মেয়াদি সঞ্চয় থেকে অর্থাগম যোগ আছে। সন্তানের আবদার মেটাতে অর্থ ব্যয়। ধর্মকর্মে মন আকৃষ্ট হবে। ... বিশদ
সোমবার বাদে প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে এই মিউজিয়াম। প্রবেশমূল্য মাত্র তিরিশ টাকা। তবে, যদি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ের ইতিহাস নিয়ে বাংলা ও হিন্দি ভাষায় তৈরি মিনিট চল্লিশের লাইট অ্যান্ড সাউন্ডের শো’টি দেখতে চাও, তাহলে আলাদা একশো টাকার টিকিট কাটতে হবে। শোয়ের সময় সন্ধে সাড়ে ৬টা ও সাড়ে ৭টা।
এই হেরিটেজ বিল্ডিংটির ভেতরে ঢুকে কালো পাথরে বাঁধানো পথ ধরে এগলেই চোখে পড়বে ‘শহীদস্তম্ভ’। যার নীচে লেখা রয়েছে এই জেলে মৃত্যুবরণ করা অমর বিপ্লবীদের নাম! ভিতরে দর্শকদের সুবিধের জন্য দ্রষ্টব্যস্থান চিহ্নিত মানচিত্র রয়েছে বোর্ডে। যে সমস্ত দেশনেতারা বিভিন্ন সময় বন্দি ছিলেন এখানে, পরপর রয়েছে তাঁদের নামাঙ্কিত ‘সেল’।
১৯৩৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ৭ মে পর্যন্ত যে ১০ ফুট বাই ৯ ফুট কক্ষে বন্দি ছিলেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, সেটি আজ ‘নেহরু-সেল’। সেলের ভেতরের দেওয়ালে আছে ঐতিহাসিক ফোটো। আছে নেহরুজির প্রমাণ সাইজের মূর্তি। ১৫ দিন অন্তর বাবার সঙ্গে দেখা করতে এসে ১৭ বছরের ইন্দিরা যে গাছতলায় বসে অপেক্ষা করতেন, ঠিক সেইখানটিতে রয়েছে তাঁরও একটি মূর্তি! দোতলায় রয়েছে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের নামাঙ্কিত সেল। এঁদের প্রত্যেকের মূর্তির পাশাপাশি একটি কক্ষে নেতাজির একটি হলোগ্রাম মূর্তিও আছে। আর আছে তাঁদের ব্যবহার করা সিমেন্টের খাট। মোটা লোহার গরাদের শেকল ও আলতারাপ এমনভাবেই দেওয়ালের ভেতর গাঁথা থাকত, যাতে কোনওভাবেই বন্দিরা হাত বাড়িয়ে তার নাগাল না পান! প্রতিটি কক্ষের বাইরে পাথরের ফলকে লেখা আছে তাঁদের বন্দি হওয়ার কারণ এবং বন্দি থাকার মেয়াদ।
গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠবে যখন ফাঁসির মঞ্চের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে! এখানে অনেক সময় জোড়া ফাঁসি দেওয়া হতো, তাই দুটো ফাঁসিকাঠ রয়েছে। পাশে রয়েছে ডিটেনশন-রুম। যেখানে ফাঁসির আগের দিন বন্দিকে এনে রাখা হতো, পূরণ করা হতো তাঁর শেষ ইচ্ছে! এখানে আত্মবলিদান দেওয়া বিপ্লবীদের ছবি সহ নাম এবং ফাঁসি হওয়ার কারণও সবিস্তারে লেখা রয়েছে বোর্ডে। সহ-বন্দিদের ফাঁসির দৃশ্য জোর করে দেখানোর জন্য ফাঁসির মঞ্চের ঠিক সামনের বিল্ডিংয়ের দোতলায় বাকি বন্দিদের ইচ্ছে করেই এনে রাখত ইংরেজরা। যাতে তাঁরা স্বচক্ষে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর দেখে ভয় পেয়ে আত্মসমর্পণ করেন! মঞ্চটির পাশের ‘অটোপসি রুমে’ আছে ব্রিটিশ আমলের টেবিল, ভিক্টোরিয়ান পটারির তৈরি করা বেসিন ইত্যাদি।
পুরনো গুদামঘরটিকে পরিণত করা হয়েছে লাইব্রেরি ও সেমিনার রুমে। তোমাদের প্রিয় কোনও এক বিপ্লবীর উদ্দেশে তোমরা পোস্টকার্ডে চিঠি লিখতে পার নিজের নাম-ঠিকানা সমেত। যে চিঠিটি টানা তিন দিন টাঙানো থাকবে এই লাইব্রেরিরই বোর্ডে! ব্যাপারটা কি অভিনব তাই না?
লাইব্রেরির পাশেই তাঁতকল। মডেলের মাধ্যমে দেখতে পাবে বন্দিদের তাঁতবোনা, চরকায় সুতো কাটার দৃশ্য! পাশে চাবুক হাতে দণ্ডায়মান ইংরেজ পুলিস!
তখন সিসি ক্যামেরা ছিল না বলে যে বন্দিদের উপর সারাক্ষণ নজর রাখা হতো না, তা কিন্তু ভেব না! ওয়াচ- টাওয়ারের উপর থেকেই সমস্ত ওয়ার্ডের বন্দিদের উপর নজর রাখত জেলের পুলিস!
এই ওয়াচ-টাওয়ারের নীচের চাতালেই রাখা আছে মানিকতলা বোমার মামলায় ব্যবহৃত বোমার বৃহৎ রেপ্লিকা বা প্রতিরূপ!
তিনটি ভাগে বিভক্ত ‘প্রদর্শনী কক্ষ’টিতে ঢুকলে প্রথমেই দেখতে হবে একটি ভিডিও। ছবি ও ভাষ্যপাঠের মাধ্যমে এই জেলে ঘটে যাওয়া ঐতিহাসিক ঘটনার কথা তুলে ধরা হয়েছে সেই ভিডিওতে। দ্বিতীয় ভাগে ক্ষুদিরাম বসুর ধরা পড়া, প্রফুল্ল চাকীর মৃত্যুসংবাদ, মানিকতলা বোমার মামলার খবরের পেপার-কাটিং দেখতে পাবে। পাশের ডিম্বাকৃতি ঘরে আছে শেষ ভাগটি। সেখানে রয়েছে নেতাজি, ঋষি অরবিন্দ ও দেশবন্ধুর বাণী লেখা কয়েকটি হলদে হয়ে যাওয়া পাতা!
ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় বন্দি থাকা অবস্থায় ১২০ জন সহ-বন্দিদের চিকিৎসা করেছিলেন যে জেল হাসপাতালে, সেখানেই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বাংলার ভূমিকার বিভিন্ন পর্যায় ও ব্যক্তিত্বদের নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে তিন পর্বের একটি প্রদর্শনী। এখানে দাঁড়ালেই ইতিহাস যেন জীবন্ত হয়ে চোখের সামনে ভেসে ওঠে! ছবি-মডেল-দুষ্প্রাপ্য দলিল-স্মারক কী নেই এখানে! এছাড়াও কয়েকটি বিশেষ কক্ষকে উৎসর্গ করা হয়েছে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, ঋষি অরবিন্দ ও নারী-স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নামে। উপরে ওঠার সিঁড়ির নীচে রাখা আছে একটি পিস্তলের বৃহৎ রেপ্লিকা, যেটি দিয়ে অত্যাচারী আইজি সিম্পসন সাহেবকে হত্যা করেছিলেন বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত! একটি রুমের দেওয়াল জুড়ে কমিক্সের আকারে সাজানো আছে বিপ্লবী কানাইলাল দত্ত, সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও দীনেশ গুপ্তর জীবনের দুঃসাহসিক ঘটনার ছবি!
গোটা সংশোধনাগারটিকে নতুন করে সংস্কার করা হলেও একটি অংশকে ‘ঐতিহাসিক কারাকক্ষ’ নামে বিনা সংস্কারে রেখে দেওয়া হয়েছে। শুধুমাত্র কেমন ছিল সেই সময়ের ব্রিটিশ কারা ব্যবস্থা, সেটা সবাইকে বোঝানোর জন্যই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
আছে ব্রিটিশ আমলের কুইন ভিক্টোরিয়ার ছবি দেওয়া পয়সা থেকে শুরু করে স্বাধীন ভারতের এখন বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া এক নয়া, দু’নয়া, তিন নয়া সহ বিভিন্ন পয়সার বৃহৎ রেপ্লিকার একটি প্রদর্শনীও!
ভিতরের পুলিস মিউজিয়ামে আছে নানারকম বন্দুক, পিস্তল, ছোরা, তলোয়ার। সেগুলো কবে, কী কারণে ব্যবহার করা হয়েছিল ও কীভাবে তা বাজেয়াপ্ত হয় রয়েছে তার বিবরণও। আছে ১৯১০ সালে খুলনা-যশোর গ্যাং সদস্যদের ব্যবহৃত পিস্তল, স্বদেশি ডাকাতদের ব্যবহার করা পেতলের বোমার খোল এবং বিখ্যাত সেই ‘বই-বোমা’!
ও হ্যাঁ, রিসেপশন রুমে রাখা ভারতের প্রথম প্রিন্টিং মেশিনটি দেখতে ভুলো না যেন!
সেকালের পুলিস কোয়ার্টারের জায়গাতেই তৈরি হয়েছে কফি-হাউজ। ভেতরে প্রদর্শিত হচ্ছে নতুন করে সংস্কার করার সময়কার ছবি সমন্বিত একটি ভিডিও। খেতে খেতে সেটি দেখতে মন্দ লাগবে না।
সন্ধ্যা নামার পর দেখতে হবে ‘আলিপুর সেন্ট্রাল জেল লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো’। এখানে স্বাধীনতা আন্দোলন ও স্বাধীনতা প্রাপ্তি নিয়ে ভাষ্যপাঠ ও শ্রুতিনাটক পরিবেশন করা হয়। এছাড়াও ভয়েস অ্যাক্টিং ও লেজারের আলোয় কারাগারের বিভিন্ন অংশকে জীবন্ত করে তোলা হয়! দেখতে দেখতে মুহূর্তের মধ্যে পৌঁছে যাবে সেই পরাধীন ভারতবর্ষে। কখনও শুনতে পাবে অত্যাচারী ব্রিটিশ পুলিসের কর্কশ কণ্ঠ! আবার কখনও কানে বেজে উঠবে নির্ভীক বিপ্লবীদের কণ্ঠে উচ্চারিত সেই পবিত্র মন্ত্র ‘বন্দে মাতরম’।