সমৃদ্ধ দত্ত, বস্তার: হাইওয়ের বাঁদিকে পাড়ায় ঢোকার মুখেই প্রশস্ত প্রাঙ্গন। দুর্গামণ্ডপ। ধর্মপুরা, দণ্ডকারণ্য প্রকল্পের অন্যতম বাঙালি উদ্বাস্তু পাড়া। ওপারে বাড়িঘর যেমন ছিল, তেমনই ফেলে রেখে চলে আসতে হয়েছিল এখানকার বাসিন্দাদের। মূলত তিনটি তাগিদে—প্রাণ, ধর্ম এবং ইজ্জত রক্ষা। তারপর থেকে অপেক্ষাই করে যাচ্ছেন প্রায় ২৫ লক্ষ বাঙালি। নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে আজও পারেননি। জমির দলিল হোক বা জাতি শংসাপত্রের জন্য হা পিত্যেশ করে বসে রয়েছেন। মাতৃভাষা বাংলার স্বীকৃতিটুকুও মেলেনি। উল্টে তাঁদের বাঙালিত্বই এখন বিপন্ন। ক্ষুব্ধ উদ্বাস্তু বাঙালিরা তাই প্রশ্ন তুলছেন, বিজেপি জিতলে কী লাভ?
একদিন হাতে যেটুকু টাকাপয়সা ছিল তাই নিয়ে সকলে প্রাণপণে একটাই প্রার্থনা করেছিলেন, অন্তত ইন্ডিয়া বর্ডারে যেন যেতে পারি। তারপর বহু কষ্টে বেনাপোল সীমান্ত পেরিয়ে পৌঁছনো শিয়ালদহ স্টেশনে। রেজিস্ট্রেশনের পর রিফিউজি কার্ড হাতে পাওয়া। এরপর কী? কেউ জানত না। একদিন খবর এল অন্য কোথাও যেতে হবে। কোথায়? দণ্ডকারণ্য। ট্রেনে ওঠানো হল হাজার হাজার মানুষকে। রায়পুর স্টেশনে নামার পর ম্যাটাডোর। সেটা যেখানে এসে থামল, সেখানে লাইন দিয়ে অনেক ঘর। টিনের চাল। আর তাঁবুর মতো কিছু ঘর। বাঁশের বেড়া দেওয়া। মানা ক্যাম্প—পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুদের প্রাথমিক ঠিকানা। তারপর সেখান থেকে কাউকে পাঠানো হল পাখানজোড়। কেউ গেল মালকানগিরি। কেউ বস্তার, কেউ কিরণডোল, উমরকোট, পারুলকোট...। দণ্ডকারণ্যের জঙ্গলে পাহাড়ে আর আদিবাসীদের মধ্যে ফেলে দেওয়া হল হাজার হাজার বাঙালিকে।
বস্তার জেলার সদর শহর জগদলপুরের উপকণ্ঠে বসে হরিচাঁদ ঠাকুরের মন্দির নির্মাণের তদারকি করছিলেন ধর্মপুরা দণ্ডকারণ্য বিকাশ সমিতির সভাপতি জগদীশচন্দ্র মণ্ডল। কংগ্রেসের বিধায়ক উন্নয়ন তহবিল থেকে পাওয়া গিয়েছে ১০ লক্ষ টাকা। তার মানে আপনাদের এই ক্যাম্পের সিংহভাগ নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের? উত্তর এল, ‘হ্যাঁ। কিন্তু এখানে আমাদের সঙ্গে ব্রাহ্মণ কায়স্থের কোনও পার্থক্য নেই।’ কেন? জগদীশবাবু বললেন, ‘কারণ, বাঙালি উদ্বাস্তুদের কোনও কাস্ট সার্টিফিকেট দেওয়া হয় না। সরকারি কাগজে পরিচয় বাঙালি রিফিউজি, দণ্ডকারণ্য প্রজেক্ট। ব্যস! সেখানে যে পদবির যেই থাকুক, এখানে সকলেই জেনারেল ক্যাটিগরির। কোনও তফসিলি জাতি বা ওবিসি কিংবা পিছড়া বর্গ নয়।’ পাশেই ছিলেন নিরঞ্জন ব্যাপারী। বললেন, ‘শুধুই কাস্ট সার্টিফিকেট কেন? আজও উদ্বাস্তু হয়েই রয়েছি।’ মানে কী? নিরঞ্জন জানালেন, ‘আজও পাকা দলিল নেই আমাদের। দণ্ডকারণ্য প্রকল্পের আওতায় প্রথমে যখন ব্যবসা আর বাস্তুভূমির জন্য ৭-১০ ডেসিমেল করে জমি দেওয়া হল, তখন শুধুই একটা কাগজ দেওয়া হয়েছিল। ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত এই দণ্ডকারণ্য প্রকল্প চলছিল কেন্দ্রীয় সরকারের আওতায়। তারপর আমাদের তুলে দেওয়া হল রাজ্য সরকারের হাতে। একটা করে পাট্টা দেওয়া হল ৩০ বছরের লিজে। সেই ৩০ বছর তো কবে শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন আর আমাদের কোনও বৈধ দলিলই নেই।’
কেমন আছে দণ্ডকারণ্য প্রকল্পের বাঙালিরা? পাট্টায় স্পষ্ট করে লেখা হয়েছিল, এই জমি কোনওদিন বিক্রি করা যাবে না। কাস্ট সার্টিফিকেট এবং পাট্টা না থাকায় মনে বাসা বেঁধেছে আতঙ্ক। এনআরসি হলে কী হবে? জগদীশ মণ্ডল বললেন, ‘এর থেকেও বড় কথা বাঙালি পরিচয়টাই চলে যেতে বসেছে।’ কেন? কারণ, এখানকার স্কুলের সিলেবাসে বাংলা স্বীকৃত একটা ভাষা নয়। জগদীশবাবুর গলায় হতাশা, ‘অন্তত পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ঐচ্ছিক হিসেবেও বাংলা পড়ানোর জন্য কত আন্দোলন যে করেছি। আমাদের ছেলেমেয়ে নাতিনাতনিদের কাছে অন্তত ভাষাটা বেঁচে থাকবে।’ সঞ্জয় মার্কেটের ব্যবসায়ী অসীম দাশ বললেন, ‘বিজেপি তো ১৫ বছর ছিল। আমরা ওদেরই সমর্থন করেছি বরাবর। কিন্তু কই! কেউ তো কিছু করল না। কলকাতায় গিয়ে বিজেপি এমপিদের কাছে বলে এসেছি, পার্লামেন্টে কিছু একটা বলতে। কিছুই করেনি কেউ।’
জনসংখ্যার বিচারে জগদলপুরে আদিবাসীদের পরেই রয়েছে বাঙালিরা। সুতরাং ভোটের গতিপ্রকৃতি নির্ভর করছে এই উদ্বাস্তুদের উপর। নরেন্দ্র মোদি আসেন। এয়ারপোর্টে আরও প্লেন চলার আশ্বাস দেন। কারখানা গড়ার কথা বলেন। আদিবাসীদের জন্য নতুন নতুন প্রকল্প ঘোষণা করা হয়। বিষণ্ণতা কাটে না অসীমবাবুদের। বললেন, ‘আমরা কোনও আর্থিক সাহায্য চাইছি না। কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য যা যা দরকার, সেগুলো নিয়ে এখনও চিন্তা করতে হবে কেন?’
ফরিদপুর, বরিশাল, টাঙ্গাইল, নেত্রকোণা, খুলনা, ময়মনসিংহ, পাবনার ঘরছাড়াদের পরিবারগুলির লড়াই তাই শেষ হচ্ছে না এখনও।