সঙ্গে মিলেছে কী করে তাই দেখছিলাম। কালী ওই সদাশিবের দৃষ্টির সৃষ্টি। নিজেকে আড়াল করে সাক্ষীরূপে তিনি দেখছেন দেবাত্মশক্তিকে। শিবই কালী, কালীই শিব। মানুষের মনে বিপুল শক্তির আলোড়ন চলছে। তারই প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে এই রূপে এই কী সত্য! অর্থাৎ মানুষই কি দেবতাকে সৃষ্টি করে? তাই ভাবি। বিশ্বের রহস্য কোন লাস্যময়ীর লীলাচাতুরী হালকা ওড়নায় ঢাকা।’
উল্লেখ করা যেতে পারে তাঁর এই বক্তৃতা জনমানসে এতটাই প্রভাব ফেলেছিল যে এর অল্প কিছুদিনের মধ্যে কালীঘাট মন্দির কর্তৃপক্ষ তাঁকে কালী নিয়ে বলবার জন্য আমন্ত্রণ জানান। নিবেদিতা সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করে আগের যা কিছু বিতর্কের জবাব দিয়েছিলেন। তাঁর সেই বক্তৃতাও জনপ্রিয় হয়েছিল। এই সভায় স্বামীজি শারীরিক অসুস্থতার জন্য উপস্থিত থাকতে পারেননি। তিনি অবশ্যই তাঁর শিষ্যার ভাষণে খুশি হয়েছিলেন। কারণ, নিবেদিতার সৃষ্টিতত্ত্বের এই অনভূত সত্য অননুকরণীয়। তাঁর কালী খুব স্পষ্ট। তাঁর কালী ভয়ঙ্করী কিন্তু মানবতার বিপুলশক্তির আধার। কামনা-বাসনার মায়া কাজলে দেখলে তিনি ভয়ঙ্করী। বাসনার বিষ আত্ম-মুক্ত হলেই মা কালী তখন আপন হতেও আপনতর। নিবেদিতার কালী তাই আত্মচৈতন্যের ধ্যানমূর্তি।